অতিভোজনে নাকি অমৃতেও অরুচি আসে। সুন্দর ফুটবলের পূজারি দুই প্রতিবেশী ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার লড়াই দেখতে কখনোই বিরক্তি ভর করে না। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর যুদ্ধে চায়ের কাপে ঝড় ওঠে। কেউ ব্রাজিল ব্রাজিল চিৎকারে চারিদিক কাঁপায়, কেউ আকাশী নীল মিছিলে উড়ায় সমর্থনের ফানুস। কেউ কারো চেয়ে কম নয়। তবু, কোথাও না কোথাও কোন একদল পিছিয়ে থাকে খানিক। পাঁচবারের বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলের চেয়ে যেমন কয়েক জায়গায় ঢের পিছিয়ে আর্জেন্টিনা। জবান-র পাঠকদের জন্য সংক্ষেপে তেমন কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হল, যাতে স্পষ্ট হয় ব্রাজিলের এগিয়ে থাকার বিষয়টি।
• বিশ্বকাপ
ব্রাজিল এবং বিশ্বকাপ, একে অপরের সমার্থক। কেন? কেন নয়? একুশ আসরের প্রত্যেকটিতে অংশগ্রহণ, সবচেয়ে বেশিবার চ্যাম্পিয়ন। এই দুটোই যথেষ্ট ব্রাজিলকে কেবল আর্জেন্টিনা নয়, অন্য সব দলের চাইতে আলাদা করতে। ব্রাজিলই একমাত্র দল যারা তিনটি ভিন্ন মহাদেশ থেকে শিরোপা জিতে এসেছে। ইউরোপ, এশিয়ায় গিয়ে বিশ্বকাপ জেতা একমাত্র লাতিন দেশ তারা। সবচেয়ে বেশি (১০৭) ম্যাচ, সবচেয়ে বেশি জয় (৭২), এক আসরে সবচেয়ে বেশি জয় (২০০২ কোরিয়া-জাপান, ৭ ম্যাচের সবকটিতে),। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতা গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার (১০) গোল ব্রাজিলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোরার পেলে’র (১২) চেয়ে দুইটি কম। সর্বোচ্চ হচ্ছে রোনালদোর ১৫টি। বিশ্বকাপে সাতবার ফাইনাল খেলেছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা পাঁচবার। ব্যক্তিগত অর্জনেও এগিয়ে ব্রাজিল। সাত আসরে গোল্ডেন বল পেয়েছে তারা, আর্জেন্টাইনরা তিনবার।
• জুলে রিমে
এখনকার বিশ্বকাপ ট্রফিটি কোন দলকেই স্থায়ীভাবে দিয়ে দেয়া হয় না। চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের বিশ্বকাপের আগেই তা ফিফাকে বুঝিয়ে দিতে হয়। অবশ্য, স্মারক হিসেবে রেপ্লিকা দেয়া হয়। একমাত্র ব্রাজিলই বিশ্বকাপ ট্রফি নিজেদের করে নেয় আজীবনের জন্য। কোন দল তিনবার বিশ্বকাপ জিতলে আসল ট্রফি চিরতরে দিয়ে দেয়া হবে তাদের, ফিফার এমন ঘোষণার পর ১৯৫৮-১৯৭০, চার আসরেই পূরণ হয় শর্ত, ‘৬৬ বাদে বাকী তিনবার চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। ‘জুলে রিমে’ অবশ্য চুরি যায়, ফেরত পায়, আবার চুরি যায়। কিন্তু অর্জন ঠিকই রয়ে গেছে। আর ১৯৭০ এ যখন ব্রাজিলের এমন অর্জন, আর্জেন্টিনা তখনো বিশ্বকাপ জিতেনি। মজাচ্ছলে বলাই যায়, আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ সংখ্যা দুইটি, ব্রাজিলের বিশ্বকাপ ট্রফি দুইটি! ১৯৭৮ এবং ১৯৮৬ তে পাওয়া শ্রেষ্ঠত্বে ড্যানিয়েল প্যাসারেলা কিংবা ম্যারাডোনার হাতে তো উঠে সিলভিও গাজ্জানির নকশা করা বর্তমান ট্রফিটি।
• ফুটবল সর্বস্বতা
ভারতীয়দের কাছে ক্রিকেট যেমন, ব্রাজিলিয়ানদের জন্যে ফুটবলও তাই। প্রচলিত কথা আছে, ব্রাজিলের প্রত্যেকটি মানুষই ফুটবলে একবার হলেও লাথি মারে। তাদের কাছে ফুটবলই ধ্যান, ফুটবলই জ্ঞান। ধর্মের পরেই যার অবস্থান। সেই পঞ্চাশের দশকে মারাকানায় বসা বালক পেলে থেকে শুরু করে হাল আমলের শিশু, সবাই দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চায়। লাতিনে ব্রাজিলের প্রতিবেশী দেশ আর্জেন্টিনায়ও ফুটবল উন্মাদনা বেশ উঁচুস্তরে, তবে ব্রাজিলের চেয়ে বেশি নয়।
• সৌন্দর্য
‘জোগো বোনিতো’, ফুটবলের এক মায়াবী মুদ্রা। সাম্বার তালে তালে পায়ে পায়ে সুরের ঝংকার। ফুল ফুটে, হুল ফুটে। ব্রাজিলের কাছে ভক্তরা কখনোই কেবল জয় চেয়ে আসেনি, চেয়েছে সৌন্দর্য। ব্রাজিল মানেই শৈল্পিক, শিল্পের পূজারী। একেকজন তারকা যেন মাঠের শিল্পপতি। পাসিং, প্রেসিং, আক্রমণে একঘেয়েমি নয়, চোখ জুড়োয়। ক্যানারিনহোরা হেরে গেলেও ভক্তরা কষ্ট পায় না, যদি উপহার পায় সুন্দর খেলা। আর্জেন্টিনাও ফলসর্বস্ব ফুটবল খেলে না। কিন্তু এখানেও জোগো বোনিতোই পুরনো মদের বোতল, যা মাতাল করে দেয় কোটি ভক্তদের।
• তারকা
ব্রাজিল যেন তারকা যোগানের এক অফুরান খনি। কালের বিবর্তনে ফুটবলে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া, বদলেছে নিয়মকানুন, বদলেছে ইতিহাস। ১৯৩০ এ আর্জেন্টিনার গুইলার্মো স্ত্যাবিলে থেকে শুরু করে, ‘৫০ এ ব্রাজিলকে স্তব্ধ করা উরুগুয়ের ঘিঘিয়াও, ‘৫৪র পুসকাস, তারপর একে একে ইউসেবিও, ক্রুইফ, বেকেনবাওয়ারদের মতোন কত তারকা পেয়েছে বিশ্ব, পেয়েছে বিশ্বকাপ যাদের পায়ের জাদুতে সম্মোহিত ছিল সকলে। আর্জেন্টিনায় ডিয়াগো ম্যারাডোনাই বিজ্ঞাপন। ম্যারাডোনার আগে তেমন তারকা ছিল কেউ লা আলবিসেলেস্তে শিবিরে? ১৯৭৮ বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়ক দানিয়েল প্যাসারেলা, মারিও ক্যাম্পেস, বারতোলিরা সেসময় জনপ্রিয় ছিলেন বটে। তারও আগে ১৯৩০ সালে সেই প্রথম বিশ্বকাপেই আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা বনে যাওয়া স্ত্যাবিলে বিশ্বকাপের পর পান তারকা তকমা। ডি স্টেফানোকে নিয়ে আর্জেন্টিনা গর্ব করলেও ঘুরেফিরে আর্জেন্টাইন ফুটবলে ম্যারাডানোই শেষ কথা। মেসি আছেন, একটা সময় মেসির চেয়েও জনপ্রিয় তেভেজ ছিল।
ব্রাজিল ফুটবল দলটা ওই যে, তারকার খনি! সত্যি সত্যিই। পেলে, গারিঞ্চা, ভাভা, কার্লোস আলবার্তো হয়ে বেবেতো, রোমারিও, রিভেলিনো, রিভালদো, কাফু, রবার্তো কার্লোস থেকে রোনালদো, রোনালদিনহো, হাল আমলের কাকা, মার্সেলো, আলভেজ, নেইমার। যুগে যুগে প্রতি পজিশনেই তারকার জন্ম দিয়ে এসেছে সেলেসাওরা। ব্যালন ডি’অর ফুটবলে ব্যক্তিগত সাফল্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার। ইউরোপের বাইরে যখন থেকে দেয়া শুরু হয় তখন থেকে রোনালদো, রোনালদিনহো, কাকারা পেলেও এক মেসিই ধরে রেখেছে আর্জেন্টিনার ঝান্ডা।