গাইল ফে’র প্রথম উপন্যাস ‘স্মল কান্ট্রি’: রুয়ান্ডার গণহত্যার ক্ষত

গাইল ফে’র প্রথম উপন্যাস ‘স্মল কান্ট্রি’: রুয়ান্ডার গণহত্যার ক্ষত

গ্যাবি একজন সাধারণ কিশোর। সে আম চুরি করে এবং তার বাবাকে অমান্য করে। তার বাবা বন্ধুদের সাথে টোটো করে ঘুরে বেড়ানোয় বাধা দেন। গ্যাবি তার প্রথম প্রেম কল্পনা করে, কল্পনা করে তার স্কুলের পত্রবন্ধু, কল্পনা করে অরিলিন’র বাগানে বন্ধুর তিল এবং সবুজ চোখ। সে আইসক্রিমে চিনি পছন্দ করে কিন্তু ঠাণ্ডা নয়। সে সাঁতার পছন্দ করে কিন্তু ক্লোরিন না। গ্যাবি মাত্র দশবছরের বালক যে বুরান্দি’তে বাস করে।

গ্যাবি টাটসিস এবং হুটু’দের মধ্যকার যুদ্ধ নিয়ে তার পিতাকে জিজ্ঞেস করে, “তারা যুদ্ধ করে কারণ তাদের একই দেশ না?”
“না” তার পিতা উত্তর দেয়, “তাদের দেশ একই।”
“তাহলে তাদের ভাষা একই নয়?”
“না, তাদের ভাষা একই।”
“তাহলে, তাদের স্রষ্টা একই নয়?”
“না, তাদের স্রষ্টাও এক।”
“তাহলে তার যুদ্ধ করে কেন?”
“কারণ তাদের একই রকম নাক নেই।”

রূঢ় এবং দ্রুত অভিঘাতের এই সংলাপে ধারণ করা হয়েছে একজন অল্পবয়েসী বালকের অনুসন্ধান এবং একজন পিতার বিদ্রুপাত্মক ব্যাখ্যা কিন্তু সে ব্যাখ্যা রুয়ান্ডার গণহত্যার উৎস ব্যাখ্যার অসৎ উদ্দেশ্যে পর্যবসিত নয়। পিতার উত্তরগুলো কৌতুকরস ও হুুঁশিয়ারির দুর্দান্ত এক সমন্বয়, কখনো একটি পাঞ্চ লাইন, কখনো অবোধ্য সহিংসতার হিসেব, কখনো সূক্ষ্মতম জটিলতা যা গাইল ফে’র প্রথম উপন্যাস স্মল কান্ট্রি’র স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। ফেঞ্চ বেস্টসেলার এবং ‘প্রিক্স গনকোর্ট দেস লাইসিনস’ জয়ী স্মল কান্ট্রি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সারাহ আদ্রিজজোন। এই উপন্যাসটি বুরান্দিতে জন্ম এমন একজন লেখকের শৈশবের প্রতিবিম্ব।

১৯৯৫ সালে গাইল ফে ফ্রান্সে অভিবাসিত হন তার ফ্রেঞ্চ পিতা এবং রুয়ান্ডান মা ও ছোট বোনের সাথে। তারা একটি টাটসি পরিবার যারা বুজাম্বুরায় বাস করতো। এবং তারা বুজাম্বুরা থেকে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় যখন তারা অনুধাবন করে যে রুয়ান্ডা যুদ্ধের দ্বন্দ্ব তাদের শহরেও আসতে পারে। গ্যাবির মতোই ফে তার জন্মভূমি এবং প্রতিবেশি রুয়ান্ডার সহিংসতার সাথে বিরোধ করলো। এবং আকস্মিক ধাক্কা খেলো জনাকীর্ণ অ্যাপার্টমেন্টের নতুন জীবনে। যেখানে তিনি তার পরিবারের সাথে এসেছিলেন। গাইল ফে’র উপলদ্ধিতে, সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার বিকাশ এবং যুদ্ধোত্তর পল্লীজীবনের প্রতি স্মৃতিকাতরতা, গ্যাবির চরিত্রের প্রতিফলিত এসব শুধু ফে’র নিজের অভিজ্ঞতা নয়, বরং বুরান্দি ছেড়ে আসার পর তার অনুসরণ করা শৈল্পিক পথ।

বুজাম্বুরা, বুরান্দি। ছবি: The Guardian

তরুন গ্যাবির চোখে, পৃথিবী খুব সহজ উত্তর চুয়ে দেয়। ইতিহাস ‘ওকাম র‌্যাজর’ তত্ত্ব সংকীর্ণ করে আনে: একটি নাক নিয়ে জন্মানো থেকে দ্বন্দ্ব! গ্যাবি এবং তার পিতার শুরুর দিকের সংলাপগুলো গ্যাবি’র সচরাচর হওয়া এথনিক বা জাতিগত সংঘর্ষ বুঝার জন্য গঠন করা। শহর জুড়ে গ্যাবি এবং তার বন্ধুরা নাক নিয়ে পড়াশোনা করে এবং পরিণাম অঙ্কন করে। তারা ভুল করে। তাদের খেলা বিদ্বেষপূর্ণ নয়, সরল এবং কৌতূহলী, কিন্তু ইতিহাসের প্রোথিত ক্ষত তারা পুরোপুরি বুঝে ওঠেনা।

কিন্তু গ্যাবির বয়সে এবং যখন পাশেই হত্যামূলক সহিংসতা চলছে, তাকে এবং তার পরিবারকে চিত্রায়িত করা হলো একটি দ্বন্দ্বে, নাকসম্বন্ধীয় প্রভেদ ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হওয়া মেরুতে, এবং বাড়তে থাকা জাতিগত আক্রমণের মধ্যে। স্মল কান্ট্রির কাহিনীর এগিয়ে যাওয়ায়, গ্যাবি হুটু এবং টাটসির মধ্যকার ঐতিহাসিক ক্ষতগুলো বুঝতে ঘাম ঝরালো, একটি সংগ্রাম যা দুর্ভাগ্যবশত বুজাম্বুরাব্যাপী মতাদর্শিক ও শারীরিক যুদ্ধক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছিলো। একই সাথে, সে অনুধাবন করলো শৈশব এবং পরিণত বয়সের মধ্যকার মতাদর্শগত পার্থক্য, রুয়ান্ডা এবং বুরান্দি, শব্দ এবং তার অর্থ। সে নানান চিন্তাকে জটিল সেন্ট্রিফিউজে স্থাপন করলো।

একটি পারিবারিক বিয়েতে, গ্যাবি এবং তার আত্মীয়রা যার যার সিটে বসে নাচছিলো। এটি একটি অপ্রত্যাশিত দৃশ্য যে গ্যাবি নাচার জন্য নয়, প্রশান্তির একটি মুহূর্তে অবস্থান করছে। কিন্তু ছন্দ দ্রুতই আত্মসমর্পণ করলো বিস্ময় এবং নিথর নিরবতার কাছে। আকস্মিক কেউ না, শুধু গ্যাবি নাচছে। কিছু একটা ঘটেছে, সে বুঝতে পারলো। রেডিও উপস্থাপকের একগুচ্ছ শব্দ অন্যদের স্তব্ধ করে দিয়েছে। “সে বললো সব তেলাপোকাকে মরতে হবে”, গ্যাবির মা ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বললেন: তেলাপোকা, টাটসিরা, আমরা।

এই ঘটনার প্রকাশ দুইভাবে হয়। গ্যাবি হঠাৎ করেই নাচের জন্য আত্মবিশ্বাস পেয়েছিলো অথবা পরিণত বয়সে গ্যাবির আচরণ চিত্রায়িত করা। কিন্তু তার উন্নতি দ্বিগুন হারে পরিলক্ষিত হয়, এই রূপান্তর নিষ্পাপ মনের উন্মুক্ত প্রকাশ, শান্তির পুনক্রমাঙ্কনে গ্যাবির পৃথিবীতে, তেলাপোকা একটি বাদামি পিচ্ছিল পোকা এবং এর বেশি কিছু না।

বিল্ডাংস্রোমান (জার্মান উপন্যাসের একটি রীতি, শিক্ষামূলক উপন্যাস) হলো ঐতিহ্যগতভাবে আবেগহীন পৃথিবীর পটভূমির বিপরীতে দু’টি আত্মার সংগ্রামকে উপস্থাপন করা। কিন্তু স্মল কান্ট্রি বিল্ডাংস্রোমান’র বক্রোক্তি শুধু নিরপেক্ষ পৃথিবীর বিরুদ্ধে ধরেনি, বরং বিক্ষুদ্ধ একটি আত্মা, যে নিজেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, নিজেকে পেছনে স্থানান্তরিত করে গ্যাবিকে স্থানান্তর করছে সামনে। যখন গ্যাবি পরিণত হয় সেখানে বড় মঞ্চে, আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্রে খেলা হয়, কখনো কখনো তা সামনে উড়ে যায় কিশোর গ্যাবির সাথে সাক্ষাতে।

একই সমতলে বিদ্যমান এই উত্তেজনার একটি সৌন্দর্য আছে এবং একটি বিন্যাস আছে যা তাদের একত্রিত উন্নয়ন থেকে নির্মিত হয়। গ্যাবির সাহসিকতা সেতানি’কে অনুসরণ করে উচুস্থান থেকে পুলে ঝাঁপ দেয়। সেতানি ঘোড়ার একটি কালো ছায়া, একটি সশস্ত্র বাহিনী গাড়ি পার করে চলে যাচ্ছে যে গাড়িতে গ্যাবি ভিজে এবং গর্বে এবং দৈবক্রমে বেঁচে আছে তার পূর্বের সাহসিকতা থেকে। অন্য সময়ে, ব্যক্তিগত এবং ঐতিহাসিক উত্তেজনা মিশ্রিত হয়: গ্যাবিকে আদেশ করা হয়, তার বন্ধুর দ্বারা একইভাবে সামরিক লোকটির দ্বারা, গাড়িতে আগুন দিতে যে গাড়িতে প্রতিদ্বন্দ্বী হুটু-র ফাঁদে আটকানো দেহ রয়েছে।

স্মলি কান্ট্রির লেখক গাইল ফে।

স্মল কান্ট্রি ব্যক্তিগত এবং ঐতিহাসিক সংঘর্ষের ছক করেছে তাদের সূক্ষ্ম যোগসূত্রের মাধ্যমে। গ্যাবির জগতে জাজকতন্ত্র নেই, এবং ওই প্রভেদ ছাড়াই, প্রতিপক্ষ স্পষ্ট প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়: শৈশব পরিণত বয়সের বিপরীত হিসেবে প্রয়োজনীয় নয়, এবং হুটু এবং টাটসিদের মধ্যকার উত্তেজনা মানুষের বেড়ে ওঠা থেকে পৃথক। রুয়ান্ডা শুধু বুরান্দিকে মুছে ফেলছে না, বরং শৈশবের বিরুদ্ধে ক্ষেপাচ্ছে, এখানে শুধু পরিণত বয়স সংগ্রাম করছে হুটু-র বিরুদ্ধে এবং বুরান্দি সংগ্রাম করছে টাটসির বিরুদ্ধে।

গাইল ফে শৈশব এবং পরিপক্কতার মতো কনসেপ্টে জোর দেয় এবং এই পরিস্থিতিতে তাদের নমনীয় সংজ্ঞা থেকে এবং পাঠককে প্রশ্ন করে তারা কি অর্থ বুঝছে। শব্দ কতটুকু সংবেদনশীল অথবা একে অপরের রূপদায়ক। যখন শব্দ নতুন অর্থের দিকে ধাবিত হয়, কিভাবে এটি তা বড় পরিসরে স্থানান্তর হয়। কি বিপদ এবং নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে? যখন আমরা শব্দ ভাড়া দেই- ছোট শব্দ, ভারী শব্দ- তার অর্থ থেকে সরে যায়? স্মল কান্ট্রি তার সমগ্র জুড়ে এই প্রশ্ন করে তার দক্ষ বা পটু গদ্য এবং এমপ্যাথিক চরিত্রের মধ্য দিয়ে।

গ্যাবির পরিবারের পালিয়ে আসার আগে, জাতিগত নিধন এবং সহিংস সম্মেলগুলোর আগে, গ্যাবি এবং তার বন্ধু গিনো পা টিপে সরাইখানায় প্রবেশ করে যাকে লেখক ‘দ্য গ্রেটেস্ট ইনস্টিটিউশন অব বুরান্দি’ সম্বোধন করে। ‘দ্যা কাবারেট’ যা মুক্তবাক এবং প্রচুর মদের জন্য বিখ্যাত। এখানে, একটি অন্ধকার লোহার শামিয়ানার নিচে, মানুষ ক্লান্তির পর আরাম করে, বিয়ের জন্য স্খলন করে চামড়ার র‌্যাংকিং ও পদমর্যাদা, রাজনৈতিক কথাবার্তায় ভারমুক্ত হয়।

গিনো নিজের এবং গ্যাবির জন্য বিয়ার অর্ডার করে। বালক দু’জন পান এবং শোনার মধ্য দিয়ে তাদের সন্ধ্যা অতিবাহিত করে। হতে পারে এটি অন্ধকার, হতে পারে বালকেরা মদ্যপ। কিন্তু শব্দরা স্রোতের মতো, পুনরাবৃত্তি থেকে তা গ্রহণ করতে হয় নতুবা কথার সমুদ্রে তলিয়ে যেতে হয়। মাতালেরা আসন্ন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন নিয়ে কথা বলে, নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে, ভুল গণতন্ত্র নিয়ে, পশ্চিমা শক্তির অনধিকার চর্চা নিয়ে, এবং এসবের প্রকৃত লেনদেনের মধ্যে গ্যাবি পুনরাবৃত্তি শুনতে পায় “আমি তৃষ্ণার্ত”। রাজনৈতিক কথাবার্তা বাড়তে থাকে, আসন্ন সংকট বৃদ্ধির অনুভূতি এবং নিথরতা। প্রোভোকশন এবং পন্টিফিকেশনের মধ্যে পরিচিত হয়ে ওঠে- আমি তৃষ্ণার্ত, আমি তৃষ্ণার্ত। কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কথাবার্তা সবিরাম তৃষ্ণার সাথে ধাক্কা খায় এবং সংলাপে পরিবর্তন। এভাবে রাজনৈতিক অনুভূতি অন্ধকারে রূপায়িত হয়।

এই দৃশ্যে বিরতি নিন, অভ্যন্তরস্থ সময়কে আকড়ে ধরুন এবং ফে’র উপন্যাসটি এখনো ধরে রাখুন। এই দৃশ্য সময় তৈরি করে নি কিন্তু সময় একত্রিত করেছে, বিশ্রাম দিয়েছে, বিবেচনা করেছে। যদিও এই দৃশ্য শেষ নয়, স্মল কান্ট্রি আমাকে এখানে ছেড়ে দিয়েছে অথবা আমাকে পেছনে টেনে নিয়ে গেছে এমনকি সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরও টেনে নিয়ে গেছে। এটি আমাকে ছেড়ে দিয়েছে দেশের মধ্যকার, পূর্বাভাস ও আগমনের মধ্যকার, সতর্কতা এবং সংঘাতের মধ্যকার সংবেদনশীল স্থানে। এটি আমাকে ছেড়ে দিয়েছে তরুন গ্যাবির সাথে একটি কার্যকর, সামান্য মদ্যপ, ‘কি হচ্ছে’ এবং ‘কি হবে’ এমন সংশয়ে ঘুরতে থাকা রাষ্ট্রে।


লেখাটি ওয়ার্ডস উইদআউট বর্ডার এর জুন সংখ্যা রিভিউ সেকশনে প্রকাশিত হয়। লেখক এমিলি রোইস। লেখাটি জবান-র পাঠকদের জন্য অনুবাদ করা হয়েছে।