“আবুল হাসান মাত্র ২৯ বছর বয়সে মারা যান। তার মৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ক্ষীণায়ু জন কীটস্ এবং সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা। জানি না, কত বছর বয়সে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। তার কবিজীবন দীর্ঘ নয়। তার সংক্ষিপ্ত কাব্যচর্চা আমাদের উপহার দিয়েছে ‘রাজা যায় রাজা আসে’, ‘যে তুমি হরণ করাে এবং ‘পৃথক পালঙ্ক’-এর মতাে তিনটি উজ্জ্বল কাব্যগ্রন্থ। তাছাড়া তার অগ্রন্থিত কবিতার সংখ্যাও কম নয়।”
কীটস কিংবা সুকান্তের সাথে তুলনা করে আবুল হাসান সম্পর্কে উপরের মন্তব্যটি করেছেন কবি শামসুর রাহমান। আবুল হাসানের মৃত্যুর পরে তার সকল গ্রন্থিত ও অগ্রন্থিত কবিতা, নাটক এবং গল্প নিয়ে প্রকাশিত ‘আবুল হাসান রচনা সমগ্রে’র ভূমিকাতে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিবেচনায় আবুল হাসানের বেঁচে থাকার (১৯৮৭-১৯৭৫ ইং) সময়কালটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম আর পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র জন্মের মধ্যবর্তী কালেই যেন তার আগমন ও প্রস্থানের সময়কাল। ফলে তার সামনে ছিল এক অসহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিমণ্ডল। তার সমসাময়িক অনেক কবিই তখন সরল রাজনৈতিক কবিতা লিখেছেন; জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষিতে কবিতা লিখেছেন, কিন্তু তখন সংকটের অত্যন্ত গভীরে গিয়ে কবি আবুল হাসান তার কবিতা উচ্চারণ করেছেন। ‘জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন’ কবিতায় কবি লিখেছেন–
মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবেনা,
আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে
আমার মৃত্যুর আগে বোলে যেতে চাই,
সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন
কী লাভ যুদ্ধ কোরে? শত্র“তায় কী লাভ বলুন?
আধিপত্যে এত লোভ? পত্রিকা তো কেবলি আপনাদের
ক্ষয়ক্ষতি, ধ্বংস আর বিনাশের সংবাদে ভরপুর
কবির জীবনে শত শত অপ্রাপ্তির মাঝেও সম্ভবত একটি অর্জন কবিকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিল, আর তা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা ও হাজারো নিরীহ মানুষের রক্ত দানের বিনিময়ে। যা কবিকে এক বেদনা মিশ্রিত প্রশান্তি প্রদান করে। তাইতো কবি তার নতুন দেশের পতাকা নিয়ে ‘উচ্চারণগুলি শোকের’ কবিতায় লিখেছেন–
অনেক রক্ত যুদ্ধ গেলো,
অনেক রক্ত গেলো,
শিমুল তুলোর মতো
সোনারূপো ছড়ালো বাতাস।
ছোটো ভাইটিকে আমি
কোথাও দেখিনা,
নরোম নোলক পরা বোনটিকে
আজ আর কোথাও দেখিনা!
কেবল পতাকা দেখি,
কেবল উৎসব দেখি,
স্বাধীনতা দেখি,
তবে কি আমার ভাই আজ
ঐ স্বাধীন পতাকা?
তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদীতে উৎসব?
স্বাধীন বাংলাদেশ কিংবা স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশ- কখনোই যেন গুম-খুন থেকে মুক্ত ছিল না সে। সেসব দুঃসময়গুলি উঠে এসেছে আবুল হাসানের সাহসী কলম থেকে। ‘একটা কিছু মারাত্বক’ কবিতায় তিনি লিখেছেন–
কেন এত রক্তপাত হবে? গুপ্তহত্যা হবে?
কেন জীবনের দ্রব্যমূল্য বাড়বে এত শনৈঃ শনৈঃ
কেন ফুরাবে এমন আমাদের পকেটে সিগ্রেট,
খাদ্য ,রুপালী আত্নার ঘ্রাণ রমণী ও টাকা?
একটা কিছু মারাত্নক ঘটছে কোথাও
নইলে কেন পাওয়া যায় না প্রেমিকা?
কেন মোমের আলোর শিখা আজকাল
ধীরে জ্বলে,
ধীরে জ্বলে, মাঝরাতে
মহিলার শাড়ি কেন সভ্যতার শোভার মতন
খুলে যায়
নেমে যায় , আজকাল
কেন এত সহজেই ভেঙে পড়ে কালো চোখ, কোমল যৌবন?
রাজনীতির নামে জনগণকে বার বার বোকা বানায় এদেশের শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের সহচররা। বাস্তবে এদেশের জনগণের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। এই অসুস্থ রাজনীতিকে আবুল হাসান আখ্যায়িত করেছেন ‘অসভ্য দর্শন’ হিসাবে। তিনি লিখেছেন–
দালান উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি,
দেবদারু কেটে নিচ্ছে নরোম কুঠার তাও রাজনীতি,
গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি, গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি!
মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি, মানুষ মরছে তাও রাজনীতি!
বোন তার বেণী খুলছে যৌবনের অসহায় রোদে মুখ নত কোরে
বুকের ভ্রমর হাতে রাখছে লুকিয়ে – তাও রাজনীতি
তবুও কবি নিরাশ নন, সমাজ-রাষ্ট্র বদলানোর স্বপ্ন দেখেন, অন্যদেরকেও সেই স্বপ্ন দেখাতে চান। সময়ের গাঢ় অন্ধকার, সীমাহীন ক্লেদ, জগদ্দল পাথর অতিক্রম করার জন্য ‘বদলে যাও, কিছুটা বদলাও’ কবিতায় তিনি লিখেছেন–
রক্তমাখা দুঃখের সমাজ কিছুটা বদলাতে হবে…
বদলে দাও, তুমি বদলাও
নইলে এক্ষুনি
ঢুকে পড়বে পাঁচজন বদমাশ খুনী ,
যখন যেখানে পাবে
মেরে রেখে যাবে,
তোমার সংসার, বাঁশী, আঘাটার নাও।
বদলে যাও, বদলে যাও, কিছুটা বদলাও!
কিন্তু বাংলা সাহিত্যের এমন রাজনীতি সচেতন কবি বেশি দিন হায়াত পেলেন না, এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের বটে, তবে তিনি মরেও যেন বেঁচে আছেন। আর মরেও যে তিনি বেঁচে থাকবেন তা মনে হয় নিজেই জানতেন! তা না হলে ‘নচিকেতা’ কবিতায় তিনি কেন লিখে গেলেন–
মারী ও বন্যায় যার মৃত্যু হয় হোক। আমি মরি নাই—শোনো
লেবুর কুঞ্জের শস্যে সংগৃহীত লেবুর আত্মার জিভে জিভ রেখে
শিশু যে আস্বাদ আর নারী যে গভীর স্বাদ
সংগোপন শিহরনে পায়—আমি তাই।
বাংলা সাহিত্যের এই মহান কবি হোক আমাদের রাজনৈতিক বোধ তৈরির হাতিয়ার। আমাদের কবিতা হোক সকল প্রকার জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এ সংবাদ জানতে পারলেই হয়ত কবি সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন!