বায়ু দূষণের চাদরে মোড়ানো রাজধানী। দিন দিন এই দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় স্থান দখল করে নিয়েছে অনেক আগেই। তার সাথে বায়ু দূষণেও বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। এই দূষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ধুলা। এই ধুলার কারণে রং হারাচ্ছে প্রকৃতি এবং প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ নীরব ঘাতক এই বায়ু দূষণের কারণে।
বায়ুতে নানা ধরনের উপাদান রয়েছে। এসব উপাদানের মধ্যে ‘পিএম ২.৫’ যা মানব দেহের জন্য মারাত্নক হুমকি বয়ে আনে। পিএম নির্গত এর দিক থেকে ঢাকা তৃতীয় এবং শীর্ষে রয়েছে ভারতের দিল্লি। বায়ু দূষণের ফলে প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষ মৃত্যু বরণ করছে। এদিকে শিশু মৃত্যুর হার পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। বিশ্বের যেসব কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় তার মধ্যে বায়ু দূষণ পঞ্চম স্থানে রয়েছে।
সাধারণত ইটভাটা, শিল্পকারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়া এবং সড়ক ও ভবন নির্মাণসামগ্রী থেকে তৈরি ধুলার কারণে দূষিত হয় বায়ু। এই বায়ু দূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা ছাড়া শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ ও হৃদরোগের পরিমাণ বাড়ায়। অ্যাজমা ও ফুসফুসের ক্যানসার হতে পারে।
গত পাঁচ বছরে ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে বছরে রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৭ হাজারের কিছু বেশি তা এখন লাখ ছাড়িয়ে। বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডাঃ কাজী সাইফউদ্দীন জানান, যাদের আগে থেকে হাঁপানি অ্যাজমা রয়েছে তা ভাল হয় না। তাদের সিওপিডি রোগের মাত্রা বাড়তে থাকে। দূষিত পদার্থ ফুসফুসে গেলে আইএলডি জাতীয় রোগ বেড়ে যায়। তিনি আরো জানান, সচেতনতার অভাবে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে দূষণজনিত নানা রোগে।
বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আমরা খারাপ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। হয়ত ফলাফলটা এই মুহূর্তে না বুঝলেও দীর্ঘ মেয়াদে স্বাস্থ্যের বড় ক্ষতি ডেকে আনছে এই বায়ু দূষণ। এমনকি পনের-বিশ বছরে আমরা পঙ্গু জাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছি।
বায়ু দূষণ এমন এক পর্যায় চলে গেছে যে জরুরি হয়ে পড়েছে আলাদা আইনের। আইনের খসড়া তৈরি করা হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্পের অধীনে নির্মল বায়ু আইনের খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহযোগিতায় খসড়া প্রণয়নের কাজ করছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সুলতান আহমেদ বলেন, বায়ুদূষণ রোধে আইন এবং ওই আইনের বিধি প্রণয়ন করতে ছয় থেকে সাত বছর লাগবে। বায়ুদূষণ পরিস্থিতি যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তা রোধে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অধীনে একটি বিধিমালা করা হলে দ্রুত বায়ুদূষণ রোধ করা যাবে বলে তিনি মনে করেন।
নির্মূল বায়ু আইনের বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সেটি নির্ধারণ কঠিন হবে বলে মনে করেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি জানান, “আইন করা হল কিন্তু সেটি কেউ মানছে না—এমনটি হলে হবে না। জনগণকে বায়ুদূষণ রোধ কার্যক্রমে যুক্ত করতে হবে।”
ঢাকার বায়ু দূষণের জন্য ৫৮ শতাংশ দায়ী ইট ভাঁটা। এছাড়া গাড়ির কালো ধোঁয়া, মাটি ধুলা ও নির্মাণ উপকরণ বালি বা সিমেন্ট থেকে অনেক বেশি পরিমাণে বায়ু দূষণ হয়। এ নিয়ে ‘নির্মূল বায়ু টেকসই পরিবেশ’ প্রকল্প পরিচালক ডক্টর এস এম মনজুরুল হান্নান খান বলেন, ২০২০ সালের মধ্যে কোন ট্র্যাডিশনাল ইট ভাটা থাকবে না। বিআরটিএ ও প্রশাসনকে বলা হয়েছে যাতে পুরাতন গাড়ি চলতে না পারে। নির্মাণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে তারা যাতে বায়ু দূষণ না করে। ১০ বছর মেয়াদি এই প্রকল্প নির্মূল বায়ু টেকসই পরিবেশের আওতায় পরিবেশ অধিদপ্তর এই সব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে।
সকাল বিকাল ইট ও বালু ভিজিয়ে রাখার নিয়ম থাকলেও মানছে না কেউ। রাজধানীতে রাস্তা মেরামত ও ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় এসব নিয়ম অমান্য করতে দেখা গেছে হরহামেশাই। মগবাজার-মৌচাক এলকার বাসিন্দারা সেখানে ফ্লাইওভার নির্মাণ চলাকালে ব্যাপক ধুলাবালির মধ্যে চলাচল করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে সরকারপক্ষ সব সময় জনসচেতনতা সৃষ্টির কথা বলে থাকে। সচেতনতা সৃষ্টি করা গেলে শুধু বায়ু দূষণ নয় সব ধরনের পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।