ফুটবলের বিস্ময় লিওনেল আন্দ্রেস মেসি

ফুটবলের বিস্ময় লিওনেল আন্দ্রেস মেসি

২৬ জুন ২০১৮, সেন্ট পিটার্সবার্গ, রাশিয়া। নিউ জেনিত স্টেডিয়ামে মুখোমুখি আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া। আলসাবিলেস্তেদের বিশ্বকাপ স্বপ্ন জিইয়ে রাখতে জয়ের বিকল্প নেই। টিকটিক করে চলা ঘড়ির কাটা নব্বই মিনিটের ঘর ছুঁইছুঁই করছে, কিন্তু গোলের দেখা নেই। বিমর্ষ বদনে শেষ বাঁশির অপেক্ষায় বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে থাকা আর্জেন্টাইন ভক্তরা। কিন্তু একজন তখনো দমে জাননি। গতির তুফান তুলে পায়ে অনবদ্য কাজে কয়েকজনকে কাটিয়ে নিলেন বুলেট গতির এক শ্যুট; পরাস্ত গোলরক্ষক। জয়ের বুনো উল্লাসে মত্ত সবাই। মাঝে নীলাভ আকাশে আফতাব হয়ে জ্বলছেন গোলদাতা; লিওনেল আন্দ্রেস মেসি।

ওপরে পুরো অংশটাই কল্পনা। আগমনের শুরু থেকে অদ্যাবধি বহু অকল্পনীয় মুহুর্তের জন্ম দিয়েছেন যিনি তাকে নিয়ে এরুপ কল্পনাবিলাসী হওয়াই যায়। ছিয়াশির পর থেকে বহু খেলোয়াড়ের মাঝে আর্জেন্টাইনরা খুজেছে ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনাকে। মেসি বাদে কেউই সে নামের ভার বইতে পারেননি। আর এতটাই ভাল পেরেছেন যে, নতুন ম্যারাডোনা না বরং নিজের নামেই স্বমহিমায় উজ্জল তিনি।

স্টিল ফ্যাক্টরি ম্যানেজার হোর্হে মেসি এবং ম্যাগনেট ম্যানুফ্যাকচারিং ওয়ার্কশপের ম্যানেজার সিলিয়ার চার সন্তানের তৃতীয় লিওর জন্ম ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন রোজারিওতে। ছোট বেলাতেই ফুটবলের প্রেমে পড়া মেসির শৈশব কেটেছে দুই অগ্রজ এবং কাজিনদের সাথে বল পায়ে  উঠোন মাত করে। মাত্র চার বছর বয়সেই স্থানীয় ক্লাব গ্রান্ডোলিতে যোগ দেন লিও। তার মাত্র দু’বছর পরেই গায়ে চাপান প্রিয় ক্লাব নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজের। ওল্ড বয়েজের জার্সি গায়ে কিশোর মেসি করেছিলেন প্রায় পাঁচশ গোল। গোলের সংখ্যার মতই দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছিল ছোট্ট লিও। কিন্তু যার জীবনী পরবর্তীতে পরিণত হবে অজস্র পাঠকের প্রিয় পাঠ্যে সে চিত্রনাট্যে ভিলেনের আগমন না হলে বোধয় জমে না।

তবে ভিলেন হয়ে কোনো ব্যক্তি নয় বরং এলো এক ব্যাধি। হরমোনগত যে ব্যাধির আরোগ্যের জন্য চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য ছিল না লিওর বা কিংবা ক্লাবের। লিওর ওপর নজর রাখা বিশ্বখ্যাত আর্জেন্টাইন ক্লাব রিভার প্লেটও পিছিয়ে গেল চিকিৎসার ব্যায়ের ভয়ে। এটাকে অদৃষ্টের ইচ্ছা বললে বোধয় ভুল হবে না। নানা নাটকীয়তার পর লিওকে টেনে নেয় কাতালান পাওয়ার হাউস বার্সেলোনা।

চৌদ্দ বছর বয়সে হরমোন চিকিৎসা শেষে লিও অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন বার্সার সর্বকালের সেরা যুব দলের, যেটি পরিচিতি পায় ‘বেবি ড্রিম টিম’ নামে। যুব দলের হয়ে নিজের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মৌসুমে ৩০ ম্যাচে ৩৬ গোল দিয়ে জানান দিয়েছিলেন নিজের আগমন বার্তার। সে সময় লিও নজর কেড়েছিলেন ইংলিশ জায়ান্ট আর্সেনালের। কিন্তু বন্ধু ফেব্রেগাস বা পিকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইংলিশ ফুটবলের স্বাদ নেয়ার বদলে প্রাণের ক্লাব বার্সার সেবা করার বিষয়ে মনঃস্থির করেন লিও।

বার্সার মহাতারকা রোনালদিনহো প্র্যাক্টিসরত কিশোর লিওকে দেখেই সতীর্থদের বলেছিলেন যে একদিন এই ছেলেটি তাকেও ছাড়িয়ে যাবে। দিনহোর সে ভবিষ্যৎবাণী ভুল তো প্রমাণ হয়ই নি বরং বার্সার জার্সি গায়ে লিও যা করেছেন তা দিনহোও ভেবেছিলেন কিনা সন্দেহ। সতীর্থদের আবদারেই তৎকালীন কোচ ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড লিওকে প্রমোশন দিয়ে মূল দলে নিয়ে অাসেন। আর তার অধীনেই শুরু হয় লিও থেকে মেসিতে পরিণত হবার মুগ্ধকর পথচলা।

কিছু খেলোয়াড় থাকে, পরিসংখ্যান দিয়ে যাদের বোঝাতে যাওয়াটা হয় বোকামির নামান্তর। মেসিও তেমনই একজন। তার টানা চারটি সহ পাঁচটি ব্যালন ডি’অরও বোঝাতে পারবে কতটা মুগ্ধকর তিনি। দু’ পায়ে মাঠটাকে ক্যানভাস বানিয়ে যেন মনের খেয়ালে ছবি একে যাওয়া এক চিত্রকর তিনি। যার প্রতিটি ছোঁয়া জন্ম দেয় মুগ্ধতার। বিমোহিত, বিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকে অগনিত মুগ্ধ চোখ। মেসিকে বোঝানোর জন্য বোধকরি পৃথিবীর কোনো ভাষারই শব্দ ভান্ডারে যথেষ্ট নেই। মেসিকে দেখতে হয়, শিহরণ নিতে হয় তার ডিফেন্স ছেঁড়া পাস কিংবা গোলরক্ষককে শিশু বানিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দেয়া গোলগুলো দেখে।

আর্জেন্টিনা যুব দলের হয়ে জিতেছেন ফিফা ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপ। যেটিতে সেরা খেলোয়াড় এবং সর্বোচ্চ গোল স্কোরার, দুটি পুরষ্কারই বগলদাবা করেছিলেন তিনি। জিতেছেন ২০০৮ সালের অলিম্পিকের স্বর্ণপদকও। ২০০৫ সালে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেকও হয়ে যায় তার। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে মাঠে নেমে হয়ে যান সর্বকনিষ্ঠ আর্জেন্টাইন হিসাবে বিশ্বকাপে মাঠে নামা, এবং গোল করা খেলোয়াড়।

ক্লাবের হয়ে দিনকে দিন নিজেকে যেমন অস্পর্শনীয় এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, জাতীয় দলের হয়ে গল্পটা হয়েছে ঠিক বিপরীত। ২০০৬ এ কোচের অদ্ভুৎ খেয়ালের বলি হওয়া দিয়ে শুরু, জাতীয় দলের হয়ে সবটুকু নিংড়ে দিলেও দিন শেষে গল্পটা শুধুই হতাশার।

২০১০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ফুটবল ঈশ্বর ডিয়াগো ম্যারাডোনার সাথেও জুটি বেধে পারলেন না। ২০১৪ তে নিজের সামর্থের সর্বোচ্চ দিয়ে দল ফাইনালে তুলেও ছোঁয়া হলো না স্বপ্নের ট্রফিটা। ২০১১ থেকে জাতীয় দলের বাহুবন্ধনী বাহুতে বেঁধে মাঠে নামা মেসি জাতীয় দলের হয়েও সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডটি নিজের করে নিয়েছেন। জিতেছেন ‘১৪ বিশ্বকাপের সেরার পুরষ্কারও। ব্যক্তিগত এ অর্জন কোনো সান্ত্বনা বয়ে আনতে পারেনি, বরং বাড়িয়েছে বেদনা। টানা তিনটি ফাইনালে হারের ক্ষত নিয়ে যিনি বিদায়ই বলে দিয়েছিলেন জাতীয় দলকে।

সে বিদায় স্থায়ী হয়নি। বিশ্বজোড়া সমর্থকদের আকুল আবেদনে আবারো ফিরেছেন আকাশি জার্সি গায়ে। খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলে বিশ্বকাপে নিয়ে এসেছেন দলকে। কিন্তু আবারো সেই হৃদয় ভাঙ্গার গল্পের যেন নতুন চিত্রনাট্য লেখা হচ্ছে। জন্মদিনের দুদিন পরেই বাঁচা মরার সে ম্যাচ। মেসি কি পারবেন জন্মদিনে নিজেকে সেরা উপহারটা দিতে? জাতীয় দলের জার্সি গায়ে বিধ্বস্ত মেসি যেন ফুটবলেরই মস্ত বড় এক ধাঁধাঁ। ক্লাব পর্যায়ের একের পর এক রেকর্ড যার পায়ের কাছে এসে লুটিয়ে পরে জাতীয় দলের হয়ে তিনি কেন ফিরেন শূন্য হাতে? জওয়াবটা দিতে হবে মেসিকেই, এবং সেটি তা পা জোড়া ব্যবহার করেই।

ব্যক্তিগত জীবনে সাদামাটা মেসি বিশ বছর বয়সেই বাধা পড়েন আর্জেন্টাইন সুন্দরী আন্তেনেলা রোকুজ্জের বাহুডোরে। সে থেকেই চার জোড়া হাত এক হয়ে আছে এখনো। আর এ জুটির ভালোবাসার প্রমাণ হিসাবে ঘর আলো করে এসেছে তিন সন্তান; থিয়াগো, মাতেও এবং চিরো। ২০১৭ সালের ৩০ জুন এ দুজনের প্রণয় রুপ পায় পরিণয়ে। যা খেতাব পায় সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিসাবে। পরিবার অন্তঃপ্রাণ মেসি অদ্যবধি জড়াননি কোনো নারী ঘটিত কেলেঙ্কারিতে। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই যিনি আহরণ করেছিলেন খ্যাতির শীর্ষে তার জন্য এটি আলাদা করে উল্লেখ করার মতো বিষয় বৈকি।

নিজের জীবনের কৈশোরেই ব্যাধির সাথে যুদ্ধ করার ফলের মেসির মনের একটি বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে দুরারোগ্যে অাক্রান্ত শিশুরা। আর তাই নিজের অর্থ এবং সময় ব্যয় করে জড়িত রয়েছেন ইউনাইটেড নেশনস চিলড্রেন্স ফান্ডের সাথে। একই সাথে পালন করছেন জাতিসংঘের গুডউইল অ্যাম্বাসেডরের গুরুদায়িত্বও। পিছিয়ে পড়া শিশুদের উন্নয়নেও ভূমিকা রেখে চলেছেন মেসি। কাজ করছেন এইচআইভি বিষয় জনসচেতনা বাড়াতেও।

সবাই কখনো কারো ভক্ত হয় না, মেসিরও বিশ্বজোড়া সমালোচক রয়েছে। কিন্তু বল পায়ে মেসিকে দেখে একবারের জন্য হলেও বিমোহিত হয়নি এমন আদমি খুজে পাওয়া বিরল। ক্লাবের হয়ে যিনি বত্রিশটা মেজর ট্রফি জিতেছেন তাকে নিয়ে টানা একমাস লিখলেও বোধয় লেখা ফুরোবে না। তাই সে চেষ্টা না করাই ভালো। বরং নিজ জন্মদিনে আরো একবার মেসি ম্যাজিকে উন্মাতাল হয়ে উঠুক ফুটবল বিশ্ব সেটাই প্রত্যাশা থাকবে।

বার্সার জার্সি গায়ে মেসির অর্জনকে এড়িয়ে গেলাম ইচ্ছে করেই, কারণ বার্সার হয়ে বিশ্বের কাছে আর কিছুই প্রমাণ করার নেই তার। বরং নিজের একমাত্র চাওয়া, জাতীয় দলের হয়ে একটি শিরোপার স্বপ্ন পূরণ হোক সেটাই হবে দেখার মত। শুভ জন্মদিন লিও।