বাহিরের বায়ূদূষণ ও নানা রকম জীবাণুর চাইতে ঘরের মধ্যে বেশি ক্ষতি হচ্ছে আপনার দেহের। এই বড় ক্ষতি করছে ঘরে জ্বালানো নীরব ঘাতক মশা তাড়াবার কয়েল। একটি কয়েল থেকে যে পরিমাণ ধোঁয়া তৈরি হয় তা ১০০টি সিগারেটের চেয়েও ক্ষতিকর বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন।
কয়েলের সূক্ষ্ম গুঁড়ো শ্বাসনালি এবং ফুসফুসের পথে গিয়ে জমা হয় যা বিষাক্ত সংক্রমণ তৈরি করে সিগারেটের মতোই। এছাড়াও অনেক সময় কয়েলের ধোঁয়াই চোখ জ্বালা করে। এটা চোখের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর। এর কারণ হল কয়েলে এক ধরণের কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয় তা হল প্যরেথ্রুম। এর ফলে চোখ জ্বালা করা ছাড়াও বমিভাব ও মাথাব্যথা দেখা যায়। মশার কয়েল তৈরি করতে কিছু প্রতিষ্ঠান ক্ষতিকর কেমিক্যাল এস-২ ব্যবহার করে যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এটির কারণে ফুসফুসের ক্যানসার এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
প্রাচীন চীনে চন্দ্র মল্লিকা ফুলের গুঁড়ো পাইরোগ্রাম, গাছের বাকল থেকে পাওয়া আঠা জাতীয় পদার্থের গুঁড়োর সঙ্গে মিলিয়ে মশা তাড়ানোর ধোঁয়া তৈরি করা হতো। বর্তমানে কাঠের গুঁড়ো ও নারকেলের মালার গুঁড়োর সঙ্গে অ্যারারুটের মাড় মেশানো হয়। এক্ষেত্রে কাঠের গুঁড়ো ও নারকেলের মালার গুঁড়ো জ্বালানি হিসাবে এবং মিশ্রণকে জমাট করতে অ্যারারুটের মাড় ব্যবহার করা হয়। মশার কয়েলের প্রধান উপাদান হলো পাইরোফ্রয়েড।
সমস্ত মশার কয়েলে অ্যালেট্রিন থাকে। এর সঙ্গে ফেনল ও ক্রেসল- দু’টি জৈবযৌগ ব্যবহার করা হয়। কয়েলে উল্লেখিত উপাদানগুলোর পরিমাণ মানুষের সহনীয় মাত্রার মধ্যেই থাকে বলে প্রচার করে থাকে প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো। বাজারে বিক্রিত মশার কয়েলে উচ্চমাত্রার রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া গেছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিকের কারণে ফুসফুসের প্রদাহ, ফুসফুসের এলভিওলাইয়ের পুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত রোগ, হাঁপানি, সিওপিডিসহ ফুসফুস ক্যান্সারের মতো রোগ হতে পারে। মাথা ঘোরানো, বমিবমি ভাব, বদহজম ইত্যাদি অসুখ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞের মতে, এছাড়াও বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতির কারণে শিশুর বিকাশও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বড়দের স্মৃতিভ্রম, ঝাঁকুনি, মানসিক অস্থিরতা, মাথাব্যথার মতো সমস্যা হতে পারে।
মশার কয়েল ব্যবহার করে মশা মারতে গিয়ে ডেকে আনছেন নিজের মৃত্যু শ্বাসকষ্ট কাশি সহ নানা সমস্যা। ফুসফুসের ক্যানসারের সম্ভাবনা ৪০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘদিন ব্যবহারে চোখের ভয়ানক ক্ষতি হয়। মানুষের শরীরে স্লো পয়জনিং করে। হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। মশার কয়েলে থাকা অ্যালেট্রিন। এটি মস্তিষ্ক ও রক্তের ভেদ্যতা বাড়িয়ে দেয়। কয়েলের ধোঁয়া শিশুদের জন্য আরও বেশি বিপজ্জনক বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের কিডনি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হানিফ বলেন, মশার কয়েলে যতগুলো কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এর সবগুলোই মানবস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ক্যান্সারের ঝুঁকি। বিশেষ করে গর্ভে থাকা শিশুরা এই ঝুঁকি নিয়ে জন্ম নেয়। জন্মের প্রথমে হয়তো আমরা বুঝি না। কিন্তু ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়স হলে এর অনেক লক্ষণ দেখা যায়। গর্ভাবস্থায় যেসব মা মশার কয়েল ব্যবহার করেন তাদের শিশুরা ভবিষ্যতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে বড় হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে কিডনি, শ্বাস-প্রশ্বাস সমস্যা দেখা দেয়।
গাইনি ও মহিলা রোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনুমোদিত মাত্রার চাইতে বেশি পরিমাণ বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করে তৈরি মশার কয়েলে প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। গর্ভপাতের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। পুরুষের শুক্রাণু কমে যাচ্ছে। প্রিম্যাচিউর বাচ্চার জন্মহার বেড়ে যাচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ বাড়ছে। কয়েলের ধোঁয়ায় চোখে কম দেখা, মাথাব্যথাসহ নানা সমস্যা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মশার কয়েলে সর্বনিম্ন শূন্য দশমিক ১ থেকে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৩ মাত্রার ‘অ্যাক্টিভ ইনগ্রিডিয়েন্ট’ ব্যবহার করতে বলেছে। এ মাত্রা শুধু মশা তাড়ানোর কার্যকর, মারতে নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনুমোদনহীন ব্যবসায়ী মহল কর্তৃক উৎপাদিত কয়েলে শুধু মশাই নয়, বিভিন্ন পোকামাকড়, তেলাপোকা মারা যায়। কেননা এসব মশার কয়েলে অতিমাত্রায় (১০ গুণ পর্যন্ত) ইনগ্রিডিয়েন্ট ব্যবহার করছে, যা মানবদেহে দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। বর্তমানে বাজারে অনুমোদিত ও অনুমোদনহীন শতাধিক মশার কয়েল পাওয়া যায়। এসব কয়েলের প্রস্তুতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নির্দেশিত নিয়ম-কানুন মানছে না। এতে যেখানে কয়েলের ধোঁয়ায় মশার চলে যাওয়ার কথা, সেখানে সেগুলো মরে যাচ্ছে। এ যেন মশার মৃত্যু নয়, একেকজন মানুষেরই মৃত্যু ডেকে আনছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যে ফরমালিন ও পানিতে আর্সেনিকের প্রভাব যেমন দীর্ঘমেয়াদি, তেমনি কয়েলের বিষাক্ত উপাদানও মানুষের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগ সৃষ্টি করে। কয়েলে বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান থাকায় ক্যান্সার, বিকলাঙ্গতা ও লিভারের রোগী বাড়ছে বাংলাদেশে। বাজারে যেসব কয়েল পাওয়া যায়, তাতে কতটুকু মাত্রায় ইনগ্রিডিয়েন্ট ব্যবহার করা হয়, তা এখন আমাদের দেখার বিষয়। এসব কয়েল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে মান যাচাই করা প্রয়োজন। এছাড়া দেশের বাইরে থেকে মশার কয়েল আমদানির ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গঠনে গুরুত্বারোপ করা দরকার, পাশাপাশি মানুষকে সচেতন হওয়ার বিকল্প হবে।