গত মে মাসে (২০১৮) নাগরিক সংগঠন ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’ কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ: দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০১৪’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন। ১৫০ পৃষ্ঠা বিস্তৃত এটি গত নির্বাচনকে নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন। আমরা এক নজরে দেখে নিবো আসলে কি ঘটেছিল সেই নির্বাচনে।
প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয় যে, নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম করা আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার। তবে সে নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য। বস্তুত গণতান্ত্রিক শাসনের প্রথম ও অতি আবশ্যকীয় শর্ত হল সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তথা ‘জেনুইন ইলেকশান’ বা সঠিক নির্বাচন করতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র আন্তর্জাতিকভাবেও অঙ্গীকারবদ্ধ। তা সত্ত্বেও, বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল একতরফা ও বিতর্কিত। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ দেশের ৭০ শতাংশ (৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি) নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। ১৫৩টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, যা ব্যাপক বিতর্ক তৈরি করে। নির্বাচন ঠেকাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীরা। এর ফলে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ভোটারদের মধ্যে তৈরি হয় ভয়-ভীতি, যে কারণে এই নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হার ছিল খুবই কম। মোটকথা, একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয় নির্বাচন কমিশন। অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে যাত্রা করে বাংলাদেশের নির্বাচনী ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
এছাড়া নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় নির্বাচনটি নিয়ে অনেক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। উল্লেখ্য, ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার ফলে নির্বাচনে সারাদেশের মোট ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ৯৭৭ ভোটারের মধ্যে ১৪৭টি আসনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান অবশিষ্ট ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন ভোটার, যদিও ভোট প্রদানের হার ছিল নগণ্য।
উল্লেখ্য, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পেছনে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার যুক্তি তুলে ধরেছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ১৯ শে ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “উনি [খালেদা জিয়া] যদি হরতাল বন্ধ করেন, অবরোধ বন্ধ করেন, মানুষের ওপর জুলুম অত্যাচার বন্ধ করেন, তাহলে ওই নির্বাচনের পর আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা যদি একটি সমঝোতায় আসতে পারি। প্রয়োজনে আমরা আবার পুনরায় নির্বাচন দেব। পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দেব (বিবিসি বাংলা, ০৫ জানুয়ারি ২০১৮)।” কিন্তু নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর সরকারের দিক থেকে আলোচনার আর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচিত বিষয়। এ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়: অত্যন্ত অস্থিতিশীল ও সহিংস এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সংকটের কারণে এই অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়। বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের কারণে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১) ও নবম (২০০৮) জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত সর্বোচ্চ আদালতের একটি সংক্ষিপ্ত আদেশকে ভিত্তি করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ৩০ জুন ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তার জোটভুক্ত দলগুলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তখন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় সরকারের অধীনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেন এবং সেই সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ঘোষণা দেন। তিনি সংবিধান থেকে একচুলও না সরার ঘোষণাও দেন। তিনি সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে বিএনপিকে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া নির্দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে অনড় থাকেন। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বর্জন করে।
সে সময় দেশের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে ঘোষণা দেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা ও উপদেষ্টা পদ থেকে জাতীয় পার্টির সব সদস্যকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন। ০৪ ডিসেম্বর ২০১৩ এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকায় সফররত ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। ‘জাপা নির্বাচনে না গেলে যদি অন্য কোনো দল জয়ী হয়, তাহলে জামায়াতে ইসলামীর উত্থান হবে’ এমন কথা বলে সুজাতা সিং এরশাদকে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য চাপ দেন (প্রথম আলো, ০৫ ডিসেম্বর ২০১৩)। কিন্তু এরশাদ নির্বাচনের ব্যাপারে অনড় থাকেন। কিন্তু রওশন এরশাদ-এর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি গ্রুপ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটাতে সে সময় দেশ-বিদেশের নানা চেষ্টা চলছিল। নির্বাচনের পূর্বে দুই দলের মধ্যে সমঝোতা তৈরির লক্ষ্যে তিন দফায় ঢাকায় আসেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। প্রথমবার ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এবং সর্বশেষ ৬ ডিসেম্বর ২০১৩ পাঁচ দিনের সফরে ঢাকা আসেন তিনি। তাঁর এই সফরের আগে ২৩ আগস্ট ২০১৩ বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ফোন করে সংঘাতের পথ ছেড়ে শান্তিপূর্ণভাবে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানান। তারানকো রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বেশ কয়েকবার বৈঠকে বসেন। একটি মতানৈক্যে পৌঁছার জন্য তারানকোর মধ্যস্থতায় মহাসচিব পর্যায়ে বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু উপরোক্ত সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায়, তথা নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে কোনো সমঝোতা না হওয়ায়, উত্তপ্ত ও সহিংস পরিস্থিতিতেই অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
প্রসঙ্গত, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য সর্বমোট ১ হাজার ১০৭ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেন। মনোনয়নপত্র বাতিল (২৩০ জন) ও প্রত্যাহারের (৩৩৪ জন) পর ১৫৩টি আসনে একজন করে প্রার্থী থাকায় তাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বাকি ১৪৭টি আসনে সর্বমোট ৩৯০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ফলে, ৩০০ নির্বাচনী এলাকার সর্বমোট প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৫৪৩ জন।
১৯৯০ সালের পর প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি দলের কাছেই ইশতেহার ঘোষণা নির্বাচনের একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্ব হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের ১৭ দিন আগে ইশতেহার ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আর দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ এবং দলের সিনিয়র নেতাদের অনুপস্থিতিতেই ইশতেহার ঘোষণা করে জাতীয় পার্টি। এছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি (জেপি) ও তরিকত ফেডারেশন দায়সারাভাবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করে– এমন পর্যবেক্ষণই উঠে আসে ‘সুজন’-এর প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টের অবলম্বনে নির্বাচনের দিনের একটি সাধারণ চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়: “বিএনপিসহ বিরোধী জোটের নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার ঘোষণার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনী সহিংসতায় নির্বাচনের দিন সারাদেশে নিহত হন ১৯ জন। ভোটের দিন এতসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি এর আগে কোনো জাতীয় নির্বাচনে দেখা যায়নি। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর ঘোষিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল। এরপর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত ৪১ দিনে নিহত হন ১২৩ জন। নির্বাচনপূর্ব সহিংসতার দিক থেকেও এই নির্বাচন অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়।”
সাম্প্রতিককালে ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষণ’ ব্যাপারটা একটা আন্তর্জাতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত, পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি নির্বাচনে কারচুপি ও জবরদস্তির প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করে বলেই মনে করা হয়। কিন্তু দেখা যায়, একতরফা নির্বাচন হওয়ায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক ও পর্যবেক্ষক সংস্থার অংশগ্রহণ ছিল খুবই কম। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়ান ফেডারেশন, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া তাদের দেশ থেকে পর্যবেক্ষক পাঠাতে অস্বীকৃতি জানায়। একইভাবে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ যেমন, জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের পর্যবেক্ষক পাঠানো থেকে বিরত থাকে। এমনকি এসব সংস্থা তাদের স্থানীয় প্রতিনিধিকেও নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য কোনো নির্দেশনা প্রেরণ করেনি।
আমরা জানি, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এ লক্ষ্যে কমিশনের অগাধ ক্ষমতা রয়েছে। নির্বাচনী আইনানুযায়ী ও আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, নির্বাচনের সময় সরকারসহ নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত সকলেই কমিশনের আদেশ ও নির্দেশনা মানাসহ অন্যান্য সহযোগিতা করতে বাধ্য। আমরা এও জানি যে, আইনি বিধিবিধান প্রণয়ন করার ক্ষমতা একমাত্র আইনসভার। কিন্তু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের খাতিরে আমাদের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে সেই ক্ষমতাও দিয়েছে। তা সত্ত্বেও সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে ব্যর্থ হয় নির্বাচন কমিশন। ভোটকেন্দ্রে বিরোধী জোটের হামলা ও প্রাণহানি ঠেকাতে যেমন ব্যর্থ হয়, তেমনি কেন্দ্র দখল করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে সরকারি দলের কর্মীদের ব্যালট পেপারে সিল মারার মতো ঘটনাও বন্ধ করতে সক্ষম হয়নি। উপরন্তু ভোটার উপস্থিতি স্মরণাতীত কালের সর্বনিম্ন হওয়ার বিষয়টি কমিশনকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।
প্রতিবেদনের তৃতীয় অধ্যায়ে নির্বাচন পরবর্তী চিত্র বিশেষ নির্বাচনী ফলাফল তুলে ধরা হয় এবং নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করা হয়। এই ভাগে বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষ এই নির্বাচনকে কীভাবে মূল্যায়ন করেছে তা তুলে ধরা হয়।
নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে ভয়-ভীতি থাকায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। বিশেষ করে নারী ও সংখ্যালঘু ভোটারদের উপস্থিতি ছিল খুবই নগণ্য– নির্বাচনের পর এধরনের মন্তব্যই করে দেশীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো। তাদের মতে, বাংলাদেশে উৎসাহ-উদ্দীপনামূলক নির্বাচনের যে সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, উপরোক্ত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা ম্লান হয়েছে।
ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি) জানায়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের পর্যবেক্ষণকৃত এলাকায় ভোট প্রদানের হার ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। ভোটকেন্দ্রের বাইরে মোট ৭২টি সহিংসতার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছে তারা। ‘ব্রতী’-এর পক্ষ থেকে বলা হয়, বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন, অবরোধ, হরতাল, নির্বাচনবিরোধী প্রচারণা আর প্রতিরোধের কারণে কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে। নিরাপত্তা প্রশ্নে নারী ও সংখ্যালঘু ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল সর্বনিম্ন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১০ শতাংশেরও কম ভোট পড়েছে বলে দাবি করে ‘ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স (ফেমা)।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, কানাডা ও কমনওয়েলথ নির্বাচনে সহিংসতা ও ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং ভবিষ্যতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সমঝোতার তাগিদ দেয়।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের প্রতি সমঝোতায় পৌঁছানোর আহ্বান জানান। তবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সেই নির্বাচন হতে হবে বলে শর্ত দেন তিনি। একইসঙ্গে খালেদা জিয়া বর্তমান সরকারের পদত্যাগও দাবি করেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এক বিবৃতিতে জানায়, দেশের জনগণ সরকারের একদলীয় প্রহসনের নির্বাচন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। বাংলাদেশে এমন দূরাবস্থার নির্বাচন অতীতে কখনো হয়নি। এ নির্বাচনের সাথে জনগণের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) জানায়, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার যুক্তি দেখিয়ে ‘একতরফা’, ‘পোকা খাওয়া’ ও ‘তামাশার’ নির্বাচনের ফলে দেশের রাজনৈতিক সংকট দূর হওয়ার বদলে সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার বিপদ সৃষ্টি হয়েছে। দলটি অবিলম্বে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করার দাবি জানায়।
নির্বাচনের পরদিন বাংলাদেশের অধিকাংশ সংবাদপত্রই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কলঙ্কিত, একতরফা ও ভোটারবিহিন নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করে। এছাড়া প্রায় সব সকল সংবাদপত্রেই নির্বাচনে জাট ভোট দেওয়া ও সহিংসতার বিষয়টি উঠে আসে।
‘জাল ভোট, কলঙ্কিত নির্বাচন’ এই শিরোনামে প্রকাশিত প্রথম আলো’র প্রধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে– “প্রথমে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তারপর খালেদা জিয়া। এবার শেখ হাসিনা। গতকাল রোববার তৃতীয়বারের মতো একতরফা নির্বাচন দেখল বাংলাদেশ।”
উল্লেখ্য, সংসদীয় আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একক প্রার্থীকে নির্বাচিত করার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১৯ ধারা কেন সংবিধানপরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ একটি রুল জারি করেন হাইকোর্ট। আদালত যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন ও মতামত গ্রহণ শেষে ১৯ জুন ২০১৪ আদালত উক্ত রিটটি খারিজ করে দেন। রায়ে আদালত বলেন, সংবিধানের সঙ্গে আরপিও’র সংশ্লিষ্ট ধারাটি সাংঘর্ষিক নয়। সংবিধানের সঙ্গে কোনো আইন সরাসরি সাংঘর্ষিক হলে, আদালত তা বাতিল করতে পারেন। আদালতে বলেন, বর্তমান আইনি কাঠামোতে ১৫৩ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই।
প্রতিবেদনের শেষভাগে বলা হয়: “২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে বাংলাদেশে যে অস্বাভাবিকতা ও সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া জরুরি। আশা করি, আমাদের সম্মানিত রাজনীতিবিদরা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন, সংলাপে বসবেন এবং সমঝোতায় উপনীত হবেন। একই সঙ্গে তাঁরা বহুদলীয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আলোকে পরস্পরের সঙ্গে সহাবস্থানের ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করবেন এবং জাতির আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবেন।”