জেনে নিন ফুটবলের নতুন রিভিউ পদ্ধতির আদ্যপান্ত

জেনে নিন ফুটবলের নতুন রিভিউ পদ্ধতির আদ্যপান্ত

খেলায় এক গোলে এগিয়ে পর্তুগাল। ২৪ মিনিটে দিয়েগো কস্তার শুট এবং গোল! সমতায় ফিরল স্পেন। কিন্ত রেফারি দ্বিধান্বিত। গোল হওয়ার আগে কস্তা কনুই দিয়ে পেপেকে আঘাত করে। পেপের মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া এবং খালি চোখে তাই মনে হলেও এখন আর সুযোগ নাই চোখকে বিশ্বাস করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। ভিএআর এ চেক করে রেফারি সিদ্ধান্ত দিলেন গোলের পক্ষে। ইতিহাস রচনা করে বিশ্বকাপে প্রথম বারের মত ব্যবহৃত হল ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি তথা ভিএআর।

ফ্রান্স পর্তুগালের ম্যাচের ৮০ মিনিটের খেলা চলছে। ফকিরকে ফাউল করায় পেরুর ফ্লোরেসকে হলুদ কার্ড দেখায় রেফারি। কিন্ত ফ্লরেস যেন আকাশ থেকে পড়লেন। রেফারি ভিএআর রেফারির সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে দৌড়ে গেল সাইডলাইনে। রিপ্লেতে দেখা গেল ফ্লোরেস একদম নির্দোষ। ফাউল করেছে আকুইনো। তখন হলুদ কার্ডটি আকুইনোকে দেয়া হল।

ব্রাজিল বনাম কোস্টারিকার খেলা গোলশূন্য। ৭৮ মিনিটে অদ্ভূতভাবে ডি-বক্সের ভেতরে পড়ে গেলেন নেইমার। রেফারি বোকা বনে সাথে সাথে পেনাল্টি স্পটের দিকে তাক করল। পেনাল্টি পেয়ে গেল ব্রাজিল। কিন্ত বাধ সাধল ভিএআর। রিপ্লেতে দেখা গেল, নেইমারকে কোন ফাউল করা হয়নি। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন রেফারি।

ওপরের তিনটি ঘটনাই ঘটে এবারের বিশ্বকাপে। ফুটবল খেলার যেকোন মুহূর্তে মোড় ঘুড়িয়ে দিতে পারে রেফারির একটা সিদ্ধান্ত। আর তাইতো রেফারির সিদ্ধান্তকে আরও নির্ভুল করতে নতুন কিন্ত কার্যকর এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হচ্ছে এবারের বিশ্বকাপে। এছাড়াও অষ্ট্রেলিয়ার সাথে ফ্রান্সের পেনাল্টি, কোরিয়ার সাথে সুইডেনের পেনাল্টির ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়েছে এই প্রযুক্তি। উল্লেখ্য, এর আগে গত মৌসুমে এফএ কাপ, জার্মান লিগ এবং ইতালীয় লিগে ভিএআর ব্যবহার করা হয়।

কিন্ত এই ভিএআর প্রযুক্তিটা আসলে কী? কীভাবে কাজ করে? কখন ব্যবহার করা হয়? কারা নিয়ন্ত্রণ করে? এসব নিয়ে অনেকেই এখনো আছেন দোলাচালে। ভক্তরা তো বটেই, অনেক খেলোয়াড়ও ওয়াকিবহাল না এর সম্পূর্ণ ব্যবহার সম্পর্কে। ইংল্যান্ড দলের কাইল ওয়াকার তো বলেই বসলেন, তারা জানেন না কখন এর জন্যে আবেদন করতে হবে। আজকে তাহলে জেনে নেওয়া যাক ভিএআর সম্পর্কে।

ভিএআর

ভিএআর বা ‘ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি’ হচ্ছে ফুটবলের প্রথম ভিডিও প্রযুক্তি। এফএ কাপ, জার্মান ও ইতালীয় লিগে প্রস্ততিমূলকভাবে পরিচালিত হলেও এবার বিশ্বকাপেই পূর্ণাঙ্গ রূপে এর দেখা মিলেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন খেলায় দেখা মেলে ভিএআরের প্রয়োগ। মূল কথায় যাওয়ার আগে ভিএআরের কয়েকটা বৈশিষ্ঠ জেনে নেয়া যাক।

১. এই বিশ্বকাপের ৬৪ খেলার সবগুলোতেই ভিএআর ব্যবহার করা হবে।

২. প্রত্যেক খেলায়ই ভিএআর কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে একটা দল থাকে। এ দলটা মাঠে থাকে না। তারা মস্কোতে অবস্থিত ব্রডকাস্টিং স্টেশনের ‘ভিওআর’ তথা ভিডিও অপারেশন রুম থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করে। এবং মাঠে রিভিউ দেখার জন্যে নির্দিষ্ট ‘আরআরএ’ অর্থাৎ রেফারি রিভিউ এরিয়া রয়েছে।

৩. ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারিরা খেলার সবগুলা সরাসরি ব্রডকাস্ট ক্যামেরা (৩৩টা) পর্যবেক্ষণ করে এবং দু’টি অফসাইড ক্যামেরা থাকে তাদের জন্যে।

৪. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হচ্ছে তারা কোন সিদ্ধান্ত দেন না। তারা শুধুমাত্র রেফারিকে সিদ্ধান্তে পৌছানোর জন্যে প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদান করে থাকেন। অন্তিম সিদ্ধান্তে পৌছানোর দায়িত্ব শুধুমাত্র রেফারির। তাই বলা চলে ক্রিকেটের থার্ড আম্পায়ারের থেকে এদের দায়িত্ব ভিন্ন। ক্রিকেটে থার্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা আছে।

ভিএআর রেফারিদের দলে চার জন করে রেফারি থাকে। একজন ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি এবং তিনজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি। ভিএআর দলের প্রত্যেকটা সদস্যই ফিফার টপ রেফারিদের মধ্য থেকে নেওয়া। এই কাজের জন্যে অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে ফিফা ১৩ জন রেফারি বাছাই করেছে। এছাড়া খেলা পরিচালনার জন্যে যে সকল রেফারিকে নেয়া হয়েছে তারাও পালাক্রমে এই ভিএআর এর দায়িত্বে থাকবেন। প্রত্যেক খেলার আগে ভিএআর দল গঠন করা হয়।

মস্কোর আইবিসি সেন্টার থেকে পরিচালিত হয় পৃুরো রিভিউ সিস্টেমটি
৩৩টি ক্যামেরার চোখ সার্বক্ষণিক খেলোয়াড়দের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে

 

কখন ব্যবহার করা যাবে?

প্রযুক্তি রয়েছে বলেই তা হরহামেশাই ব্যবহৃত হবে না। ভিএআর ব্যবহারেরও কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। ভিএআর শুধুমাত্র তখনই ব্যবহার করা হয় যখন রেফারি ‘গোল’, ‘পেনাল্টি’, ‘লাল কার্ড’ এবং ‘ভুল খেলোয়াড়কে বুক করা’ এই চার ক্ষেত্রে ‘স্পষ্ট ভুল’ করে ফেলেন। এছাড়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভিএআরের সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। একবার খেলা বন্ধ হওয়ার পর আবার শুরু হয়ে গেলে তখন আর ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির সাহায্য নেয়া যাবে না। কিন্ত এ ক্ষেত্রে খেলা বন্ধ হওয়ার পরে রেফারি যতক্ষণ খুশি সময় নিতে পারবেন।

গোল : সাধারণত গোল হওয়ার পরে ক্লোজ অফসাইডের সিদ্ধান্তকে পূণর্বিবেচনা করা হয়। কিন্ত অফসাইডের ক্ষেত্রে কোন ‘স্পষ্ট ভুল’ হওয়ার সুযোগ নেই। একটা খেলোয়াড় হয় অফসাইড হবে নাহয় অনসাইড। কারণ এক ইঞ্চির জন্যে অফসাইড হলেও গোল হবে না। তাই অফসাইড অবস্থায় কোন গোল হয়ে গেলে সেটা ভিএআরের সাহায্যে বাতিল করা যাবে। আবার বল আউট হওয়ার পরও খেলা চালিয়ে গোল হলে সেই গোলও বাতিল করা যাবে।

এছাড়া গোলের পূর্বে কোন ফাউল বা জার্সি ধরে রাখার মত ফাউল হলে সেক্ষত্রে গোলের সিদ্ধান্ত বাতিল হতে পারে। যেমনটা দেখা গিয়েছিল কস্তার প্রথম গোলের ক্ষেত্রে। পেপে-কে ফাউল করা হয়েছিল কিনা সেটা পর্যবেক্ষণ করা হয়।

পেনাল্টি : সন্দেহাতীত ভাবে সবচেয়ে সমস্যাজনক এরিয়া হচ্ছে পেনাল্টি বক্স। যেকোন মুহূর্তে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে একটা ভুল পেনাল্টির সিদ্ধান্ত বা রেফারির ভুলে কোন দলের পেনাল্টি ছুটেও যেতে পারে। এক্ষেত্রে স্পষ্ট ভুল সিদ্ধান্ত এড়াতে ভিএআর মুখ্য ভুমিকা রাখবে। ব্রাজিল বনাম কোস্টারিকার খেলায় ব্রাজিলের পেনাল্টি নাকচের ক্ষেত্রে ভিএআর ভূমিকা রাখে।

এক্ষেত্রে বক্সের বাইরে ফাউলের ফলে কোন পেনাল্টির সিদ্ধান্তও বাতিল হতে পারে অথবা অফসাইড হয়েও খেলা চলার পর যদি পেনাল্টি দেয়া হয়, সেক্ষেত্রেও ভিএআর পেনাল্টির সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারে।

সরাসরি লাল কার্ড : অনেক ক্ষেত্রেই খেলোয়াড়দের হিংসাত্মক আচরণ অথবা মারাত্মক ট্যাকেল গুলো রেফারির নজর এড়িয়ে যায়। সেক্ষেত্রে লাল কার্ড দেখানোর জন্যে ভিএআরের সাহায্যে খেলোয়াড়দের দণ্ডিত করা যাবে। কিন্ত হলুদ কার্ড বা দ্বিতীয় হলুদের ক্ষেত্রে ভিএআর সাহায্য করবে না।

ভুল খেলোয়াড়কে হলুদ কার্ড : খেলোয়াড়দেরকে লাল কার্ড দেখিয়ে বের করে দেয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। অথবা ভুল খেলোয়াড়কে হলুদ কার্ড দেয়া; যেমন ফ্রান্স বনাম পেরুর খেলায় আকুইনোর জায়গায় প্রথমে ফ্লোরেসকে বুক করা হয়েছিল। কোন খেলোয়াড়ের সাথে এরকম অবিচার হলে ভিএআরের সাহায্যে ভুল শোধরানো যাবে।

উপরোক্ত এই চার ক্ষেত্রে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি, খেলায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে।

ভিওআর (ভিডিও অপারেশন রুম) Image: FIFA/FIFA via Getty Images

ভিএআর ব্যবহারের পক্ষে এবং বিপক্ষে উভয় ক্ষেত্রেই আলোচনা সমালোচনা রয়েছে। যেমন, যেসব স্টেডিয়ামে জায়ান্ট স্ক্রিন নাই সেই সকল স্টেডিয়ামে ভক্তরা বুঝতে পারেন না কখন ভিএআরের সাহায্য নেয়া হচ্ছে বা কেন সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হচ্ছে। এছাড়া রিভিউয়ের কারণে গোল হওয়ার পর খেলোড়দের যেই স্বতঃস্ফুর্ত উচ্ছাস এবং উদযাপন সেটা থেমে যায় রিভিউ না হওয়া পর্যন্ত। তাছাড়া অনেক খেলায় ভিএআর ব্যবহারের কারণে দুই অর্ধেই অতিরিক্ত এক্সট্রা টাইম দিতে হয়। কিন্ত এক্ষত্রে ভিএআর প্রযুক্তির পক্ষে ফিফার যুক্তিও রয়েছে। প্রায় এক হাজার খেলায় পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে খেলায় রেফারিদের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার হার ছিল ৯৩ শতাংশ, যা ভিএআর এর সহযোগিতায় ৯৯ শতাংশ করা সম্ভব।