গ্রীষ্ম শেষ হয়ে বর্ষাকাল এলও তা যেন কাগজে কলমে। বৃষ্টির দেখা মিলছে না দিনের পর দিন। দুপুরের প্রচণ্ড দাবদাহে মানুষ মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। হতে পারে হিটস্ট্রোকও। কারণ গরমের বিপজ্জনক সমস্যা হলো হিটস্ট্রোক। এতে বৃদ্ধ ও শিশু-কিশোররা আক্রান্ত হয় বেশি। তবে সব বয়সীরই আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সাধারণত প্রচণ্ড তাপদাহে শরীরের তাপমাত্রা আকস্মিক বেড়ে গিয়ে হিটস্ট্রোক হয়। এ কারণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। প্রচণ্ড গরমে শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে হিটস্ট্রোক হয়। সাধারণত কৃষক, রিকশাচালক, বাসচালক, গার্মেন্ট শ্রমিক, শিশু ও দৌড়বিদদের হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি থাকে।
বর্তমানে ঢাকাসহ সারা দেশে তাপপ্রবাহ বেড়েই যাচ্ছে। বর্তমানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে। তাপমাত্রা এ বছর ৪০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্তও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এত গরমে বিভিন্ন অসুখ-বিসুখও বাড়তে পারে। এ সময় অধিক তাপপ্রবাহে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। তা মাত্রা অতিরিক্ত হলে মস্তিষ্কে চাপ পড়ে এবং হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যায় মানুষ। তাই এই গরমে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে সুস্থ থাকতে হবে।
এ বছরের মে মাসে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে এক থেকে দুটি তীব্র এবং অন্যত্র দুই থেকে তিনটি মৃদু বা মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এই গরমে ‘জবান’-এর পাঠকদের জন্য হিটস্ট্রোক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল-
গরমকালের মারাত্মক স্বাস্থ্যগত সমস্যার নাম হিটস্ট্রোক। চিকিৎসাশাস্ত্র অনুযায়ী স্বাভাবিক অবস্থায় রক্ত দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। কোনো কারণে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ত্বকের রক্তনালী প্রসারিত হয় এবং অতিরিক্ত তাপ পরিবেশে ছড়িয়ে দেয়। প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্র পরিবেশে অনেকক্ষণ থাকলে বা পরিশ্রম করলে তাপ নিয়ন্ত্রণ আর সম্ভব হয় না। এতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বিপদসীমা ছাড়িয়ে গিয়ে হিটস্ট্রোক দেখা দেয়। প্রচণ্ড গরমে ও আর্দ্রতায় যে কারোরই হিটস্ট্রোক হতে পারে। এ ছাড়া বয়স্ক ব্যক্তিরা প্রায়ই অন্যান্য রোগে ভুগে থাকেন কিংবা নানান ওষুধ সেবন করেন যা হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। যারা দিনের বেলায় প্রচণ্ড রোদে কায়িক পরিশ্রম করেন তাদের ঝুঁকি বেশি। শরীরে পানিস্বল্পতা হলেও হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
তাপ বাড়তে থাকলে শিরা-উপশিরাগুলো ফুলে উঠে ত্বক পর্যন্ত রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দেয়। এ সময় ঘাম বেড়ে যায়। ত্বকের লোমকূপগুলো দিয়ে ঘাম বেরিয়ে গিয়ে শরীরের উপরিভাগকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা হয়। শরীর থেকে লবণ ও পানি বের হয়ে যাওয়ার কারণে পেশিগুলো কর্মক্ষমতা হারাতে থাকে। এ থেকে পেশির বৈকল্য ও দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। মাত্র দশ মিনিটেই শরীরের তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যেতে পারে। এ অবস্থায় প্রত্যঙ্গগুলো কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহে হিটস্ট্রোকের নানান লক্ষণ দেখা দেয়। প্রাথমিকভাবে মাংসপেশিতে ব্যথা হয়, শরীর দুর্বল লাগে ও প্রচণ্ড পিপাসা পায়। এরপর দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, মাথা ব্যথা ও ঝিমঝিম করা, বমি বমি ভাব, অসংলগ্ন আচরণ ইত্যাদি দেখা দেয়। এ দু’ক্ষেত্রেই শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ঠিক থাকে এবং শরীর অত্যন্ত ঘামতে থাকে। এ অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়া হলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বিপজ্জনক লক্ষণগুলো হল শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যাওয়া, ঘাম বন্ধ হয়ে যাওয়া, ত্বক শুষ্ক ও লালচে হওযা, নিঃশ্বাস দ্রুত হয়, নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হয়, রক্তচাপ কমে যায়। হাত পা কাঁপা, শরীরে খিঁচুনি, মাথা ঝিমঝিম করা, অস্বাভাবিক আচরণ, হ্যালুসিনেশন, অসংলগ্নতা, কোনো সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা ও অস্থিরতা, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং রোগী শকেও চলে যায়, এমনকি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
হিটস্ট্রোক প্রতিরোধে গরমের সময় কিছু সতর্কতা মেনে চললে এ বিপদ থেকে বেঁচে থাকা যায়। এগুলো হল প্রথমত রোদে না যাওয়া। যথাসম্ভব ঘরের ভেতরে বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকা। বাইরে যেতে হলে মাথার জন্য চওড়া কিনারাযুক্ত টুপি, ক্যাপ বা ছাতা ব্যবহার। হালকা, ঢিলেঢালা পোশাক পরা। কাপড় সাদা বা হালকা রঙের হতে হবে। সুতি কাপড় পরা। প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল পান করা। মনে রাখতে হবে, গরমে ঘামের সঙ্গে পানি ও লবণ দুই-ই বের হয়ে যায়। তাই পানির সঙ্গে সঙ্গে লবণযুক্ত পানীয়- খাবার স্যালাইন, ফলের রস, লাচ্ছি ইত্যাদি পান করতে হবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারী পানীয়- চা ও কফি যথাসম্ভব কম পান করা উচিত। রোদের মধ্যে শ্রমসাধ্য কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে তা প্রতিরোধ সম্ভব। এক্ষেত্রে দ্রুত শীতল কোনো স্থানে চলে যেতে হবে। ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছতে হবে। কাঁধে, বগলে ও কুচকিতে বরফ দিলে ভালো হয়। শরীরের কাপড় যথাসম্ভব খুলে দিতে হবে। গোসল করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। প্রচুর পানি ও খাবার স্যালাইন পান করতে হবে। চা বা কফি পান করা যাবে না। এতেও না কমলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। প্রয়োজন হলে কৃত্রিমভাবে নিঃশ্বাস ও নাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করতে হতে পারে।
সবাইকে মনে রাখতে হবে, হিটস্ট্রোক স্বাভাবিক ও সুস্থ মানুষের অতি অল্প সময়ে মৃত্যু ঘটায়। তাই প্রচুর পানি, জুস পান করতে হবে। কাজের ফাঁকে ঘন ঘন বিশ্রাম নেয়া জরুরি। স্কুলের ছাত্রছাত্রী ও শিশুরা প্রখর তাপে যাতে বাইরে খেলাধুলা না করে সেদিকেও সবার দৃষ্টি রাখতে হবে। এসব বিষয় জেনে সতর্কতা অবলম্বন করলে হিটস্ট্রোক থেকে বেঁচে যাওয়া সম্ভব। তাই সচেতনাই পারে হিটস্ট্রোক থেকে দূরে রাখতে।