মুক্কাবাজ : খেলার দুনিয়ায় শুধু বীরত্ব নয় কাপুরুষতাও থাকে

মুক্কাবাজ : খেলার দুনিয়ায় শুধু বীরত্ব নয় কাপুরুষতাও থাকে

অনুরাগ কাশ্যপ মানেই অন্যরকম কিছু। ভারতীয় সিনেমার পুরো রীতির বিরুদ্ধে গিয়েও তিনি তৈরি করতে পারেন বিশ্বমানের সিনেমা। ভারতীয় সমাজের খুঁটিনাটি এত সূক্ষ্মভাবে তিনি তুলে ধরেন যে তার সিনেমা হয়ে ওঠে চলমান বাস্তবতার দলিল।

‘মুক্কাবাজ’-এ অনুরাগ কাশ্যপ যেন নিজের আরও একটি ধারা উম্মোচন করলেন। এই ধাঁচের সিনেমা তিনি এর আগে তৈরি করেননি। সম্ভবত ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসেই খেলা নিয়ে এই ধারার কোন সিনেমা নাই। সব সময় খেলার মধ্যে বীরত্ব, জাতীয়তাবাদ এমন বিষয়ই দেখানো হয়। কিন্তু এর ভেতর যে কাপুরুষতা, যে অন্যায় ও অন্ধকার দিকগুলো রয়েছে তা নিয়ে এই প্রথম আমরা দেখলাম-মুক্কাবাজ। এক কথায় আরো একটি অসাধারণ কাজ হয়েছে এটা।

অ্যাকশন, লাভ, রোমান্স, কমেডি, স্যাটায়ার-এর একদম ফুল প্যাকেজ। তবে এটাকে একটা নির্দিষ্ট জনরায় ফেলতে হলে আমি ব্ল্যাক কমেডি সিলেক্ট করবো। মানে, পুরো মুভি জুড়ে আপনি দেখবেন হাসি ইয়ার্কি সব চলছে, সিরিয়াস সিনের ব্যাকগ্রাউন্ডে ফানি মিউজিক চলছে কিন্তু এসবের আড়ালে যে জিনিসটা আপনি ফিল করবেন সেটা হলো ভারতীয় সমাজের চিরায়ত বর্ণবাদী প্রথার নিষ্ঠুরতা, মিডলক্লাস লাইফের ক্রাইসিস, আপার ক্লাসদের গুন্ডামি এসবের নির্মম চিত্র। জাতপাতের গ্যাঁড়াকলে পড়ে একটি প্রতিভা ধ্বংসের নির্মম বাস্তব গল্প এটি, সুতরাং এটাকে ফিকশন হিসেবে নিলে এই মুভির পুরো আবেদনটাই বরবাদ হয়ে যাবে।

‘মুক্কাবাজ’ চলচ্চিত্রের পরিচালক অনুরাগ ক্যাশপ

অনুরাগ কাশ্যপের সিনেমার আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো সিনেমার ডায়লগ। ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’ এর সংলাপ যেমন এখনো সবার মুখে মুখে আছে (যারা দেখেছেন) তেমনি এই মুভির অনেক সংলাপও দীর্ঘদিন মনে রাখার মতো। স্থানীয় বাকভঙ্গিকে হুবহু ব্যবহার করে সংলাপগুলো চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাছাড়া স্ক্রিনপ্লে, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, ডিরেকশন সবই চমৎকার।

অনুরাগের আরো একটা ভালো ব্যাপার হল উনি গঁৎবাধা বলিউডের স্টাইল ফলো না করে প্রায় প্রতিটা সিনেমাতেই নতুনদের সুযোগ করে দেন। একদম অচেনা চরিত্র বড় বড় রোলে কাস্ট করেন। এটা যে কত বড় ঝুঁকি ব্যবসার দিক থেকে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু অনুরাগের এটাই স্টাইল। নো বিগ স্টার।

এই ছবির প্রধান নায়িকা জয়া হোসেন এর প্রথম সিনেমা এটি, তার কাজ বেশ ভাল হয়েছে। খুবই ন্যাচারাল। চরিত্রের জন্য যতটা সুন্দর হওয়া দরকার তিনি ঠিক তাই। আর প্রধান চরিত্র রাবি কিশান, এক কথায়- এই ছেলেটা মারাত্মক অভিনয় করেছে। অনেকদিন ছোট ছোট রোলের পর প্রথম একটা লিড রোলে পেয়েছেন আর সেটাতে ফাটিয়ে দিয়েছেন বলা যায়। তার আরো কাজ আশা করি।

এত কিছুর ভিড়ে এইখানে অবশ্যই প্রেম-ভালোবাসা ব্যাপারটাকে ছোট করে দেখলে ভুল হবে। একজন বোবা মেয়ের প্রেমে পড়ে একজন সম্ভাব্য ভালো বক্সার তার ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছে। আহা ভালোবাসা তুমি বেঁচে থাকো এইভাবে চিরকাল। প্রেমের শক্তিটা খুব বাস্তবিকভাবে এখানে দেখা যায়। সিনেমাটিক রুপে প্রেমতো কতই দেখি। এটাই অনুরাগের মুন্সিয়ানা।

মূল স্রোতে গা না ভাসিয়ে অনুরাগরা এইখানে এক প্রকার জিহাদ করে যাচ্ছেন বলা যায়। অবশ্যই নিজের অতীত অভিজ্ঞতাও মনে হয়। তাকে নস্টালজিক করে দেয় কখনও কখনও। তাই একদম গ্রাম বা প্রান্ত থেকে উঠে আসা তরুণদের ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা করে দেওয়ার জন্য অনুরাগকে বাড়তি ক্রেডিট দিতেই হয়।

‘মুক্কাবাজ’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে জয়া হোসেন ও রাবি কিশান

কম টাকায়, এত ক্রিয়েটিভ কাজ উপহার দেওয়াটা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। এইরকম আরো ডজনখানেক পরিচালক থাকলে প্রচলিত গার্বেজ নির্মাণ থেকে বের হয়ে আসতে পারবে বলিউড। যৌনতা আর প্রোডাক্টের মার্কেটিং ছাড়াও যে সিনেমা বানানো যায় অনুরাগ তার উদাহরণ।

বর্তমান সমাজে সিনেমার প্রভাব বেশ সুদুরপ্রসারী। সুতরাং সামাজিক প্রচলিত কুপ্রথা বা এইসব নষ্ট সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে একে ব্যবহার করা যায়। আমাদের সমস্যা হল- আমাদের দেশের রাষ্ট্র সমাজের অনৈতিকতাকে প্রশ্ন করার মতো ছবি বানানোর কেউ নেই এখানে। তারা এক মুক্তিযোদ্ধা আর নারী স্বাধীনতা টাইপের বস্তাপঁচা আইডিয়াতে আটকে আছে। এর বাইরে যেতে পারছে না। এটা দুঃখজনক, কারণ আপনার হাতের কাছে এইসব শক্তিশালী মাধ্যমকে যদি এই সময় পলিটিক্যাল বা সোশ্যাল চেঞ্জ এর জন্য ব্যবহার করতে না পারেন তাহলে আর করবেন কখন?

অবশ্য এই ক্ষেত্রে আমাদের সেন্সর বোর্ড কতটা উদার হতে পারবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে কিন্তু আগে তো কাজ শুরু করতে হবে। তারপর বাকি কথা। শুনেছি রানা প্লাজা নিয়ে নির্মিত ছবিটা সেন্সর ছাড়পত্র পাচ্ছে না এখনো। তবুও চেষ্টা অব্যাহত রাখার অনুরোধ থাকবে। মুভির একদম শেষে দেখা যায় দুইটা লাইন। চীনের পর ভারতে সবচাইতে বেশি মুষ্ঠিযোদ্ধার জন্ম হলেও তারা এখনো এই খেলায় নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে পারেনি।

আসলে এটা হলো স্যাড রিয়েলিটি কিভাবে নোংরা পলিটিক্যাল সিস্টেম এবং বর্ণবাদী ব্যবস্থা গরিব বা প্রান্তে জন্ম নেওয়া প্রতিভাকে ধবংস করে দিচ্ছে, জীবনকে কঠিন করে দিচ্ছে, তার সরল উপস্থাপন এই সিনেমা। সব মিলিয়ে দারুণ একটি কাজ। স্যালুট অনুরাগ কাশ্যপ।