মানুষের শরীরের নানান নীরব লক্ষণ অনেক সময় এড়িয়ে যাওয়া হয় অর্থাৎ অবহেলা করা হয়। অন্যদিকে জটিল রোগের প্রাথমিক লক্ষণও অনেকে গুরুত্বের সঙ্গে নেন না। তা পরে তাদের জন্য বড় ধরনের আশঙ্কা কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই শরীরের আকস্মিক কোনো পরিবর্তন কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়।
বর্তমানে লক্ষণ দেখে রোগ অনেকাংশে নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে। যে কোনো লক্ষণের চিকিৎসা নিতে দেরি করলে রোগ জটিল আকার ধারণ করে। তাই যে কোনো লক্ষণগুলো দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবহেলা করা যাবে না তা হল–
অতিরিক্ত ওজন হ্রাস : ওজন কমাতে তরুণরা ডায়েটিংয়ের নামে ভুল খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলেন। অতিরিক্ত ওজন হ্রাস রোগের লক্ষণ হতে পারে। ছয় মাসের মধ্যে যদি আগের ওজনের ১০ শতাংশ কমে তাহলে এটি আমলে নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। ওজন বিভিন্ন কারণে কমতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো হল থাইরয়েড গ্রন্থির অতিরিক্ত হরমোন ক্ষরণ, ক্যানসার, যক্ষ্মা, পাকস্থলীর সমস্যা, ডায়াবেটিস, শরীরে পুষ্টির উপাদান শোষিত না হওয়া।
দীর্ঘমেয়াদি জ্বর : জ্বর রোগের উপসর্গ মাত্র। শরীরের কোনো অংশে ইনফেকশন থাকলে জ্বর বাড়ে। তবে দীর্ঘমেয়াদি জ্বর বিভিন্ন কারণে হতে পারে। অল্প জ্বর সন্ধ্যার দিকে বাড়লে মনে করা হয় যক্ষ্মা। মাসের বেশিদিন ধরে জ্বর থাকলে হতে পারে এইডস। প্রচণ্ড জ্বর হতে পারে ভাইরাস সংক্রমণে। জ্বর প্রথমে অল্প, ক্রমেই বাড়ে টাইফয়েডে। কাঁপুনিসহ প্রচণ্ড জ্বর হতে পারে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে। জ্বর যদি এক সপ্তাহের মধ্যে ভাল না হয় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
শ্বাসকষ্ট : সাধারণত শ্বাসতন্ত্রের সমস্যার জন্য শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। এছাড়া হৃৎপিণ্ড ও অন্যান্য কারণে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। শ্বাসকষ্ট বেশি হলে, রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে, হাঁটাচলা করতে না পারলে, শ্বাসের সঙ্গে শব্দ হলে, হাঁসফাঁস লাগলে, শ্বাস টানার হার বেড়ে গেলে দেরি না করে চিকিৎসা নিতে হবে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময় বা ভারি কোনো কাজে শ্বাসকষ্ট হলে এবং বুকে চাপ অনুভব করলে মনে করা হয় এটি হৃৎপিণ্ডের রোগ।
মলত্যাগে পরিবর্তন : বার বার পাতলা পায়খানা হলে (২৪ ঘণ্টায় ৩ বার বা এরও বেশি) এটিকে ডায়রিয়া বলে। সপ্তাহে তিনবারের কম মলত্যাগকে কোষ্ঠকাঠিন্য বলে। মলের পরিবর্তন দেখে রোগ নির্ণয় করা যায়। মলের সঙ্গে রক্ত গেলে, মল আলকাতরার মতো কালো-দুর্গন্ধযুক্ত হলে, ডায়রিয়া এক সপ্তাহ ও কোষ্ঠকাঠিন্য ৩ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে হলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কোলন ক্যানসার, রেক্টাল ক্যানসার, এনালফিশার, হেমোরয়েড, ইনফ্লামেটরি বাওল রোগসহ অনেক কারণেই এ লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে।
হঠাৎ প্রচণ্ড মাথা ব্যথা : এমন মাথা ব্যথা যার সঙ্গে আগের মাথা ব্যথার তুলনা করা যায় না। তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। মাথা ব্যথার সঙ্গে জ্বর, আবোল-তাবোল কথা বলা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা না থাকা এবং ৫৫ বছরের পর নতুন ধরনের মাথা ব্যথা অবহেলা করা উচিত নয়। এ ধরনের মাথা ব্যথা হতে পারে মাথায় রক্তক্ষরণ, মাথার খুলির রক্তনালিতে প্রদাহ, মস্তিষ্কে টিউমার হলে।
হঠাৎ অবশ হয়ে যাওয়া : স্বাভাবিক কাজকর্মের সময় হঠাৎ করে শরীরের কোনো একপাশ অবশ হয়ে যাচ্ছে, কথা বলতে পারছেন না বা কথা জড়িয়ে যাচ্ছে কিংবা চোখে ঠিকমতো দেখতে পারছেন না অথবা ঝাপসা দেখছেন এবং কিছু সময় পর (২৪ ঘণ্টার মধ্যে) সব সমস্যা ভালো হয়ে গেল। আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। মনে করছেন, এটি কোনো সমস্যা নয়। আসলে তা নয়, এটি হল মিনিস্ট্রোক।
হজমে সমস্যা : অল্প খেলেই পেট ভরে যাওয়া, এর সঙ্গে ওজন কমে গেলে, ৪০ বছর বয়সের পর হজমের সমস্যা, ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব এবং আগে থেকে আলসার থাকলে চিকিৎসা নিতে হবে।
ক্রমাগত কাশি : একটু-আধটু কাশি হওয়াকে অনেকেই পাত্তা দেন না। যদি টানা কাশি থাকা শুরু করে তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। কারন ক্রমাগত এবং কাশি হতে পারে ব্লাড ক্যানসার, লিম্ফোমা, লিউকোমিয়ার লক্ষণ।
মেরুদণ্ডে ব্যথা : ঠাণ্ডা লেগেও অনেকের মেরুদণ্ডে ব্যথা হয়। আবার টানা বসে থাকলে পিঠ না মেরুদণ্ড ব্যথা হয় বলে আমরা মেরুদণ্ড ব্যথাকে অনেকেই সাধারণভাবে নেন। কিন্তু টানা অতিরিক্ত ব্যথা হওয়া ভালো লক্ষণ নয়। এটিও হতে পারে ক্যানসারের লক্ষণ।
খুব দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়া : অনেক সময় কাজের ব্যস্ততা কিংবা কাজের মধ্যে থাকলে অনেকেই ক্লান্তি বোধ করেন। তাই মাঝে মধ্যেই ক্লান্ত থাকলেও কাজ করেন। অনেক সময় বিশ্রাম নেয়ার পরও ক্লান্তি দূর হয় না বলে ভাবা হয় পরিমিত বিশ্রাম হচ্ছে না। এটিও অবহেলা করা যাবে না।
চামড়ার নিচে ফোলা বা দলা ভাব : অনেক সময় শরীরের চামড়ার নিচে গুটি গুটি হয়ে ফুলে ওঠা বা দলা পাকানো গোটার মতো অনুভব করা। এটি গুরুতর কোনো রোগ। ওই গুটিগুলো বুক বা বুকের আশপাশে অথবা যৌনাঙ্গে দেখা দিলে ক্যানসারের লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়। অবশ্য হাত-পায়ে এটি দেখা দিলে ভয়ের কিছু নেই।
শরীরের চামড়ায় পরিবর্তন : চামড়ায় ছোট ছোট দানা হওয়া কিংবা শরীরের চামড়ার মাঝে মাঝে রঙের পরিবর্তন, কোনো কারণ ছাড়াই জখমের মতো দাগ হওয়া লক্ষণগুলো ভালো নয়। তাই এসব দাগ একবারেই অবহেলার নয়।
এছাড়া স্কিন র্যাশ যা চুলকায়, হঠাৎ রেগে যাওয়া, শরীরের কোনো স্থান থেকে হঠাৎ রক্তক্ষরণ, নাক ডাকা, দাঁতের সমস্যা হওয়া, দীর্ঘস্থায়ী খুশখুশে কাশি, বার বার মলত্যাগ, শারীরিক ক্ষমতা হ্রাস, মনে রাখতে না পারা দেখা দেয়া মাত্রই চিকিৎসা নিতে হবে।