জীবনের কতগুলো ঈদে সিনেমা হলে সিনেমা দেখেছিলাম তা হিসাব করে বলতে পারবো না। শুধু এইটুকু বলতে পারি যে জীবনের বেশ লম্বা একটি সময় ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত সবগুলো সিনেমা হলে গিয়ে না দেখে শান্তি পেতাম না। ঈদের ৭ দিন আগ থেকে চলতো আমাদের সিনেমা দেখার প্রস্তুতি যা শেষ হতো চাঁদ রাতে বন্ধুদের নিয়ে পুরো সিলেট শহরের সবগুলো সিনেমা হল ঘুরে ঘুরে পোস্টার দেখে দেখে। সব সিনেমা হল ঘোরা শেষ করে আমরা পাড়ার খেলার মাঠের কোনায় সবাই হাজির হতাম। সেখানে বসেই সিদ্ধান্ত নিতাম কোন সিনেমা দিয়ে আমাদের ঈদের আনন্দ শুরু করবো তা । পরিবারের সাথে সিনেমা হলে যাওয়ার যে অভ্যাসটা ছোটবেলা থেকে গড়ে উঠেছিল সেটা নেশার মতো হয়ে যায় কিশোর ও তারুণ্যর দিনগুলোতে।
সেই সময় ঈদে মুক্তি পেতো সেরা সব পরিচালকদের নির্মিত তারকাবহুল একাধিক সিনেমা। আলমগীর, রাজ্জাক, জসিম, রুবেল, সোহেল রানা, ইলিয়াস কাঞ্চন, মান্না, সালমান শাহ, ওমর সানী কার সিনেমা রেখে কারটা আগে দেখবো সেটা ছিল মধুর এক সমস্যা । রোমান্টিক, সোশ্যাল অ্যাকশন, ফ্যামিলি ড্রামা, ফোক ফ্যান্টাসি সব ধরনের গল্পের সিনেমা মুক্তি পেতো । পোস্টারগুলো থাকতো এমন দারুন দারুন যে ইচ্ছে করতো সবগুলো এক সাথে এক দিনেই দেখে শেষ করে ফেলি । ঈদে এমন সব পরিচালকদের সিনেমা একসাথে মুক্তি পেতো যে যাদের নাম দিয়েই সিনেমা চলে সেই সিনেমায় নায়ক নায়িকা কার প্রিয় আর কার অপ্রিয় সেটা মুখ্য বিষয় না ,অমুক পরিচালকের ছবি দেখতেই হবে। এ জে মিন্টু, শিবলি সাদিক, শফি বিক্রমপুরি , কামাল আহমেদ, মোতালেব হোসেন, শহিদুল ইসলাম খোকন, মাসুদ পারভেজ, কাজী হায়াত, শাহ আলম কিরন, সোহানুর রহমান সোহান, বাদল খন্দকার, দিলিপ সোম, তজাম্মেল হক বকুল, এ জে রানা, দিলিপ বিশ্বাস, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু , দেওয়ান নজরুল, মতিন রহমান , মমতাজুর রহমান আকবর এর মতো মাল্টিস্টার সিনেমার সব পরিচালকদের সিনেমা মুক্তি পেতো ঈদে। মজার ব্যাপার হলো এ জে মিন্টু, মোতালেব হোসেন, কাজী হায়াৎ, শহীদুল ইসলাম খোকন, দেওয়ান নজরুল, মাসুদ পারভেজ , মমতাজুর রহমান আকবর, এ জে রানা’দের ছবিতে ২ বা ততোধিক নায়ক থাকলেও ১ম/ প্রধান নায়ক কে হবে সেটা মুখস্থ আগে থেকেই বলে দেয়া যেতো । এ জে মিন্টুর সিনেমায় আলমগীর, মোতালেব হোসেন ও দেওয়ান নজরুলের জসিম , মমতাজুর রহমান আকবর ও কাজী হায়াতের মান্না, শহিদুল ইসলাম খোকন ও এ জে রানা’র রুবেল , মাসুদ পারভেজের নিজেই অর্থাৎ সোহেল রানা, তোজাম্মেল হক বকুলের ঈদের সিনেমায় ইলিয়াস কাঞ্চন থাকবেই এটা নিশ্চিত। কখনও কখনও ঈদের চলচ্চিত্র দিয়ে যেমন কোন পরিচালকের অভিষেক হতো ঠিক তেমনি কোন কোন তারকারও অভিষেক হতো ঈদের সিনেমা দিয়ে। উত্তম আকাশ ‘’ মুক্তির সংগ্রাম ‘’ দিয়ে পরিচালক হিসেবে এসেছিলেন ঠিক তেমনি রুবেল [ লড়াকু] সালমান শাহ, মৌসুমি [কেয়ামত থেকে কেয়ামত] রিয়াজ [ বাংলার নায়ক ] , সোনিয়া [ প্রেমশক্তি] এর মতো নতুন যুগের তারকাদের পেয়েছিলাম ঈদের সিনেমা দিয়েই ।
ঈদের দিন সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে সাধারণত আমরা তালতলা [ স্থানীয়দের কাছে তেলিহাওর নামে পরিচিত ] এলাকাটা বেছে নিতাম । কারণ ঐ এলাকায় রাস্তার একই ধারে পাশাপাশি ৩ টি সিনেমা হল ছিল [ নন্দিতা, অবকাশ ও দিলশাদ] যা শহরের অন্য কোন সিনেমা হলের পাশে এমন সুবিধা ছিলো না। তেলিহাওরে বেছে নেয়ার প্রধান কারণ ছিলো টিকেটের অস্বাভাবিক মূল্য অর্থাৎ কোন একটি হলে টিকেটের দাম একেবারে নাগালের বাহিরে চলে গেলে তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত বদল করে ঐ একই সময়ে অন্য কোন সিনেমা দেখতে যে কোন একটি হলে যেন ঢুকে পরতে পারি তা। এক ঈদের দিন তেলিহাওর এলাকার নন্দিতা সিনেমা হলে মনোয়ার খোকনের ‘’ঘাত প্রতিঘাত’’ সিনেমাটি দেখতে গিয়েছিলাম । পাশের দিলশাদে চলছিল ‘’স্বপ্নের ঠিকানা ‘’ এবং অবকাশে চলছিল ‘’বিশ্বনেত্রী’’ । সবগুলো হলেই কালোবাজারিদের দৌরাত্ন চলছিল । তিন গ্রুপে ভাগ হয়ে তিনটি হলেই আমরা খোঁজ নিয়ে যা বুঝলাম যে ১ম শ্রেণী [ সিনেমা হলের একদম নিচতলায়] ছাড়া কোন হলে সিনেমা দেখতে পারবো না। সবার পকেট ঝেড়েও একসাথে ৯টি ডিসির টিকেটের দাম হবে না। তখন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যে নিচতলায় দেখতে হলে নন্দিতাই বেস্ট । কারণ নন্দিতা সিনেমা হল ছিলো সিলেটের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও আধুনিক। জীবনে সেই প্রথম ১ম শ্রেণীতে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা হলো সবার। হলের ভেতর ঢুকেও শান্তি পাচ্ছিলাম না। কারণ এতো এতো দর্শক যে কারো সিটের পাশে আধা ইঞ্চিও জায়গা খালি নেই , সবাই সবার গাঁ ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছে। পুরোটা সময় সিনেমার পর্দার দিকে ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে থাকতে হবে। মাথার এতো উপরে ফ্যান যে পর্যাপ্ত পরিমানে ফ্যান থাকা সত্ত্বেও গায়ে বাতাস লাগছে না মানুষের ভিড়ের কারণে। সিনেমা দেখার ফাঁকে একসময় গরমে অস্থির হয়ে গায়ের টিশার্ট খুলে সেন্ডো গেঞ্জি পরে সিনেমা দেখতে লাগলাম। গরম আর সিগারেটের ধোঁয়ায় অন্ধকার করা নেশা নেশা পরিবেশ । এমন পরিবেশেই পুরোটা সময় ঘাত প্রতিঘাত সিনেমাটা আমরা উপভোগ করলাম । যতক্ষণ সিনেমাটা চলছিল ততক্ষণ পারিপার্শ্বিক অবস্থার দিকে কারো খেয়ালই ছিলো না। কোন গরম লাগেনি কারণ সিনেমাটা ছিল চরম টানটান উত্তেজনায় ভরা সুপার একটি সিনেমা। সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে বুঝলাম সিনেমা হলের ভেতরে সাহারা মরুভুমির গরম লাগলেও বাহিরে ছিল চেরাপুঞ্জির মতো তুমুল বৃষ্টিস্নাত পরিবেশ। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরলাম সবাই কিন্তু সবার মনেই প্রশান্তি সিনেমাটা দেখে।
কোন এক ঈদের দিন দিলশাদ সিনেমা হলে এ জে মিন্টুর ‘বাংলার বধূ ‘’ দেখে দর্শকরা এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিল যে সিনেমা চলাকালীন সময়েই হলের ভেতর ‘’এ জে মিন্টু জিন্দাবাদ’’ বলে স্লোগান তুলেছিল । সিনেমা শেষ হওয়ার পরেও মিন্টুর নামে স্লোগান দিতে দিতে দর্শকরা হল থেকে বের হয়েছিল , আহা!!!
ঈদের মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা নিয়ে আরেকটা বিষয়ে উল্লেখ না করলেই নয় তা হলো – গত কয়েক বছর ধরে দেখছি ঈদ এলেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একশ্রেণির ভক্ত চাটুকাররা যার যার প্রিয় নায়কের চলচ্চিত্র কোন কোন হলে বুকিং পেয়েছে সেটা নিয়ে বিরাট আনন্দেমাখা কৌতুকে পরিপূর্ণ পোস্ট দেয় যা দেখে সত্যি হাসি পায়, মাঝে মাঝে কান্নাও পায় দুঃখে, লজ্জায় । তো যারা সিনেমাহলের বুকিং নিয়েই ছবি সুপারহিট হয়েছে ভেবে থাকেন তাঁদের’কে কিছু বাস্তব কথা বলি । সেই ৮০ ও ৯০ দশকে যখন আজ থেকে আরও বেশি সিনেমা হল ছিল , যখন সারাদেশের গ্রামগঞ্জের, শহরের শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাই সপরিবারে ছবি দেখতে যেতো তখনও সেই সময়কার বাঘা বাঘা প্রযোজক, পরিচালক’রা তাঁদের ছবির ব্যবসার জন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করতেন বা করতে বাধ্য হতেন । কারণ সেইসময় প্রতিযোগিতাটা ছিল আজকের চেয়ে অনেক অনেক বেশি যা আজ রূপকথার গল্পের মতো শুনাবে । সেদিনের সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার দর্শকসংখ্যার হিসাব যদি ধরি তাহলে বলতে হবে দেশের ৭০-৮০% দর্শক সিনেমা হলে ছবি দেখতো যার হিসাবে আজ বড়জোর ২০% হবে । আমি এমনও বাঘা বাঘা প্রযোজক ও বাঘা বাঘা পরিচালকদের সম্পর্কে জানি যারা সেইসময় ছবি মুক্তি দেয়ার পর ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বড় বড় সবগুলো সিনেমা হলের এক সপ্তাহের টিকেট কিনে ফেলতেন আর সিনেমা হলের গেইটে ‘হাউজফুল’ লিখা ঝুলে থাকতো । এই ঢাকার সিনেমা হলে এক সপ্তাহ ‘হাউজফুল’ থাকার খবরটি ইত্তেফাক ও চিত্রালি পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের সাথে প্রচার করতো আর এতেই বাজিমাত করে ফেলতেন এবং পরবর্তী সপ্তাহ থেকে সারা দেশের বিভিন্ন হল মালিক ও সিনেমা দর্শকদের মধ্যে ছবিটি দেখার সাড়া পরে যেতো এবং সত্যি সত্যি সিনেমাটি সুপারহিট ব্যবসা করে ফেলতো ঐ বাড়তি ১/২ লক্ষ টাকা খরচ করার ফলে । আজকের সবগুলো টেলিভিশন চ্যানেল , এফএমরেডিও ও ফেইসবুকের এখনও এতো ক্ষমতা নেই সেদিনের মতো সারাদেশের সিনেমা হলে সব শ্রেণি পেশার দর্শকদের সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখতে উদ্বুদ্ধ করার যা ছিল সেদিনের দৈনিক ইত্তেফাক ও সাপ্তাহিক চিত্রালি পত্রিকার আর সাথে ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনে ছবির ট্রেলার ও রেডিওতে ছবিটির বিশেষ অনুষ্ঠান । আমার খুব পরিচিত এক বড় ভাই যিনি ঢাকায় থাকেন তিনিও একদিন তাঁর এক স্মৃতিচারণায় উনার খুব চেনা ও পারিবারিক ভাবে সম্পর্কিত এক নাম করা প্রযোজক ও একজন পরিচালকের একটি ঘটনার কথা আমার সাথে ভাগভাগি করেছিলেন যা হলো উনার পরিচিত এক প্রযোজক ও একজন পরিচালক ছিলেন যারা তাঁদের একটি ছবি মুক্তি দেয়ার পর ‘বলাকা’ সিনেমা হলের সামনে দিয়ে বড় ভাইটি যাওয়ার পথে দেখলেন গেইটে ‘হাউজফুল’ শব্দটি বড় বড় অক্ষরে লিখা টাঙ্গানো । সাথে সাথে উনার মনে পড়ে গেলো সেই প্রযোজক ও পরিচালকদ্বয়ের কথা যারা ছবিটি মুক্তি দেয়ার আগে উনার এক চাচার বাসায় বসে পরিকল্পনা করেছিলেন সে কথা। উনি (বড় ভাইটি) বলাকা সিনেমা হলের আশেপাশে সময় কাটানো শুরু করলেন কারণ তিনি দেখতে চাইলেন সব শেষ হলে দর্শক কি পরিমাণ বের হয় তা । সব শেষ হয়েছে পরবর্তী শো দেখার জন্য অনেক দর্শক ভিড় করতে লাগলেন কিন্তু হলের প্রধান গেইট বন্ধ যার ভেতর থেকে দুজন কর্মচারি বলছেন ‘’টিকেট দেয়া যাবে না, সব শেষ, হল আগেই বুকিং দেয়া এবং হাউজফুল’’ । উনি যা বুঝার বুঝে গেলেন , হলের ভেতরে আসলে সেদিন কোন দর্শকই ছিল না, টিকেট আগেই সব কিনে ফেলেছিলেন প্রযোজক ফলে ‘হাউজফুল’ লিখা দেখিয়ে দর্শকদের ফিরিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। সেই বড় ভাইটি ২/৩ দিন পর দেখলেন সারাদেশের বিভিন্ন হল মালিকরা ছবিটি নেয়ার জন্য প্রযোজকদের ফোন দিচ্ছেন , দর কষাকষি কষছে এবং ছবিটি শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি ব্যবসা সফল হলো । …… উপরে উল্লেখিত প্রকাশিত ঘটনাটা কেন বললাম সেটা এবার বুঝিয়ে বলছি শুনুন।
৮০ ও ৯০ দশকের বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি ছিল এতো জমজমাট যে সেখানে রাজ্জাক, আলমগীর, সোহেল রানা, জসিম, ওয়াসিম, ফারুক, বুলবুল , কাঞ্চন, জাফর ইকবাল এর মতো একাধিক তারকা ছিলেন এবং প্রযোজকের অভাব ছিল না । সব ধারার গল্পের ছবি তখন নির্মিত হতো । সেইসময় বলিউডের ছবিতে অমিতাভ, রাজেশ খান্না, ঋষিকাপুর, বিনোদ খান্না, জিতেন্দ্র, ধর্মেন্দ্র’র মতো স্টাররা রাজত্ব করতেন এবং মাল্টিস্টার জমজমাট গল্পের ছবি ব্যবসা করতো বেশি । সেই ধারাকে টেক্কা দেয়ার জন্য আমাদেরও প্রযোজকেরাও মাল্টিস্টার ধারার ছবি নির্মাণ করতেন বেশি ফলে এক নায়ক নায়িকা অভিনীত ছবিগুলো একটু বেশি রিস্কি হয়ে যেতো তাই প্রযোজক পরিচালকরা মাঝে মাঝে এমন কৌশল করতেন নিজেদের ছবিটির ব্যবসার জন্য । একজন প্রযোজক ৩৫/৪০ লাখ টাকা দিয়ে সিনেমা নির্মাণ করে ১/২ লক্ষ টাকার জন্য মার খাবেন সেটা মেনে নেয়াটা কষ্টকর । কিন্তু উনাদের কৌশল যাই হোক উদ্দেশ্য ছিল সৎ কারণ উনাদের কৌশলটা ক্লিক করলে ঐ ছবিটি দেখতে সারা দেশের হলগুলোতে দর্শক ভিড় করতো । সেই জমজমাট যুগে যদি এমন কৌশল প্রযোজকরা নিতে পারতেন তাহলে আজকের মৃতপ্রায় ইন্ডাস্ট্রির জন্য সিনেমা হল বুকিং কৌশলটা প্রচার করা দোষের নয় । তবে দোষটা তখনই হবে যদি ঐ কৌশলের পরেও যারা ২ লক্ষ টাকা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ছবিটি নিয়েছেন সেইসব হল মালিকরা যদি ২ লক্ষ টাকার ব্যবসা না করতে পারে তখন সেটা হিতে বিপরীত হবে এবং বাকি সিনেমা হলগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে । ফেইসবুকে যেসকল তারকার অন্ধ ভক্তরা ১০০+ হল বুকিং দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে ছবিটিকে ‘সুপারহিট’ ভাবছেন তাঁরা আসলে একটি ছবি সফল হওয়ার পেছনের মূল উপাদানগুলো সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এই অজ্ঞতার ফলে উনারা প্রিয় তারকার ও প্রযোজকের চাটুকারিতা ছাড়া আর কিছুই করছেন না। ধরে নিলাম শাকিব খানের সিনেমা ১৬০ হলে ২ লক্ষ টাকা করে ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ছবিটি নিলেন এতে কিন্তু ছবি মুক্তির আগেই প্রযোজকের টাকা উঠে গেলো কিন্তু এখন দেখতে হবে যে ১৬০ টি সিনেমা হল ছবিটি নিয়েছে তাঁদের মধ্যে সর্বনিম্ন ১০০ টি সিনেমা হল কি ২ লক্ষ টাকা অর্থাৎ ২ কোটি কাটার ব্যবসা করতে পেরেছে কিনা? যদি না পারে তাহলে অবস্থা আগামিতে আরও ভয়াবহ হবে কারণ কতদিন সিনেমা হল মালিকরা এভাবে লোকসান দিয়ে চালাবে? ২ কোটি টাকা ব্যবসা করতে হলে ১০০ টি সিনেমা হলে দর্শকদের টিকেট কেটে সিনেমা দেখতে যেতে হবে যা আজকের ২০% পক্ষে এমন বাজি ধরা যায়না । আজ যারা ২০% দর্শকদের মধ্যে পড়েন তাঁদের ১০% এর বয়স ১৫-২০ বছরের মধ্যে যারা সপরিবারে হলে গিয়ে ছবিটি দেখার জন্য পরিবারকে বলতে পারেন না। বাকী ১০% হলো শ্রমিক মজুর শ্রেণি যারাও এখন সপরিবারে হলে ছবি দেখতে যায় না এবং বর্তমান বাণিজ্যিক বাংলা সিনেমার উপর বিরক্ত । সিনেমা সুপারহিট হয় তখনই যখন সিনেমা হলগুলোতে নতুন ছবিটি সব শ্রেণির দর্শকরা দেখতে যায় । দর্শক যদি সিনেমা হলে না যায় তাহলে সিনেমা হল বুকিং নিয়েই পেট ভরা গল্প শোনাতে হবে যা দিয়ে আসলে পেট ভরে না এবং ইন্ডাস্ট্রির কোন লাভ হয়না। ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ কিংবা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিগুলো রেকর্ড পরিমাণ ব্যবসা করেছিল সিনেমা হল বুকিং পাওয়ার গল্প দিয়ে নয় সব শ্রেণীর দর্শকদের উপচে পরা ভিড় ছবিগুলোকে দিয়েছিল সাফল্য । সিনেমা হল মালিকরাও ৪ /৬সপ্তাহ ধরে সিনেমাগুলো প্রদর্শন করেছিলেন দর্শকদের জন্যই । একটি বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের সফলতা যদি সিনেমা হলে বুকিং পাওয়ার মধ্যেই হয়ে যেতো বা নির্ভর করতো তাহলে এতো বছরের পর বছর ধরে সিনেমা হলে দর্শক নিজের টাকা দিয়ে টিকেট কেটে সিনেমা দেখতে যাওয়ার দরকার কি? আর এই পর্যন্ত তাহলে বাংলাদেশের কোন সিনেমাই ফ্লপ হয়নি বলা যেতো । কারণ আজ থেকে বহু বছর আগে একেকটি মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা সারা বছর জুড়ে দেশের বিভিন্ন জায়গার সর্বমোট ২০০/৩০০ সিনেমা হলে যেতো ।
বিগত শতাব্দীর দুই দশকে পরিবার ও বন্ধুদের সাথে দেখা আমার ঈদের স্মরণীয় সিনেমাগুলো হলো – শহিদুল ইসলাম খোকনের ‘লড়াকু’, ‘বীরপুরুষ’, বজ্রমুস্ঠী, কামাল আহমেদের ‘লালুভুলু’, ‘গরীবের বউ’, শিবলি সাদিকের ‘নীতিবান’ ‘দোলনা’, মোতালেব হোসেনের ‘আক্রোশ’, ‘টাকা পয়সা’, দেওয়ান নজরুলের ‘আসামী হাজির’, ‘ধর্ম আমার মা’, ‘জনি’, এ জে মিন্টুর ‘মান সম্মান’, ‘অশান্তি’, ‘বিশ্বাসঘাতক’, বাংলার বধূ, দেওয়ান নজরুলের কালিয়া, বাংলার নায়ক , মোতালেব হোসেনের হিংসা, স্ত্রী হত্যা, মনোয়ার খোকনের ‘ ঘাত প্রতিঘাত, সংসারের সুখ দুঃখ , উজ্জলের ‘’পাপির শাস্তি’’, শহিদুল ইসলাম খোকনের দুঃসাহস, রাক্ষস, পালাবি কোথায়, দিনমজুর, মাসুদ পারভেজের ঘরের শত্রু, শাহ আলম কিরনের বিচার হবে , উত্তম আকাশের মুক্তির সংগ্রাম, বাদল খন্দকারের বিশ্বনেত্রী, সোহানুর রহমান সোহানের কেয়ামত থেকে কেয়ামত, স্বজন, বিদ্রোহী কন্যা, অগ্নিসাক্ষর, মালেক আফসারির ক্ষমা, কামাল আহমেদের অবুঝ সন্তান, মতিন রহমানের অন্ধ বিশ্বাস, মমতাজুর রহমান আকবরের ডিস্কো ড্যান্সার, বাবার আদেশ, বশিরা, কে আমার বাবা, এ জে রানা’র ডন , আজকের হিটলার, মূর্খ মানব, …… সহ আরও অনেক। আজো ঈদ আসে ঈদ যায় কিন্তু সেদিনের মতো সিনেমা মুক্তি পায় না ।
গত প্রায় ২০টি বছর ধরে এই দেশের এক শ্রেণীর ভণ্ড, অসাধু ও দেশবিরোধি গোষ্ঠী বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সিনেমা ধ্বংস করতে যে খেলাটি খেলছেন সেই খেলাটি আজো বন্ধ হয়নি বরং নতুন রুপে চলছে। শুরুতে কাটপিস নামের অশ্লীল দৃশ্য যুক্ত করে সিনেমা হল থেকে সপরিবারে দেখতে আসা দর্শকদের সরিয়ে দিলেন । সেদিন ঐ গোষ্ঠী যুক্তি দেখালেন ‘’স্যাটেলাইট চ্যানেলে ঘরে বসে এর চেয়েও নগ্ন ছবি ,নগ্ন দৃশ্য দর্শক দেখে সেই দর্শকদের হলে টানতে আমরা ছবি চালাতে কাটপিস দিলে ক্ষতি কি?’ …ক্ষতি কি সেটা এইদেশের সিনেমা হল বাঁচাতে হিন্দি ছবি আমদানি করে উনারা এখন পাপ মোচন করার চেষ্টা করছেন । সেই অশ্লিল যুগ শেষ হলেও ঐ গোষ্ঠী এখনও থেমে নেই , ২০০০ এর পর থেকে একটি গোষ্ঠী চলচ্চিত্রকে টেলিভিশনের পর্দায় নামিয়ে আনলেন এবং ভালো চলচ্চিত্রের সংজ্ঞা বুঝাতে লাগলেন কিন্তু তাতেও কোন কাজ হচ্ছে না যার ভয়াবহ পরিণতি দু বছর আগে নুসরাত ফারিয়ার এক মন্তব্যই স্পষ্ট হয়ে গেলো যিনি চলচ্চিত্র শিল্প বলতে টেলিভিশন শিল্পকেই বুঝেছেন । এর মাঝে একজন নায়ক ও তার ভক্তকুলেরা বাংলা বাণিজ্যিক সিনেমাকে জনপ্রিয়তার আসমানে তুলতে গিয়ে একই ধাঁচের , নকল গল্পের সস্তা ছবি নিয়ে লাফাতে লাগলেন যেন উনি ছাড়া এই দেশের দর্শক এর আগে কোনদিন সিনেমা দেখেনি । চলচ্চিত্র শিল্পকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে দেশবিরোধী অসাধু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নতুন খেলা/ কৌশল হলো এবার ‘সিনেমা হল বুকিং’ যার ফলাফলদেখতেই পাচ্ছেন যৌথ প্রযোজনার নামে ভারতীয় ছবি দেশের সিনেমা হলে প্রদর্শিত হচ্ছে । ঐ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সম্পূর্ণ সফল যারা বহুদিন ধরে এই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে ধ্বংস করে হিন্দি না হোক অন্তত ভারতীয় বাংলা ছবির বাজার এই দেশে বিস্তৃত লাভ করতে পেরেছেন আর আমাদের কিশোর তরুণ অন্ধ চাটুকার’রা আছে (বুঝে , না বুঝে) সেই গোষ্ঠীর ভেতর থাকা একটি সিন্ডিকেটের মধ্যে যারা বাহিরে থেকে প্রকাশ করে বাংলা সিনেমার পাগল ভক্ত কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঠিকই বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির বারোটা নয় চৌদ্দটা বাজিয়ে দিচ্ছেন । এই চলচ্চিত্র শিল্পের পতন রুখার সাধ্য আজ আমাদের কারো নেই ।