মুনিবা মাজারি: একটি যুদ্ধ জয়ের গল্প

মুনিবা মাজারি: একটি যুদ্ধ জয়ের গল্প

মুনিবা মাজারি; যিনি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ও মানসিক বাধা পেরিয়ে আজ বিশ্বের কাছে নিজের পরিচিতি করে নিয়েছেন। তিনি বুঝিয়েছেন, যা কিছু হারিয়েছেন তা দিয়ে নয় বরং যা কিছু আছে তা নিয়েই নিজেকে নতুন করে কিভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। আর তাই মুনিবা মাজারি পাকিস্তানের প্রথম মডেল যিনি হুইলেচেয়ার ব্যবহার করেন। মুনিবা একাধারে একজন চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী, টিভি উপস্থাপক ও মোটিভেশনাল স্পিকার।

মুনিবা মাজারির জন্ম ৩রা মার্চ ১৯৮৭ সাল। পাকিস্তানের একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। ২০০৮ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি একটি সড়ক দুর্ঘটনায় তার দুটি পা চলন ক্ষমতা হারায়। এই পঙ্গুত্ব হয়তো তার কাছ থেকে সারাজীবন নিজ পায়ে ভর দিয়ে চলার ক্ষমতাকে কেড়ে নিয়েছে ঠিকই। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য দিয়েছে তার চেয়েও বেশি। দিয়েছে মানুষের ভালোবাসা, মানুষকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা।

নিজের আঁকা ছবির সামনে মুনিবা মাজারি

২০০৫ সালে মুনিরা মাজারি এক সাবেক বিমান বাহিনীর কর্মকর্তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে মুনিবার পিতা তার বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু রক্ষণশীল পরিবারের আর আট-দশটি মেয়ের মতোই অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বসতে হয় বিয়ের পিড়িতে। তার বিবাহিত জীবন তিনি বেশি একটা সুখী ছিলেন না। একজন দায়িত্বহীন ব্যক্তিকে নিয়ে সাংসারিক জীবন বেশি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। বিয়ের দুই বছর পর মর্মান্তিক এক সড়ক দূর্ঘটনার  সম্মুক্ষীন হন এই দম্পতি। মুনিবার স্বামী তাকে গাড়িতে একা রেখে নিজে আত্মরক্ষা করে চলে যান । মুনিবা মাজারি গাড়িটিতে আটকে পড়েন। এতে তিনি গুরতর আহত হন। তার ডান হাতের রেডিয়াম-আলনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাতের কব্জি ভেঙে যায়। কাঁধের হাড় ও কণ্ঠনালী মারাত্মক ক্ষতবিক্ষত হয়। মেরুদণ্ড আঘাত প্রাপ্ত হয়।

দুর্ঘটনার পরপর আশেপাশের মানুষজন তাকে উদ্ধার করে হাঁসপাতালে ভর্তি করলে তিনি ক্রমাগত সুস্থ্য হয়ে ওঠেন । এই সময়টা ছিল তার জন্য হতাশা ও একাকীত্বের আর সঙ্গী হিসেবে ছিল অশ্রু।

দত্তক নেয়া সন্তানের সাথে মুনিবা মাজারি

সময়ের সাথে সাথে তার জীবনের সমস্ত দুঃসংবাদগুলো তার কানে আসতে শুরু করলো। ডাক্তার তাকে বললেন, আমি শুনেছি ছবি আঁকা আপনার শখ কিন্তু আপনি আর কোনোদিন ছবি আঁকতে পারবেন না। আর আপনার মেরুদণ্ডের অবস্থা এতোটা খারাপ যে আপনি আর কোনোদিন হাঁটতেও পারবেন না। ডাক্তার আরও বললেন, আপনি কোনদিন মা হতে পারবেন না। দৃঢ়চেতা মুনিবা মাজারি দীর্ঘশ্বাসের সাথে তার সমস্ত দুঃসংবাদগুলোকে উড়িয়ে দিলেন।

মুনিবা মাজারি লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই তিনি লড়াইয়ের মাঠে নামলেন। তার ভাইকে রঙের ব্যবস্থা করে দিতে বললেন। এবং তুলির আচড়ে নিজের বেদনাকে চিত্রায়িত করতে থাকলেন। সূক্ষ্মচেতনার মুনিবার আঁকা প্রথম ছবিটি ছিলো, বিছানায় তার মৃতদেহের ছবি। এই ছবিটিই তার ঘোষিত যুদ্ধকে অনুপ্রাণিত করে তুলেছিল। ছবিতে তিনি জীবনের গল্প বলতে পারতেন। আশপাশের মানুষ তার ছবির প্রসংশা করতে থাকলো।

মুনিবা মাজারি অন্য কারও জন্য নয়, শুধু নিজের জন্য বেঁচে থাকতে চাইলেন। এবং সঠিক মানুষ হওয়ার তাগিদ অনুভব করলেন; যার ফলে তিনি পরিণত হয়েছেন আজকের মুনিবা মাজারিতে। একজন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বে।

মুনিবা মাজারি’র চিত্রকর্ম ‘সেট মি ফ্রি’। সময়- ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭

সামনে অগ্রসর হতে ভয় পেতেন তিনি। তাই ভয় পাওয়া সবকিছুর একটা তালিকা তৈরি করলেন এবং শুরু করলেন ভয়কে জয় করার অদম্য যুদ্ধ। তার প্রথম ভয় ছিলো ‘বিবাহ বিচ্ছেদ’ । এ সময় কঠিন পরিস্থিতির শিকার হলেন মুনিবা। তার স্বামী বিয়ে করলেন। তিনি আবেগ চাপা দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন স্বামীকে। শুভ কামনা জানালেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার। দ্বিতীয় ভয় ছিলো, ‘মা না হতে পারা’। তিনি এই ভয়টিকে জয় করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। মা হওয়ার জন্য সে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সাথে যোগাযোগ শুরু করলেন। প্রায় দুই বছর পর পাকিস্তানের একটি ছোট গ্রাম থেকে তার একটি ফোন আসে দুই দিনের একটি বাচ্চাকে আনার জন্য। তিনি  তখন মা হওয়ার আনন্দ ফিরে পেলেন। তিনি চেয়েছিলেন নিজেকে বদ্ধ না রেখে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। তাই তিনি তার শখটাকে কাজে লাগালেন। ছবি আঁকা শুরু করলেন। বিভিন্ন মডেলিং ক্যাম্পে যোগ দিলেন। তিনি পাকিস্তানে একটি জাতীয় টিভিতে উপস্থাপক হিসেবে যোগ দিলেন। তার চলার পথটা হয়তো কঠিন ছিল কিন্তু তিনি থেমে যাননি। এখন সে কথা বলে নারী ও শিশুর অধিকার নিয়ে। অবশেষে তার সেই অর্জনের দিনগুলো আসলো। ২০১৫ সালে বিবিসির সেরা ১০০ জন নারীর মধ্যে তাকে স্থান দেওয়া হয় ও সম্মানিত করা হয়। ২০১৬ সালে ‘ফোর্বস’র সেরা ৩০ জন নারীর তালিকায় তার নাম স্থান পায় ৩০ তম অবস্থানে।

মুনিবা মাজারির মনে করেন, “আসলে থেমে গেলে চলবে না, তুমি যখন নিজেকে একটি হু্চইলচেয়ার এর মধ্যে আবদ্ধ রাখবে, তখন সবচেয়ে কষ্টের দিক হল, মানুষজন ভাবেযে ওরা অন্য মানুষদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।  এর কারণ হচ্ছে ওরা পরিপূর্ণ  আর আমরা হুইলচেয়ারে বন্দিরা  অসম্পূর্ণ। তাই তোমার অবস্থান যাই হোক না কেন নিজের প্রতি নিজের আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে। তুমি যদি নিজেকে গ্রহন করতে পার গোটা পৃথিবী তোমাকে গ্রহণ করবে”।

মুনিবা মাজারি’র আঁকাআঁকির দুনিয়া

তিনি বলেন, জীবন হল একটা পরীক্ষা ও পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ণের জায়গা আর পরীক্ষা কখনও সহজ হয় না। জীবনকে যদি শুধু উদযাপন করতে চাওয়া হয় জীবন তোমাকে সে আয়োজন করে দিবে। তোমার প্রাপ্তির জন্য তুমি জীবনকে দায়ী করতে পার না। কারণ তুমি তোমার উদ্দেশ্যকে বেছে নিয়েছ। ভাল ফলাফলের জন্য যেমন তুমি, খারপাটার জন্যও তেমনি। তাই সবকিছুই ঠিক আছে শুধু নেতিবাচক কিছু দেখে হতাশ হয়ে ছেড়ে দেওয়াটা কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ইতিবাচক বা নেতিবাচক সকল অবস্থাকেই সাদরে গ্রহণ করতে হবে। আমি কখন ভাবিনি হুইলচেয়ারে  থাকব, কখনোই হুইলচেয়ারে আটকে থাকার চিন্তা করিনি। আমি হাল ছেড়ে দেই নি। সামনের দিকে এগিয়ে গেছি।

বিখ্যাত মানুষেরা সবসময় বলে থাকেন, জীবনে ব্যর্থ তার কোন স্থান নেই। কিন্তু আমি বলি জীবনে ব্যর্থতা অবশ্যই থাকবে, ব্যর্থ  না হলে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব না। প্রতিটি নিঃশ্বাসকে উপভোগ কর। জীবনকে উদযাপন কর, মৃত্যুর আগেই মরে যেওনা । সুখ থাকে কৃতজ্ঞতায়, তাই নমনীয় হয়ে বেঁচে থাক, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে অমর করে তোল। অদম্য স্পৃহা আর ইচ্ছাশক্তিই পারে নিজেকে সামনের পথে চলতে সাহায্য করতে; কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে একজন লৌহমানবী: মুনিরা মাজারি তৈরি করতে।

বর্তমানে মুনিবা মাজারি পাকিস্তানে জাতিসংঘের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে নিয়োজিত আছেন।