রশিদে ধরাশায়ী বাংলাদেশ, হোয়াইটওয়াশের লজ্জা দিল আফগানরা

রশিদে ধরাশায়ী বাংলাদেশ, হোয়াইটওয়াশের লজ্জা দিল আফগানরা

আফগানিস্তানের বিপক্ষে হোয়াইটওয়াশ বাংলাদেশ
শেষ ম্যাচে পরাজয় ১ রানে
ম্যান অফ দ্য ম্যাচ : মুশফিকুর রহিম
ম্যান অফ দ্য সিরিজ : রশিদ খান

শেষ পর্যন্ত হোয়াইওয়াশের লজ্জাতেই শেষ হল বাংলাদেশের আফগান দর্শন। সান্ত্বনা এই যে, প্রথম দু’ ম্যাচের মতো উড়ে না গিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছে টাইগাররা। হ্যাঁ, শুনতে অদ্ভুত শোনালেও সিরিজ শেষে এটাকেই মনে হচ্ছে বড় প্রাপ্তি!

শুরু ও শেষে নাগিনের দংশন

আফগান ইনিংসের প্রথম ছয় ওভারেই চারজন বোলার আক্রমণে এনেও কোনো সুফল পাননি সাকিব। বরং রুবেলের বদলে দলে আসা মেহেদী প্রথম ওভারেই আঠারো দিয়ে আতঙ্কিত করে তুলেছিলেন টাইগার সমর্থকদের। শুরুর সে আতঙ্ক কাটে নাগিন নাজমুল অপুর দংশনে। তার আবেদনে আম্পায়ার আঙ্গুল তুলে দিলে ভাঙে ক্রমশই বিপদজনক মনে হতে থাকা শেহজাদ-ঘানী জুটি। ইনিংসের শুরুর মতো শেষেও বাংলাদেশকে স্বস্তি দিয়েছেন নাগিন নাচের জন্য পরিচিত এই বাঁহাতি। একটি উইকেটসহ মাত্র তিন রান দিয়ে থমকে দিয়েছেন আফগানদের রানের চাকা।

এবার ভুল করলেন না সাকিব

১৬-২০, এ চার ওভারে পেসারদের ওপর ভরসা রাখার কুফল প্রথম ম্যাচে হাতেনাতেই পেয়েছিলেন সাকিব। তাদের উদারনীতির পূর্ণ ফায়দা নিয়ে বাংলাদেশকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দিয়েছিল আফগানরা। এবারও যখন রাহী এবং রনি দু’ ওভারে ২৬ রান দিলেন, মনে হচ্ছিল প্রথম ম্যাচের দেজা ভ্যুই যেন ফিরে আসছে। কিন্তু এবার ভুল করেননি সাকিব। শেষ দু’ ওভার করলেন নিজে এবং নাজমুল মিলে। আর তাতেই আটকে গেল ১৬০ এর স্বপ্ন। ভুল থেকে যদি এমন নিয়তই শিক্ষা নিত বাংলাদেশ কত চমৎকারই না হতো!

কাজে লাগল আরিফুল ফাটকা

আগে থেকেই পরিকল্পনা করে মাঠে নেমে সেটি ব্যার্থ হলে জুবুথুবু সাকিবকেই দেখা গিয়েছে এর আগে। এ ম্যাচে অনেক সাহসীই দেখালো তাকে। উইকেটের জন্য শুধু নিয়মিতদের ওপরেই না, হাত ঘোরাতে জানেন এমন বোলারদের ওপরও নির্ভর করতে দেখা গেল সাকিবকে। তার সে সাহসী সিদ্ধান্তের সুফল দেখা গিয়েছে আরিফুলের ওভারে। ক্রমশ বিপদজনক হতে থাকা স্ট্যানিকজাইয়ের হাতে ছয় হজম করার পরেও তাকে ফিরিয়ে অধিনায়কের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন এ তরুণ।

স্লথ ফিল্ডিং এবং অতিরিক্তে উদার

ক্যাচিং চমৎকার হলেও এ ম্যাচে একটি জিনিস বেশ ভালো করেই চোখে পড়েছে, সেটি হচ্ছে ডাইরেক্ট থ্রোতে বাংলাদেশি ফিল্ডারদের অপারদর্শিতা। একাধিক সুযোগ পাওয়ার পরেও বাংলাদেশের ফিল্ডাররা ভাঙতে পারেননি স্ট্যাম্প। চোখে লেগেছে বোলারের পজিশনও। উইকেটের পিছনে না গিয়ে মাঝ ক্রিজে দাড়িয়ে ডাইরেক্ট থ্রো এর জন্য অপেক্ষা করার দৃশ্যটি ছিল দৃষ্টি কটূ। একই সাথে চোখে লেগেছে বাংলাদেশের বোলারদের উদারহস্তে অতিরিক্ত রান বিলানোটাও। অতিরিক্ত রান সীমিত ওভারে এমনিতেই অভিশাপ, সেখানে এমন মর্যাদা রক্ষার ম্যাচে উদারনীতি প্রশ্নবিদ্ধ করে সক্ষমতাকে।

শুরুতে আফগানদের ব্যাটিং শিক্ষা

বোর্ডে ১৪৫ রান দেখার পর মনে হতে পারে পুরোটা ইনিংসই বোধয় খুড়িয়ে চলেছে আফগানরা। বাস্তবতা ভিন্ন। ওপেনিং জুটি বরং আবারো বড় সংগ্রহের পথে নিয়ে যাচ্ছিল তাদের। অপুর আঘাতের পর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারানোয় বড় ইনিংসের স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে গিয়েছে। পুরো কৃতিত্বই পাবেন বোলাররা। কিন্তু ওপেনিং জুটি ভাঙ্গার আগ পর্যন্ত যেভাবে ব্যাটিং করছিলেন শেহজাদ-ঘানি তা থেকে শিখতে পারে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। নিয়ন্ত্রিত আক্রমণে কি করে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে হয় তার একটি চমৎকার প্রদর্শনি ছিল এটি। হ্যাঁ, এটা বিশ্বসেরাদের রানের গতির তূলনায় অনেক কম, কিন্তু আপনি যখন আট নাম্বার দলের বিপক্ষেই বেসিক ঠিক রাখতে হিমশিম খাবেন, তখন তাদের কাছ থেকেই শিক্ষা নেয়াটা শ্রেয়।

নাম্বার থ্রিতে মিউজিকাল চেয়ার

যে কোনো ফরম্যাটেই একটি দলের ব্যাটিংয়ের অন্যতম মূল ভরসা হয়ে থাকেন তিনে নামা ব্যাটসম্যান। বাংলাদেশ দলে এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি নিয়ে যেন মিউজিকাল চেয়ার খেলা চলছে। প্রথম ম্যাচে সাকিব তারপরের ম্যাচে সাব্বির হয়ে শেষ ম্যাচে সৌম্য নামলেন তিন নাম্বারে। বলাই বাহুল্য, তিনজনের প্রত্যেকেই কৃতিত্বের সাথে ফেল মেরে দলকে আরো বিপদে ঠেলেই ড্রেসিংরুংমের পথ ধরেছেন। আলোচনায় আসবে আউট হবার ধরণগুলোও। এতো দিন পরেও তিনে একজন পরীক্ষিত ব্যাটসম্যান না থাকাটাও বাংলাদেশের ব্যাটিং দৈন্যতার আরেকটি রুপ প্রকাশ করে।

ড্রেসিংরুমের মায়ায় কাত টপ অর্ডার 

সিরিজের মতই দু’দলের টপ অর্ডারও উপহার দিচ্ছে ভিন্ন দৃশ্য। আফগান টপ অর্ডার যেখানে গড়ে দিচ্ছে জয়ের ভিত, সেখানে পাওয়ার প্লেতেই ড্রেসিংরুমে ফেরার তাড়নায় ম্যাচ প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দিয়ে আসছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। তিন ম্যাচে ভিন্ন তিনজন তিনে নেমেও বদলাতে পারেননি পরিস্থিতি। এ ম্যাচের শুরুতেই নেই গত ম্যাচে রান পাওয়া তামিম। মুজিবকে হাকাতে গিয়ে নিজেই পা হড়কে পপাত ধরণীতল। সহজ ক্যাচে বিদায় নিলেন শুরুতেই। তার আউটটি যেন মড়ক লাগালো বাংলাদেশের ইনিংসে। আশ্চর্যজনকভাবে একই কায়দায় রান আউট হয়ে ফিরেছেন সৌম্য এবং লিটন। আফগানদের ফিল্ডিং প্র্যাক্টিস করানোর এই অদ্ভুত প্রয়াসটির চাইলে প্রসংশা করতেই পারেন। আর সাকিবের আউটটিকে বলা যায় সিরিজেরই বিমূর্ত চিত্র। উড়ন্ত শেনওয়ারী, হতাশ বাংলাদেশ। পঞ্চাশ পেরোতেই শেষ চার উইকেট। বড় জানতে ইচ্ছে হয়, কি জাদু ড্রেসিংরুমে!

জানাতে জান্নাতের খোঁজ পেলেন রহিম

শেষ ওভার রশিদ খানই করবেন এটা ছিল দীবালোকের মত স্পষ্ট। তার আগের ওভারটিতে কি করে বাংলাদেশ আগ্রহ ছিল সেটি নিয়েই। আফগান অধিনায়ক আসগর আস্থা রাখলেন করিম জানাতের ওপর। আর জানাতেই যেন জান্নাত খুজে পেলেন রহিম। একটি-দুটি না টানা পাঁচটি চারে ম্যাচ টেনে আনলেন বাংলাদেশের দিকে। ক্রিজে যখন দুই ভায়রা তখন জয়ের স্বপ্ন দেখতেই পারে বাংলাদেশ।

রশিদেই শেষ রহিম, শেষ স্বপ্ন

জানাতের ওভারের শেষ বলটিতে সিঙ্গেল নিয়ে নিশ্চিত করেছিলেন নিজের স্ট্রাইক প্রাপ্তি। রশিদের সাথে যে আধুরা হিসাব চুকানোর ছিল। প্রথম তিন ওভার যেভাবে সামলেছেন তাতে বাংলাদেশ আশাই দেখছিল। কিন্তু আরো একবার রহিম বধ করে রশিদই হাসলেন শেষ হাসি। প্রথম বলেই রহিমের বিদায়ের পরও আশার সলতে জ্বলছিল বাংলাদেশের। কিন্তু শেষ বলের নাটকের পরে শেষ হাসিটাও হাসলো আফগানরাই।

নিঃসঙ্গ রিয়াদ চেয়ে দেখলেন দলের পরাজয়, আরো একবার ব্যর্থ মুশফিক

যখন ক্রিজে নামেন তখন ম্যাচটা আফগানদের হাতেই। শেষ বলে যখন রান আউট হলেন তখনও হাসি আফগানদের মুখেই। তা দেখে কে বলবে মাঝের সময়টাতে ভায়রা মুশফিককে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশকে জয়ের নিঃশ্বাস দুরত্বে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি? রশিদ ম্যাজিকে অসহায় হয়ে দেখলেন আফগান উল্লাস। কাজে আসল না ৪৫ রানের চমৎকার ইনিংসটি। একই ভাবে বৃথা গেল মুশফিকের ইনিংসটিও। পুরো সিরিজেই বাংলাদেশের যেটুকু আনন্দক্ষণ তা উপহার দিয়েছেন এ দুজন। তাদের ব্যাটে ভর করেই সিরিজে প্রথমবারের মত জয়ের আশা করছিল বাংলাদেশ। রশিদ খান প্রাপ্য কৃতিত্ব পাবেন সন্দেহ নেই, কিন্তু দায়মুক্তি পাবেন না রহিম। এর আগেও ক্লোজ ম্যাচে শেষ মুহুর্তের উত্তেজনায় হতাশ করেছেন। এ ম্যাচে সুযোগ ছিল ভুল শোধরাবার। সেটি করতে না পারায় অনুমিত ভাবে আড়ালে চলে যাবে তার লড়াকু ৪৫ রানের ইনিংসটি। জীবনের নিয়মই এমন, ব্যর্থদের গল্প কেউ শোনে না। তাই রাতটি রশিদ খানেরই।