ব্রাজিলের হয়ে ১৯৫৮ সালে তিনি বিশ্বকাপে প্রথম অংশগ্রহণ করেন। সেভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে বিশ্বকাপের ৩য় ম্যাচে মুখোমুখি হয় ব্রাজিল। এবং সেই ম্যাচেই অভিষেক হয় ফুটবল সম্রাটের। তারপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্যারিয়ার শুরু করেছেন সান্তোসের হয়ে এবং শেষ করেছেন নিউইয়র্ক কসমসে। জাতীয় দলের হয়ে ৯২ ম্যাচে তার গোল সংখ্যা ৭৭। ব্রাজিল এবং ফুটবল ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ বিশ্বকাপ জয়ী খেলোয়াড় তিনি (৩ বার)। ৭৭ বছর বয়সী ফুটবল সম্রাট পেলে, ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা ফিফা’র সাথে কথা বলেছেন বিশ্বকাপের স্মৃতি এবং বর্তমান ব্রাজিল দলের নানাবিধ বিষয় নিয়ে।
ফিফা : ৭৭ বছর বয়স হয়ে গেলেও ফিফা বিশ্বকাপের কথা উঠলেই আপনার নাম উচ্চারণ হয়। এত বছর পরেও এই টুর্নামেন্ট আপনার কাছে কতটুক তাতপর্য রাখে?
পেলে : আমার অনেকগুলো বিশ্বকাপের গল্প রয়েছে বলার। ১৯৫৮ ছিল একটা স্বপ্নের মত। আমি তখনো বাচ্চা ছেলে এবং কেউ ভাবেনি আমরা সেবার চ্যাম্পিয়ন হতে পারব। তারা ভিনসেন্ট ফিওলাকে প্রশ্ন করত, ১৭ বছরের একটা বাচ্চা নিয়ে আমরা কিভাবে বিশ্বকাপ জিতব। কিন্ত আমরা জিতেছি। তারপরের বার, ৬২ বিশ্বকাপে ব্রাজিল খুব ভাল দল ছিল। আমি ইনজুরিতে পড়ে যাই। কিন্ত আমরা বিশ্বকাপ জিতি। ৬৬ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপেও আমি ইনজুরি বাঁধিয়ে ফেলি। কিন্ত আমি ১৯৭০ বিশ্বকাপের সব ম্যাচ খেলি। আমি বিশ্বকাপ জয় দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু এবং শেষ করেছি।
১৯৫৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে সুইডেনের বিপক্ষে আপনি কিংবদন্তিতুল্য গোল করেছিলেন। ডিফেন্ডারের মাথার ওপর দিয়ে করা মুভটা কি পরিকল্পিত ছিল?
পেলে : যদি আমি বলি সব পূর্ব পরিকল্পিত ছিল তাহলে মিথ্যা বলা হবে (হাসি)। এটা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল। এবং তখন আমার অন্যতম একটা গুণ ছিল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ভাল কিছু করা। আমি বলটা প্রথমে নিয়ন্ত্রণ করি। বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় আমার দিকে তেড়ে আসছিল। ওই মুহুর্তে আমি তার মাথার ওপর দিয়ে বল ফ্লিক করি। মুভটা একদমই ঈশ্বরের তরফ থেকে এসেছিল। আমার তখন চিন্তা করারও সময় ছিল না।
একইভবে ১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপের ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে হেড থেকে করা গোলটাও ছিল ধ্রুপদী।
পেলে : আমরা ট্রেইনিংয়ে এটা অনুশীলন করতাম। অবশ্যই গোলের পুরো প্রক্রিয়াটা না, কিন্ত পজিশনিং নিয়ে কাজ করতাম। আমরা একটা থ্রো-ইন পেয়েছিলাম এবং অন্যান্য সব বারের মতো সামনের খেলোয়াড়ের কাছে বল না দিয়ে পোস্টে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। যখন বাম দিক থেকে থ্রো করা হয় আমি তখন একটু দূরে ডান উইংয়ে অপেক্ষারত ছিলাম। রিভেলিনো এবং আমি চেষ্টা করেছিলাম গোলের জন্যে। হ্যাঁ সুযোগটা হঠাৎই আসে কিন্ত আমরা এটা ট্রেইনিংয়ে অনুশীলন করেছিলাম।
আপনার এখনো মনে আছে হেড থেকে করা গোলের কথা?
পেলে : অবশ্যই। হেডিংটা এমন একটা বিষয় যা আমার রক্তেই ছিল। আমার ফুটবলার বাবাও হেড থেকে অনেক গোল করেছেন। আমি সবসময়ই তাকে অনুকরণের চেষ্টা করতাম। আমি খুব লম্বা না হলেও আমার পায়ে যথেষ্ট জোর ছিল। আমার বাবা আমাকে প্রায়ই বলতেন, “বলে হেড দেয়ার সময় বেশিরভাগ ফুটবলার চোখ বন্ধ করে ফেলে। যখন তোমার দিকে বল আসবে তখন বলের দিকে নজর রাখো এবং পছন্দ মত যায়গায় বল পাঠাও।” আমি এটা নিয়ে অনেক কাজ করেছি এবং আমি সফল ছিলাম। আমি হেড থেকে অনেক গোল করেছি। আপনার চোখ খোলা রাখতে হবে মাথায় বল লাগাতে হবে।
কিন্ত সবক্ষেত্রেই তো হেডের চেষ্টা সফল হতো না, তাই না? এখনো অনেকে ব্রিটিশ গোলকিপার গর্ডন ব্যাংকসের করা সেভের কথা বলে থাকে।
পেলে : হ্যাঁ ঠিক তাই, সব সময় সফল হওয়া যায় না। গরডন ব্যাংকসের সেভটাও একই রকম ছিল।
১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সব সময়ই ব্রাজিলের ভাল দল ছিল। আপনার কি কখনো মনে হয়েছে আপনি বাকিদের তুলনায় সেরা?
পেলে : ওই সময়টা ব্রাজিলের জন্য সেরা ছিল। তখন ব্রাজিলে গারিঞ্চা, দিদি এবং জিকোদের মতো সেরা খেলোয়াড় ছিল। এবং ওই সময় ব্রাজিল দল খুবই সাজানো গোছানো ছিল। ভিনসেন্ট ফিওলার একটা কথা আমার মনে পড়ে, “আমি জানি আমি কি বলছি। আমি বয়সে তোমাদের থেকে বড়, আমি এই দলের কোচ। একটা কথা মনে রাখবে, তোমরা বিশ্বের সেরা দল। কিন্ত একই সাথে বিপক্ষ দলকেও সম্মান দেখাতে হবে। এক মুহুর্তের জন্যেও চিন্তা করার কারণ নাই তোমাদের শুধু মাঠে নেমে খেলা জিতলেই হবে। তোমরা মাঠে নামবে এই কথা মাথায় রেখে যে, বিপক্ষ দলের সম্মান তোমাদের অর্জন করতে হবে।” তার কথাগুলো এখনো আমার মনে আছে। তিনি ছিলেন আমাদের সেরা শিক্ষক।
এবারের বিশ্বকাপ রাশিয়ায় হতে যাচ্ছে। ব্রাজিলের কি সামর্থ্য রয়েছে এবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার?
পেলে : ব্রাজিল দলের সব সময়ই সামর্থ্য রয়েছে বিশ্বকাপ জেতার। কিন্ত সমসাময়িক টুর্নামেন্টগুলোতে আমরা আটকে গেছি কারণ প্রস্ততির জন্য সময় ছিল কম। ব্রাজিলের বেশিরভাগ খেলোয়াড় দেশের বাইরে ফুটবল খেলে। কিন্ত আমাদের সময় এমন ছিল না। আমরা তখন প্রস্ততির জন্য অনেক সময় পেতাম। কিন্ত এখন একটা দলকে প্রস্তত করা কোচদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন আর সহজেই বলার উপায় থাকে না ‘এটা আমাদের দল’। কিন্ত আমি মনে করি ব্রাজিলের প্রত্যেকটা খেলোয়াড় বিশ্বসেরা।
তারা কি এবারের বিশ্বকাপে ফেভারিট?
পেলে : ব্রাজিল সবসময় ফেভারিট! ব্রাজিলকে যদি প্রস্ততির জন্য সময় দেয়া হয় তাহলে তারা সব সময় বিশ্বকাপ জেতার সামর্থ্য রাখে।
এছাড়া আর কোন দলকে আপনি ফেভারিট মনে করেন?
পেলে : আপনার সব সময়ই জার্মানিকে সম্মান দেখাতে হবে। এমনকি রাশিয়ার দলও ভালো এবং তাদের নিজ মাটিতে খেলা হওয়ায় তারাও এগিয়ে থাকবে। এছড়া লাতিন আমেরিকা থেকে আর্জেন্টিনার ক্ষমতা রয়েছে বিশ্বজয়ের।
আপনার কি মনে হয় নেইমারই ব্রাজিলকে সফলতার চূড়ায় নিয়ে যাবে?
পেলে : নেইমার তার খেলার ধরনে পরিবর্তন এনেছে। ক্লাবের হয়ে সে বাম দিকে থেকে আক্রমণে যায়। কিন্ত ব্রাজিল দলে তার জায়গা ভিন্ন। জাতীয় দলে নেইমার একজন প্রথাগত নাম্বার টেন। এখানে সে আক্রমণের মাঝে থাকে। এবং দুই দলে দুই জায়গায় খেলা কঠিন কাজ। কিন্ত নেইমার এই প্রক্রিয়ায় নিজেকে অভ্যস্ত করে নিচ্ছে। আপনি বৈশ্বিক জায়গা থেকে দেখলে লিওনেল মেসি এবং রোনালদোর পরেই নেইমার। এছাড়া আর কোন সুপারস্টার নাই। জাতীয় দলের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে একটা দল হয়ে খেলা। জার্মানির দিকে তাকালেই এটা দেখতে পাবেন, তারা একটা দল হিসেবে খেলে। এখন আর ওই সময় নাই যে একজন খেলোয়াড় একাই একটা দলকে টেনে নিয়ে যাবে।
নেইমার কি ব্রাজিলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে প্রস্তত?
পেলে : হ্যাঁ, সে প্রস্তত। নেইমার ব্রাজিলের মূল খেলোয়াড়। নিজেকে এর জন্যে তার প্রস্তত করে নিতে হবে। আমি মনে করি টেকনিক্যালি নেইমার ইতোমধ্যেই বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নাই।
ফিফা ডটকম থেকে নিয়ে সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন জবানের নিজস্ব লেখক দেওয়ান মারুফ শুভ