আহত ফিলিস্তিনি ফুটবলারের বার্তা ও প্রীতি-ম্যাচ বাতিলের নেপথ্য কাহিনী

আহত ফিলিস্তিনি ফুটবলারের বার্তা ও প্রীতি-ম্যাচ বাতিলের নেপথ্য কাহিনী

অনেক ফিলিস্তিনি নাগরিক আর্জেন্টিনা ফুটবল টিম, বিশেষত লিওনেল মেসির ফ্যান। তাই জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের পর নাজুক সময়ে আর্জেন্টিনার জেরুজালেমে প্রীতি ফুটবল খেলার ঘোষণাটি মেসি সমর্থকদের জন্য ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। বাংলাদেশেও এটা নিয়ে অনেকে সোচ্চার ছিলেন। বাংলাদেশেও অনেক কড়া আর্জেন্টিনা ভক্ত এবং মেসি বলতে পাগল নাগরিক আছেন। তাদের জন্যও এই ঘটনাটা ছিল বিব্রতকর। অবশেষে প্রীতি ম্যাচ বাতিলের ঘোষণায় যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। বিরোধী পক্ষের তীব্র সমালোচনার হাত থেকে এবং নিজের মনেও গভীরের বেদনা বোধ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এই প্রীতি ম্যাচ বাতিলের খবরে দুই দেশেই মেসি সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক আনন্দ লক্ষ্য করা গেছে। আমরা এই লেখায় সংক্ষেপে ম্যাচ বাতিলের নেপথ্যে কী কী ঘটনার প্রভাব ছিল তা বুঝতে চেষ্টা করব।

প্রথমে এই প্রীতি ফুটবল ম্যাচটি হওয়ার কথা ছিল ইসরায়েলের হাইফায়। পরে নেতানিয়াহু সরকার ম্যাচটি ইসরায়েলের ৭০ বছর পূর্তি উদযাপনের উদ্দেশ্যে জেরুজালেমে স্থানান্তর করে এর রাজনৈতিক রূপ দেন। খেলা আর খেলার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না তখন। ফলে শুরু হয় খেলা বিরোধী নানা বিক্ষোভ প্রতিবাদ। তার ওপর যেই স্টেডিয়ামে খেলাটি হওয়ার কথা ছিল তা দাঁড়িয়ে আছে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে তাদেরই রক্তে ভেজা মাটির উপর। মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরের পর জেরুজালেমে যে কোন আন্তর্জাতিক সেলিব্রেশান এখন ফিলিস্তিনিদের জন্য ভীষণ বেদনার কারণ হবে এটাই স্বাভাবিক। তার ওপর গেল দুই মাসে ফিলিস্তিনিদের ‘গ্রেট রিটার্ন মার্চে’ বা গাজা সীমান্ত বিক্ষোভে ইসরায়েলি সেনাদের হাতে নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা প্রায় ১০৪ আর আহত ১৩ হাজারের বেশি। নিহতদের মাঝে আছে আহতদের চিকিৎসা দিতে আসা ডাক্তার, প্যারামেডিক, শিশুসহ অনেকে, যা আন্তর্জাতিকভাবে ইসরায়েলকে বেশ সমালোচনার সম্মুখীন করেছে। বিডিএস মুভমেন্টকে গতিশীল করেছে। আর এই সময়টি ছিল জেরুজালেমে এই প্রীতি ম্যাচেটির জন্য অত্যন্ত সেন্সিটিভ।

বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, বিশেষত বিডিএস এর আহ্বায়ক টিমগুলো জেরুজালেমে এই খেলা বাতিলের জন্য বেশ কিছুদিন ধরে দারুনভাবে সক্রিয় ছিল। এমনকি এই আহ্বানে যোগ দেয় আর্জেন্টিনার ট্রেড ইউনিয়ন ও মাদ্রেস ডি প্লাজা দেল মেয়ো। গত সপ্তাহে এই খেলা বাতিলের জন্য আর্জেন্টিনা ফুটবল এসোসিয়েশন (এএফএ) এর বাইরে বুয়েনোস আইরেসে তারা সমাবেশ পর্যন্ত করে। কিন্তু এসব বিক্ষোভে আর্জেন্টিনা টিমকে শারীরিক হুমকি দেয়া হয় নাই। খেলা হলে তারা আর্জেন্টিনার জার্সি, ছবি পোড়াবে পর্যন্ত বলেছিল এর বেশি কিছু না। বলা যায় মোটামুটি ভদ্রোচিত প্রতিবাদ ছিল। কিন্তু এই খবরগুলো কোন ভাবেই ফলাও করে মিডিয়াতে প্রচার করা হচ্ছিল না। আসলেই এই ধারাবাহিক প্রতিবাদ ও বিশ্ববাসীর ইসরায়েলের প্রতি অনাস্থার কারণেই এই ম্যাচ বাতিলের ঘটনাটি ঘটতে পেরেছে।

খেলা বাতিলের জন্য আর্জেন্টিনা ফুটবল টিম এবং মেসির কাছে সরাসরি অনুরোধ জানিয়ে আসছিল বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠন, মানবাধিকার সংস্থা এবং ফিলিস্তিনের ফুটবল টিম আর তার খেলোয়াড়েরা।

মোহাম্মদ খলিল হচ্ছে তেমন একজন ফিলিস্তিনি ফুটবলার যে গত মাসে ইসরায়েলি স্নাইপারের গুলিতে দুই পা হারিয়ে তার ফুটবল ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছেন। যার ভিডিও বার্তা মেসির কাছে সরাসরি পাঠানো হয়, সাথে ছিল হাজার স্বাক্ষরযুক্ত খেলা বাতিলের অনুরোধ। খলিলের বার্তা অবশ্যই এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। একজন খেলোয়াড়ের জন্য তার দেশের আইডেন্টিটি কতটা জরুরি তা মেসিও ভালো করেই জানেন। যতই ভাল খেলোয়াড় হন না কেন নিজে দেশ যদি বিশ্ব দরবারে নিজের আত্মপরিচয় নিয়ে দাঁড়াতে না পারে তা হলে নিজের প্রতিভাও অকেজো থেকে যায়। অবহেলিত থেকে যায়। এই জন্য অনেক খেলোয়াড় নাগরিকত্ব পরির্বতন করতে বাধ্যও হন। কিন্তু খলিল তো তা করতে পারেন না। তার জন্মভূমি যে ৭ দশক ধরে রক্ত দিয়ে যাচ্ছে। পঙ্গুত্ব বরণ করেও থেমে থাকেননি খলিল। নিজের দেশের জন্য মনোবল নিয়ে লড়ছেন। এই ভিডিও বার্তাও নিজের দেশের প্রতি লড়াইয়েরই অংশ। এই করুণ আহবান হয়তো মেসিকে ভাবতে বাধ্য করেছে।

ফিলিস্তিনি ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে খলিল একা ইসরায়েলি সেনাদের ভয়াবহ অত্যাচারের শিকার হননি, আরও অনেক খেলোয়াড় স্নাইপারের গুলিতে পা হারিয়ে গত দুই মাসে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। এবং এই নির্মতা অব্যাহত আছে।

গত সপ্তাহে, আর্জেন্টিনা ফুটবল টিম যখন বুয়েনোস আইরেসে বিশ্বকাপ খেলার জন্য প্র্যাকটিস করছিল তখন মেগা ফোন দিয়ে ফিলিস্তিনিদের সাপোর্টারেরা সরাসরি খেলোয়াড়দের তাদের খেলা বাতিলের বার্তা প্রদান করে। এই সব কিছুই হয়ত মেসিসহ টিম আর্জেন্টিনাকে তাদের খেলা বাতিলের সিদ্ধান্তে পৌছাতে প্রভাবিত করেছে।

যদিও ইসরায়েল আর তার সাপোর্টারেরা আর্জেন্টিনার খেলা বাতিলের কারণ হিসাবে দেখিয়েছে নিরাপত্তা, কিন্তু ফ্যাক্ট হচ্ছে জেরুজালেম এই মুহূর্তে নি:ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরে আবৃত। সেখানে নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোন কারণ নেই। ইসরায়েল ছাড়া আর কোন সন্ত্রাসী বাহিনীর সেখানে নিরাপত্তায় ব্যাঘাত ঘটানোর সম্ভাবনা নেই। গাজা, পশ্চিম তীর কিংবা অন্য কোন জায়গা থেকে মানুষ তো দুরের কথা একটা প্রাণীরও সাধ্য নাই ইসরায়েলি চেকপোস্ট আর প্রাচীর ডিঙিয়ে, ইসরায়েলি সিকিউরিটির চোখ এড়িয়ে জেরুজালেমে প্রবেশ করে কোন কিছু করার। সেখানে আর্জেন্টিনার মতন ফুটবল টিমকে যে কি পরিমাণ নিরাপত্তা দেয়া হতো তা নিয়ে কারো কোন দ্বিধা থাকা উচিৎ নয়। অতএব, নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে খেলা বাতিলের কারণ হিসেবে মেনে নেয়ার কোন যুক্তি নাই। এখানে নিরাপত্তার চিন্তাটা আসলে অবান্তর।

এছাড়া গত মাসে গায়িকা শাকিরা তেল আবিবে তার কন্সার্ট বাতিল করেছেন। ন্যাটালি পোর্টম্যান জেরুজালেমে এসে অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। নিউজিল্যান্ডের পপ স্টার লর্ড, ব্রাজিলিয়ান লেজেন্ড গিলবার্ট জিল তাদের শো বাতিল করেছেন। শো বাতিল হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার প্রশ্নে, আর এমন বাতিল শো এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

ফিলিস্তিনিদের ওপর নৃশংসতায় নেতানিয়াহু ট্রাম্পের নিরংকুশ সমর্থন পাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু দিন দিন হারাচ্ছেন বিশ্বের অন্যান্য দেশের সমর্থন। যার কারণে জাতিসংঘে নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদুত নিকি হ্যালি গতকাল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সম্প্রতি গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের হাতে ফিলিস্তিনিদের নিহত হওয়ার জন্য ফিলিস্তিনিদের দায়ী করে যে ড্রাফট রেজ্যুলুশান পেশ করেছিলেন তাতে ‘হ্যা’ ভোট পড়েছিল মাত্র একটি, খোদ নিকির নিজের দেয়া একক ভোট। এটা ছিল আমেরিকার জন্য খুবই লজ্জাজনক। এটা নিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। নিকি হ্যালির মানসিক সুস্থ্যতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। অর্থাৎ, আমেরিকা ছাড়া বাকি বিশ্ব এখন আর ইসরায়েলি প্রপাগান্ডা হজম করছে না। মেনে নিচ্ছে না।

ফলে এই প্রীতি ম্যাচ বাতিলের বিষয়টি সারা বিশ্বের ফিলিস্তিনিদের প্রতি ঐক্য বা সহানুভূতিশীলতার ধারাবাহিকতারই ফল। এটা হুট করেই হয়েছে তা নয়। আর এটা নিয়ে ইসরায়েলি প্রচারণাও কোন কাজে আসছে না। আপনি তাদের পছন্দ করেন বা না করেন এই ঘটনার জন্য অবশ্যই মেসি ও টিম আর্জেন্টিনা ধন্যবাদ পেতে পারেন।