বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার জন্যে যার যার দল সাজাতে ব্যস্ত দেশগুলো। গত কয়েক দিনে জার্মানি সহ কয়েকটা দল নিজেদের দল ঘোষণা করে। কিন্ত আসন্ন বিশ্বকাপের সব খবর ছাপিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা শুরু হয় একটা ম্যাচ নিয়ে। এবং তাও কিনা বিশ্বকাপের প্রস্ততি ম্যাচ। হ্যাঁ আর্জেন্টিনা বনাম ইসরায়েলের এই প্রীতি ম্যাচের মধ্য দিয়ে শেষ হওয়ার কথা ছিল আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ প্রস্ততি। আগামী শনিবার ইসরায়েলের দখলকৃত জেরুসালেমে প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ হিসেবে এ খেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্ত ফিলিস্তিনসহ সারা দুনিয়ার মানুষের জোরালো প্রতিবাদের মুখে মানবতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে খেলাটা বাতিল করে আর্জেন্টিনা ফুটবল এসোসিয়েশন।
জেরুজালেম ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের জন্য খুবই স্পর্শকাতর জায়গা। ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে মনে করে। অন্যদিকে জেরুজালেমকে ইসরায়েলও মনে করে তাদের রাজধানী। কিছুদিন আগেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতিস্বরুপ মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করেছেন। এবং এই দখলদারিত্বের বৈধতা আদায় করতেই ইসরায়েলের নানাবিধ উদ্যোগের একটি হচ্ছে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধেকার এই ম্যাচ। এটি স্পষ্ট বোঝা যায়, কারণ ম্যাচটি প্রথমে হাইফা শহরে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও পরবর্তীতে সেটি পশ্চিম জেরুসালেমে সরিয়ে আনা হয়। এবং এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ক্ষুব্ধ করেছিল ফিলিস্তিনিদের।
বিক্ষুদ্ধ ফিলিস্তিনিরা বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ গড়ে তোলে এবং মেসি বাহিনীর কাছে বার্তা পৌঁছানোর চেষ্টা করতে থাকে। “তোমরা জোরপূর্বক দখলকৃত ভূমিতে পা রাখতে যাচ্ছ। রুখে দাঁড়াও, মানবতার খাতিরে!” এভাবেই মেসির ছবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ডে দেখা যায় আর্জেন্টিনাকে খেলতে না আসার অনুরোধ করা ব্যানার বিলবোর্ডে। এছাড়া ফিলিস্তিনি ফুটবল কর্তৃপক্ষ এই ম্যাচ না খেলার আহ্বান জানিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে। ফিলিস্তিনি ফুটবল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে আর্জেন্টাইন সরকারের কাছেও ম্যাচটি খেলতে জেরুজালেমে না আসার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লেখা হয়।
ফিলিস্তিনি ফুটবল কর্তৃপক্ষের সভাপতি ম্যাচটি না খেলার ব্যাপারে লিওনেল মেসিকে আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, “শত অনুরোধের পরেও মেসি যদি ইসরায়েল যান, তাহলে তাঁর জার্সি ও ছবি পোড়ানো হবে ফিলিস্তিনের মাটিতে।” উল্লেখ্য, মেসি এর আগে গাজায় ভ্রমণ করেন এবং ফিলিস্তিনে মেসির অসংখ্য ভক্ত রয়েছে।
কিন্ত প্রতিবাদ শুধু এখানেই থেমে থাকেনি। সামাজিক মাধ্যমগুলো উত্তাল হয়ে পড়ে আর্জেন্টিনার এই ম্যাচটি নিয়ে। হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে ফেসবুক টুইটারে। প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে এবং এক সময় জেরুজালের পশ্চিম তীর ছাপিয়ে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্স এবং বার্সেলোনাতেও ছড়িয়ে পড়ে। এবং পরিস্থিতি দেখে আর্জেন্টিনার ফুটবল সংস্থা খেলাটি বাতিল ঘোষণা করাই শ্রেয় মনে করে।
আর্জেন্টিনা ফুটবল সংস্থার পরিচালক হুগো ময়ানো জানান, “ইসরায়েলে না যাওয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক। যে সকল কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে ইসরায়েলে, যেভাবে নিরপরাধ মানুষ মারা হয়, একজন মানুষ হিসেবে আপনি কখনোই তা গ্রহণ করতে পারবেন না। খেলোয়াড়েরাও হুমকির মুখে পড়ে যাবে এর ফলে।”
আর্জেন্টিনার স্ট্রাইকার গঞ্জালো হিগুয়েইন ইএসপিএন স্পোর্টসকে ম্যাচ বাতিলের কথাটি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “তারা শেষ পর্যন্ত সঠিক কাজটি করেছে। আমি মনে করি যৌক্তিকতা এবং জীবনের মূল্য সবচেয়ে বেশি। ইসরায়েল না যাওাই সঠিক সিদ্ধান্ত।”
আর্জেন্টিনার এই খেলা বাতিলের সিদ্ধান্তটি ইসরায়েলকে বয়কট করার অন্যম নিদর্শন হয়ে থাকবে। ফিলিস্তিনি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান জিবরি রাজৌব বলেছেন, “মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং খেলার জয় হয়েছে এবং এ ম্যাচ বাতিলের মাধ্যমে ইসরায়েলকে লাল কার্ড প্রদর্শন করা হয়েছে।”
খেলাটি ইসরায়েলের হাইফাতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও সূচি পরিবর্তন করে জেরুজালেমের টেডি স্টেডিয়ামে আনা হয়। স্টেডিয়ামটি ফিলিস্তিনের একটা গ্রামে অবস্থিত, যেটি ১৯৮৪ সালে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল।
একারণেই ফিলিস্তিনিরা চায়নি তাদের রক্তের বিনিময়ে গড়া এই স্টেডিয়ামে যেন প্রিয় দল আর্জেন্টিনা না খেলে। প্রিয় খেলোয়াড় মেসির পায়ের স্পর্শ না পড়ে।
আর্জেন্টিনা ফুটবল ম্যাচ বাতিলের খবর গাজায় ছড়িয়ে পড়ার পর ফিলিস্তিনদের মাঝে বেশ উৎফুল্ল ভাব দেখা গেছে। পশ্চিম তীরের রামাল্লা শহরে ফিলিস্তিনি ফুটবল এসোসিয়েশন এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের সাথে ম্যাচ বাতিলের জন্য আর্জেন্টিনার স্ট্রাইকার লিওনেল মেসি এবং তার সতীর্থদের ধন্যবাদ জানিয়েছে।
ফিলিস্তিনি ক্যাম্পেইন গ্রুপ আভাজ প্রথম থেকেই এ ম্যাচ বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিল। এবং ম্যাচ বাতিলের ঘোষণা আসার পর তারা আর্জেন্টিনার সিদ্ধান্তকে ‘সাহসী নৈতিক সিদ্ধান্ত’ বলে উল্লেখ করেছে।
উল্লেখ্য, কয়েক দিন আগে গাজা সীমান্তে স্বাস্থ্যকর্মী রাজন আল নাজ্জারকে গুলি করে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী। যুদ্ধ ক্ষেত্রে কোন স্বাস্থ্যকর্মীকে হত্যা করা যুদ্ধাপরাধ। জাতিসংঘ থেকেও এর তীব্র নিন্দা জানানো হয়। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনদের বিক্ষোভের সময় ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে অন্তত ১২০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
যদিও খেলা বাতিল হওয়ায় আর্থিক অনটনে থাকা আর্জেন্টিনা ফুটবল সংস্থারই একটা বড় লোকসান হবে। আর্জেন্টাইন ফুটবল সাংবাদিক রয় নেমার জানান, ইসরায়েলের বিপক্ষে মাঠে নামলে প্রতি মিনিটের জন্য ৫০ হাজার ডলার করে পেতেন লিওনেল মেসি। এছাড়া জেরুজালেমে ম্যাচটি আয়োজন করতে আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে এরই মধ্যে ১ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে ইসরায়েল ফুটবল ফেডারেশন। চুক্তি ছিল ম্যাচের পর আর্জেন্টিনার হাতে আরও ৩ মিলিয়ন ডলার তুলে দেওয়ার। সফর বাতিল হয়ে যাওয়ায় আর্জেন্টিনা আর এই টাকা পাচ্ছে না। উল্টো ১ মিলিয়ন ডলার ফেরত দিয়ে দিতে হবে তাদের। আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করেই ইসরায়েলের বিপক্ষে ম্যাচ বাতিল করেছে আর্জেন্টিনা।
এই সিদ্ধান্তে আর্জেন্টিনা প্রমাণ দিল মানবিকতা সবার উর্ধ্বে, তারপরে ফুটবল। বয়কট ইয়াসরায়েলের পক্ষ থেকেও আর্জেন্টিনার এই সিদ্ধান্তের প্রতি সাধুবাদ জানান হয়। নিঃসন্দেহে ইসরায়েলের বিরূদ্ধে আর্জেন্টিনার এই অবস্থান ভবিষ্যতে ইসরায়েলকে বয়কটের ক্ষেত্রে এবং ফিলিস্তিনের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করবে।