ঈদের খুশির বড় একটা অংশ জুড়ে থাকে ঈদের কেনাকাটা। ঈদ আসতে আর খুব বেশি দেরি নেই। কিন্তু তাতে কি! ঈদের বাজারতো সরগরম। এই ঈদকে সামনে রেখে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের মার্কেটগুলো সেজেছে বর্নিল সাজে।
শুধু কলকাতার মানুষই নয়, বিগত কয়েক বছর ধরে ঈদের বাজার করতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকেও এসেছেন বিপুল পরিমাণ ক্রেতা। শপিংপাগল কেউ কেউ সকাল ১০টার আগেই এসেছেন ব্যস্ত বিকিকিনির বাজারে। আর আসবেনই না কেন, কলকাতার নিউ মার্কেটে তো সবার জন্যই কিছু না কিছু আছে। রকমারি জামাকাপড় আর রঙচঙে গয়না ছাড়াও রয়েছে জনপ্রিয় হরেক রকম উপহার সামগ্রী ও খাবারের দোকান। কলকাতার এই শপিং সেন্টারে সব থেকে বেশি আসক্ত বাংলাদেশিরা। শুধু শপিং সেন্টার নয়, কলকাতার রাস্তায় ঘুরে শপিং করার মজাও আলাদা। পকেটের কথা চিন্তা না করেই যেখানে শপিং করে মজা সে শহরের আরেক নাম হল কলকাতা।
কলকাতায় ভ্রমণ ও চিকিৎসা করতে আসা বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলে এ ধারণাটা আরো শক্ত হল। সবার এক কথা, কম দামে পছন্দের জিনিস কিনতে কলকাতা সত্যিকারের উৎকৃষ্ট স্থান।
এখানকার বাজারগুলোতে সন্ধ্যার পর ভিড় বেশি দেখা যায়। অনেকে যেমন ইফতারের আগে সকালের দিকে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদের কেনাকাটা সেরে নেন, আবার অনেকে ইফতারের পর ধীরে-সুস্থে সে কাজ করেন। তবে গত বছরের চেয়ে এবার একটু ভিড় কম। ধর্মতলা থেকে গড়িয়াহাট, শিয়ালদহ থেকে রাজাবাজার বা বেলগাছিয়া-পার্ক সার্কাস থেকে এন্টালি-খিদিরপুর—সব জায়গায়ই বেশ জমজমাট ঈদের বাজার। আর কলকাতার ঐতিহাসিক নিউমার্কেট আর তার আশপাশের বাজারে হাঁটার উপায় নেই। যেদিকে চোখ যায়, শুধু অগণিত মাথা। সবাই চাইছে ঈদের নতুন নতুন ডিজাইনের পোশাক আর প্রসাধনী।
দোকানগুলোও ঈদ সামনে রেখে পসরা সাজিয়েছে নানান বাহারি পণ্যের। বিভিন্ন নামি-দামি কোম্পানিও ঈদের বাজার ধরার জন্য তাদের পণ্যে ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে। শুধু মুসলিম এলাকায় এই ভিড় নয়, কলকাতার অন্যত্রও একই চিত্র। কেউ কেউ আবার পার্ক স্ট্রিট, রাজাবাজার, চিৎপুর, মেটিয়াবুরজ, খিদিরপুর, বেলগাছিয়া, ধর্মতলার ভিড় ছেড়ে হাজির হোন গড়িয়াহাট, বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জসহ শহরের বিভিন্ন শপিং মলে। আর যারা দরদাম করতে চাইছে না, তারা সরাসরি ঢুকে পড়েছেন বিভিন্ন শপিংমলে। শপিংমলগুলোও ঈদ সামনে রেখে সাজিয়ে তুলেছে তাদের বিপণী। ঝলমলে আলো দিয়ে সাজিয়ে তুলেছে চারপাশ। পার্ক সার্কাস, মল্লিক বাজার, খিদিরপুর, রাজাবাজার, বেলগাছিয়া—এসব মুসলিম এলাকায় বিরাট বিরাট তোরণ বানিয়ে ঈদ মোবারক ব্যানার টাঙিয়ে সব মানুষকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। কলকাতার উপশহর নিউটাউন, কৈখালি এবং রাজারহাটের বড় বড় রাস্তাতেও ঈদকে স্বাগত জানিয়ে বড় বড় তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী জাকারিয়া স্ট্রিটের নাখোদা মসজিদ চত্বর ঘিরে এখন ঈদের বাজার জমজমাট। মসজিদের আশপাশে টুপি-আতর থেকে নানা ধরনের সেমাইয়ের দোকান। একই চেহারা কলকাতার ধর্মতলার টিপু সুলতান মসজিদ চত্বরে। এসব এলাকায় বাংলাদেশের মানুষজন সস্তায় কিনে নিচ্ছেন তাদের পছন্দের পণ্য। এক্ষেত্রে অবশ্যই বলতে হয় শ্রীরাম মার্কেটের কথা। নিউমার্কেটের মাটির নীচে এই মার্কেট সবার পছন্দের। কি নেই এতে। পছন্দসই জামা কাপড় কেনার জন্যে এই মার্কেট দ্বিতীয় স্থানে।
বাংলাদেশিরাও মনে করেন বাংলাদেশের তুলনায় কলকাতায় ঈদের কেনাকাটা অনেকটাই সস্তায় সেরে নেওয়া যায়। কলকাতায় একটি চুড়িদার পিস যেখানে এক হাজার রুপি, বাংলাদেশে সেটা বিক্রি হয় তিন হাজার টাকায়। এখানকার বড় বাজারেও জামাকাপড় সস্তা ও পাইকারি দামে পাওয়া যায় বলে তারা মনে করেন।
মল্লিক বাজারের বিক্রি ভাল হচ্ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তৈরি পোশাকের সঙ্গে নানা প্রসাধনী সামগ্রী, স্বর্ণালংকার থেকে কাঁচের চুড়ি বিক্রি হচ্ছে এখানে। আবার শ্রী লেদার্স, খাদিম’সসহ বিভিন্ন জুয়েলারি শপে ঈদ উপলক্ষে ঘোষণা করেছে পণ্যমূল্যের ওপর বিশেষ ছাড়। বিভিন্ন শপিং মলও দিয়েছে বিজ্ঞাপনী ঘোষণায় ঈদের ছাড়ের সঙ্গে নানা উপহার দেওয়ার কথা।
এই প্রচণ্ড গরমেও অনেকে ভিড় জমাচ্ছেন কাশ্মিরী শালের দোকান ১২৫, ১২২ ও ১২৩ নিউমার্কেটের কাশ্মিরী শাল অ্যাম্পোরিয়ামে। কলকাতার প্রথম কাশ্মিরী শালের দোকান এটি। জগৎ বিখ্যাত পশমিনা শাল এই দোকানের প্রধান আকর্ষণ। সেই কারণে যারা কলকাতায় আসছেন তারা এ দোকান থেকে সংগ্রহ করছেন কাশ্মিরের আসল কাশ্মিরী শাল। তবে অনেকে এবার গত বছরের তুলনায় দাম একটু বেশি নেওয়ার অভিযোগ তুলছেন। আর হাল-ফ্যাশনের তেমন পোশাক নেই বলেও অভিযোগ জানালেন বাংলাদেশি তরুণ ক্রেতারা।
এদিকে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছরই প্রচুর সংখ্যক মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতে আসেন বিভিন্ন কারণে। চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা এবং ভ্রমণ-এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোক আসেন ভ্রমণ ভিসা নিয়ে। আর এ সংখ্যাটি প্রতিবছরই বাড়ছে।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক হিসেবে দেখা যায়, চলতি অর্থ-বছরের এগারো মাসেই টুরিস্ট ভিসায় ভারতে যাওয়ার জন্য ৫৭ মিলিয়ন ডলার ( ৫কোটি ৭০ লাখ ডলার) বৈদেশিক মুদ্রা করা হয়েছে যা গত বছরের তুলনায় ১০ মিলিয়ন বেশি। ভ্রমণ ভিসা নিয়ে যারা আসছেন তাদের একটা বড় অংশই ঈদের আগে কেনাকাটা সেরে ফেলছেন। ফলে বড় একটি ক্রেতা হারাচ্ছে বাংলাদেশের বাজার। ভারতের পণ্যের প্রতি বাংলাদেশের ক্রেতাদের এই আগ্রহ কেন?
ঢাকার বাসিন্দা ফারহানা আশরাফি কলকাতায় এসেছেন পুরো পরিবার নিয়ে। সামনে ঈদ আর সেটা মাথায় রেখে কিনেছেন বেশকিছু পোশাক। এর আগেও যতবার এসেছেন প্রতিবারই ভারতে ভ্রমণের পাশাপাশি বাড়তি আকর্ষণ থাকে কেনাকাটা। তিনি বলেন, “দেশের কাপড়ের সাথে ভারতের কাপড়ের পার্থক্য প্রধানত দাম বেশি। ওদের কাজ ভাল, কালার কম্বিনেশন ভালো। ওখানকার পোশাক এনে বাংলাদেশে বিক্রি করে কিন্তু দাম রাখে দুইগুণের বেশি।” তবে কলকাতার মুদ্রা ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর বাংলাদেশি পর্যটক কম এসেছেন ঈদের বাজার করতে। টাকাপয়সার সমস্যা আর সীমান্তে নানা হয়রানির জন্য অনেকেই কলকাতা থেকে ঈদের কাপড়চোপড় কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু খুশির ঈদ বলে সেটা গায়ে মাখছেন না অনেকে।