প্রাণের নগরী ঢাকা। ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশের কথা যেন চিন্তাই করা যায় না। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র এই শহর। শতবর্ষ পার করে দেওয়া এই নগরীর বর্তমান জনসংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। সেই হিসাবে ঢাকার প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করেন ৫৫ হাজারের মতো মানুষ।
তীব্র ঘনবসতির এই শহরটির গড়ে ওঠায় অনুসরণ করা হয়নি কোনো সুষ্ঠ নগরপরিকল্পনা। এ কারণেই একটি আদর্শ শহরে ৩০-৩৫ ভাগ স্থান সড়কের জন্য বরাদ্দ থাকলেও ঢাকার ক্ষেত্রে তা মাত্র ৭ শতাংশ। ফলে অবধারিতভাবেই যানজট হয়ে উঠেছে এই নগরীর প্রধান সমস্যা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (এআরআই) গবেষণা অনুযায়ী, যানজটের কারণে প্রতিদিন ঢাকাবাসীর ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। যার আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এই অবস্থা চলতে থাকলে কিছুদিন পর পায়ে হেঁটেই গাড়ির আগে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে মানুষ। এছাড়া এই যানজটের কারণে সৃষ্ট নগরবাসীর স্বাস্থ্যগত ও মানসিক সমস্যাও একেবারে ফেলনা নয়।
এই যানজট সমস্যা সমাধানের পথ অনুসন্ধান করতে গিয়ে উঠে এসেছে অনেক কিছু। বুয়েটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ, সড়ক খাতে বিনিয়োগ, সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদী পদক্ষেপ এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমেই এই যানজট বহুলাংশে হ্রাস করা সম্ভব। উঠে এসেছে দীর্ঘ, মধ্যম ও স্বল্পমেয়াদী সম্ভাব্য সমাধান।
ঢাকার যানজট সমস্যা সমাধানে সরকারের একমাত্র মাস্টারপ্ল্যান হল কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনা বা এসটিপি। রাজউকের অধীনস্থ অঞ্চলের বাইরেও মোট ৩৫০০ বর্গ কিলোমিটার এই পরিকল্পনাতে রাখা হয়েছে। ২০১৫ সালে সংশোধিত এসটিপিতে মাস র্যপিড ট্রানজিটের বদলে মেট্রো রেলের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অন্তর্ভূক্ত করা হয় ঢাকার বাইরের অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের বিষয়টিও।
সংশোধিত এসটিপি প্রস্তুতিতে ভূমিকা রেখেছেন ঢাকার নগর পরিকল্পনা বিষয়ক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, ঢাকা শহরের চারপাশে তিনটি সার্কুলার রোডের বিষয়টি বর্তমান পরিকল্পনায় রয়েছে। এই তিনটি সার্কুলার রোডই হতে পারে যানজট নিরসনের চাবিকাঠি।
বাস ট্রাফিক ট্রানজিটের জন্য রাস্তাতো নাই। আট লেন রোড লাগবে। একলেনে যাবে একলেনে আসবে। প্রগতি সরণী, রোকেয়া সরণী, মিরপুর কোনটাই যথেষ্ট নয়। তবে এগুলো দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা, এগুলো করতেই হবে। শহরকে সচল রাখতে হলে তিনটা সার্কুলার রোড। বর্তমানে যেটা আছে এয়ারপোর্ট রোড সেটাকে প্রশস্ত করতে হবে।
ঢাকা শহরের যানজটের বিষয়ে প্রায়ই উঠে আসে প্রাইভেট কারের আধিক্যের কথা। বিআরটিএতে নিবন্ধনের তথ্য অনুযায়ী গড়ে দৈনিক ৬০টি প্রাইভেট কার নিবন্ধন হচ্ছে ঢাকায়। সারা দেশের প্রাইভেট কারের ৭৮ শতাংশ ঢাকায়। এমনকি বুয়েটের এআরআই-এর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাইভেট কার ব্যবহারের ওপর কড়াকড়ি আরোপের কথা।
কিন্তু অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মনে করেন, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা বাংলাদেশে প্রাইভেট কারের ব্যবহার স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। তার যুক্তি, বিশ্বের অন্যান্য মেগাসিটির তুলনায় ঢাকায় জনসংখ্যা অনুপাতে প্রাইভেট কারের সংখ্যা অনেক কম। তবুও নাটকীয়ভাবে গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানো হলে শহরবাসীর উপকৃত হওয়ার বিষয়ে দ্বিমত নেই তার।
এছাড়া সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ঢাকা শহরের যানজট অনেকাংশেই কমানো সম্ভব বলে যে মত দিয়েছে এআরআই, তা নিয়ে একমত নগর পরিকল্পনাবিদরা। বিশেষ করে ফুটপাত দখলমুক্ত করা সম্ভব হলে যানজটের একটি কারণ নির্মূল হবে। ঢাকায় প্রচুর মানুষ হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছান। দখলমুক্ত ফুটপাতের ব্যবস্থা করলে মানুষের সামনে অন্তত একটা পথ খোলা খাকবে।
সম্প্রতি সরকার ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। একটি কার্যকর ট্রাফিক সিস্টেম প্রতিষ্ঠিত করা গেলে যানজট যে অনেকখানি কমে আসবে, তা বলাই বাহুল্য।
এছাড়া বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে কিছু স্বল্পমেয়াদী সমাধানের কথা। সম্প্রতি রামপুরা মোড়ে ইউলুপ স্থাপনের মাধ্যমে অনেকাংশেই যানজট কমানো সম্ভব হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সব মোড়ে ইউলুপ করা সম্ভব নয়। সর্বত্র স্থাপন করা সম্ভব না হলেও, শাহবাগ, গুলশান ১, বিজয় স্মরণী, গুলিস্তানের মতো বড় বড় মোড়ে ইউলুপ স্থাপন করা গেলে সমগ্র নগরবাসী সুফল পেতে পারেন।
এছাড়া ঢাকা শহরকে বেষ্টিত করে রেখেছে চারটি নদী ও ভেতরে রয়েছে বহু খাল। এসবের অনেকগুলোই দখলে চলে গেলেও, সম্প্রতি সরকার এসব খাল উদ্ধারের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এসব নৌপথও হতে পারে যানজট নিরসনের অন্যতম উপায়। ইতিমধ্যে হাতিরঝিল থেকে ওয়াটার ট্যাক্সিতে করে গুলশানে যাচ্ছেন অনেক মানুষ। সামান্য সম্প্রসারণের মাধ্যমেই এই জলপথের মাধ্যমে আরও বহুদূরে যাত্রী পরিবহণ করা যেতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যায়বহুল প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে স্বল্প ও মধ্যমমেয়াদী প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এসবের বাইরে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিতের কথাও উঠেছে জোরেসোরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষকে ট্রাফিক আইন মানতে সচেতন ও বাধ্য করার বিকল্প নেই। এসবের সমন্বিত বাস্তবায়নই হয়তো প্রিয় ঢাকার যানজটকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসতে পারবে।