ক্লভিস ফার্নান্দেজ : যার শূন্যতা নিয়ে বিশ্বকাপ খেলবে ব্রাজিল

ক্লভিস ফার্নান্দেজ : যার শূন্যতা নিয়ে বিশ্বকাপ খেলবে ব্রাজিল

“ব্রাজিলের হয়ে সবচেয়ে বেশি সময় লড়াই করা ব্যক্তি আমি। আমিই ব্রাজিলের দ্বাদশ খেলোয়াড়।” ২০১৪ বিশ্বকাপের আগে তাকে নিয়ে করা প্রামাণ্যচিত্রে এভাবেই নিজের সম্পর্কে বলেন ২০১৫ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর কিডনি ক্যান্সারে মারা যাওয়া ক্লভিস একোস্তা ফার্নান্দেজ।

৮ জুলাই ২০১৪। স্তাদিও মিনেইরো স্টেডিয়াম, বেলো হরিজন্তে। বিশ্বকাপ সেমিতে জার্মানির মুখোমুখি স্বাগতিক ব্রাজিল। হেক্সার আশায় বুঁদ ভক্তরা ১৯৫০ এর মারাকানা ট্র্যাজেডি ভুলতে মাঠে এসেছে। পুরো আসরে দুই পুত্রসমেত খেলা দেখা এক গোঁফওয়ালা বুড়োও আছেন গ্যালারিতে; বরাবরের মতো হলুদ জার্সি, মাথায় হ্যাট, হাতে বিশ্বকাপের রেপ্লিকা নিয়ে। ৯০ মিনিট শেষ হবার আগে তার দিকে কয়েকবার টিভি ক্যামেরা ঘোরানো হল! ৭-১ গোলে পিছিয়ে ব্রাজিল, পুরো ব্রাজিলে তখন থমথমে ভূতুড়ে আবহ! হাতে থাকা রেপ্লিকাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে ভদ্রলোক যেন বোঝাতে চাইলেন, ভাগ হবে না! চেহারায় স্পষ্ট বিমর্ষতা, চোখ বেয়ে জল পড়ছে অনর্গল। গোটা ব্রাজিলই হয়ত ফুটে উঠেছিল তার চেহারায়। খেলা শেষে ট্রফিতে চুমু খেলেন। এক জার্মান সমর্থককে ডেকে দিয়ে দিলেন তাকে। যাও, এটা তোমাদেরই!

২০১৪ বিশ্বকাপের সেই হৃদয় বিদারক ম্যাচের গ্যালারিতে ক্লভিস ফার্নান্দেজ

ক্লভিস একোস্তা ফার্নান্দেজের গল্পটা শুরু হয়েছিল ১৯৯০ বিশ্বকাপে। কখনোই পেশাদার ফুটবলের চৌহদ্দিও না মাড়ানো একোস্তার ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপে প্রথম অংশগ্রহণ সেবারই। খেলোয়াড় হিসেবে নন, পাগল ভক্ত হিসেবে। এমন ভক্ত যিনি খেলা দেখার টাকা যোগাতে বিক্রি করে দেন নিজের পিজ্জা ব্যবসা। এমন ভক্ত যিনি ব্রাজিলের জার্সিতে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক ম্যাচে (১৪২) মাঠে নামা সাবেক অধিনায়ক কাফুর চেয়েও বেশিবার হলুদ জড়িয়ে গ্যালারিতে ছিলেন। ১৯৯০-২০১৪, ৭টি বিশ্বকাপ, ৬টি কোপা আমেরিকা, ৪টি কনফেডারেশন্স কাপ এবং একটি অলিম্পিকে মোট ১৫৪ ম্যাচ, ৬০টি ভিন্ন দেশ! প্রায় প্রতি ম্যাচে সেলেসাওদের স্কোয়াড বদলেছে, কোচিং স্টাফ বদলেছে, দেশ বদলেছে, টুর্নামেন্ট বদলেছে, কেবল গ্যালারিতে তিনি রয়ে গেছেন চিরায়ত ‘গুয়াচো দ্য কোপা’ (ট্রফিওয়ালা কাউবয়) সাজে।

এবারের বিশ্বকাপে তারুণ্যনির্ভর দল নিয়ে রাশিয়ার বিমানে উঠবেন কোচ তিতে। পাঁড়ভক্তদের অনেকেই ধরবেন রাশিয়ার বিমান, সুদূরে গিয়ে গলা ফাটাবেন দেশের জন্য। ক্যামেরার ফ্লাশে বন্দী হবে গ্যালারি মাতানো বিচিত্র সাজের অজস্র মুখাবয়ব। এদের ভিড়ে কেউ কেউ খুঁজবেন তাকে, তিনি নেই জেনেও। কিন্তু তিনি আছেন। এবার আর ম্যাচের টিকিট, প্লেনের টিকিট এসব কাটার ঝামেলা পোহাতে হবে না। বেঁচে থাকলে বয়সটা কম হতো না। ৪ অক্টোবর ১৯৫৪তে জন্মেছেন, প্রায় ৬৪ ছুঁই ছুঁই বয়সে অতশত ঝক্কি সামাল দেয়া বড্ড কঠিন। কঠিন কাজটাই মানুষকে করতে হয়। যেমন ব্রাজিল দল এবার তার শূন্যতাবোধক নিয়েই মাঠে নামবে। তবে, ফার্নান্দেজ ঠিকই দেখবেন সবগুলো ম্যাচ! হলুদ জামা, কাউবয় হ্যাট আর সোনার ট্রফি হাতে নিয়ে চেনা ঢংয়ে। বিগস্ক্রিনে খেলা দেখতে দেখতে পাশে বসে থাকাদের শুনাবেন ১৯৯৪ এবং ২০০২ বিশ্বকাপ জয়ের সাক্ষী থাকার সোনালী অতীতের শ্লোক। ভদ্রলোক তিনবছরে নিশ্চয়ই তার অনুসারী বানিয়ে ফেলেছেন স্বর্গে!