রিয়াল মাদ্রিদে সদ্যই শেষ হলো জিদান অধ্যায়। প্রায় আড়াই মৌসুমের কোচিংয়ে মাদ্রিদকে তুলেছেন আরো উপরে। যতদিন ছিলেন, আশার আলো জ্বেলেছেন। ১৪৯ ম্যাচে মাদ্রিদের ডাগআউটে দাঁড়ানো সাবেক এই মিডফিল্ডার জয়ের হাসি হেসেছেন ১০৪ বার। জয় সবসময় বিশেষ। কিছু জয় বিশেষত্বের দিক দিয়ে এগিয়ে থাকে। মাদ্রিদকে ৯টি শিরোপা জেতানো জিনেদিন ইয়াজিদ জিদানের তেমন নয়টি জয় নিয়ে এই আয়োজন…
• রিয়াল মাদ্রিদ – উল্ফসবার্গ
২০১৫-১৬ মৌসুমের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনাল। রিয়াল মুখোমুখি জার্মান ক্লাব উল্ফসবার্গের। প্রথম লেগে ২-০ ব্যবধানে হেরে এসে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায়ের শঙ্কা মাদ্রিদ শিবিরে জেঁকে বসে। এপ্রিলের ১২ তারিখ বার্ণাব্যুতে দ্বিতীয় লেগের আগে ভক্তরা নির্ঘুম। কিন্তু রোনালদো আশ্বস্ত করেন তাদের। ‘বার্ণাব্যুতে ৯০ মিনিট যথেষ্ট সময়, ভক্তরা জাদুকরি মূহুর্তের সাক্ষী হতে চলেছে’- এমন কথায় বিশ্বাস ফিরে আসে সমর্থকদের মনে। মাঠে রোনালদো আর মাঠের বাইরে জিদান মিলে আক্ষরিক অর্থেই উপহার দেন জাদুকরি রাত। রোনালদোর হ্যাটট্রিকে ৩-০ গোলে জয়, দুই লেগ মিলিয়ে ৩-২ এগ্রিগেটে রিয়াল মাদ্রিদ সেমি ফাইনালে। টানা তিন ইউসিএল জয়ের পথে প্রথম পদক্ষেপ ছিল সেটিই।
• রিয়াল মাদ্রিদ – অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদ
২০১৬ সালের ১৯শে নভেম্বর ২০১৬-১৭ মৌসুমে প্রথম মাদ্রিদ ডার্বিতে মুখোমুখি হয় স্পেনের রাজধানী শহরের দুই দল। লা লীগায় টেবিল টপার রিয়াল মাদ্রিদকে ঘরের মাঠ ভিসেন্তে ক্যালদেরনে আতিথ্য দেয় দিয়াগো সিমিওনের শিষ্যরা। বরাবরের মতোই ফুটবলীয় নৈপুণ্যের সঙ্গে সমানতালে চলেছে শরীরী প্রদর্শন। এতসবের ফাঁকফোকরেও ঠিকই জয় তুলে নেন জিদান। নগর প্রতিদ্বন্দ্বীদের পাত্তা না দিয়ে তুলে নেয় ০-৩ গোলের জয়। এবারো জিদানকে আনন্দে ভাসান দলের প্রাণভোমরা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ফ্রিকিক, পেনাল্টি আর ট্যাপ ইন থেকে করা তিন গোলে পূর্ণ করেন ক্যারিয়ারের ৩৯তম হ্যাটট্রিক। রিয়ালের ওই জয়ে প্রশস্ত হয় লীগ শিরোপার পথ, মাঝপথেই থেমে যায় অ্যাতলেটিকোর স্বপ্ন।
• রিয়াল মাদ্রিদ – বার্সেলোনা
১৩.৮.২০১৭। নতুন মৌসুমের প্রথম ম্যাচ। স্প্যানিশ সুপার কাপে হয়ে যাওয়া সেবারের এল ক্ল্যাসিকোর শুরুতেই বার্সা পিছিয়ে পড়ে পিকের আত্মঘাতী গোলে। পেনাল্টি থেকে কাতালানদের সমতায় ফেরান মেসি। শেষরক্ষা করতে পারেননি লিও। রোনালদো এবং অ্যাসেন্সিওর লক্ষ্যভেদে ৩-১ গোলে জয় পায় রিয়াল। এক বছরে জিদানের পাঁচ শিরোপার অন্যতম এই স্প্যানিশ সুপার কাপ। সে ম্যাচে রেফারির সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পাঁচ ম্যাচ নিষিদ্ধ হন রোনালদো। কিন্তু তার আগে জিদান বাহিনী দেখিয়ে দেয় তাদের শক্তি আর সামর্থ্য।
• রিয়াল মাদ্রিদ – অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদ
২০১৬ সালের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল। কোচ হিসেবে জিদানের প্রথম অর্জন। মাত্র পাঁচ মাস আগে দায়িত্ব পেয়ে রিয়ালকে সোজা ইউসিএলের ফাইনালে তুলবেন জিদান তা অবিশ্বাস্যই শোনাত। জিদান বলেই বিশ্বাস করতে হয়েছে। স্রেফ ফাইনালে তুলেই ক্ষান্ত দেননি। এক মৌসুম আগে নগর প্রতিদ্বন্দ্বীদের হারিয়েই মাদ্রিদ ঘরে তোলে আকাঙ্খিত দশম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা। জিদান সেবার সহকারী কোচ ছিলেন। এবার পুণরাবৃত্তি ঘটান কোচের ভূমিকায়। নির্ধারিত সময় ১-১ সমতায়, পরের ৩০ মিনিটেও গোল নেই। ম্যাচ গড়ায় ট্রাইবেকে। পাঁচ শটের পাঁচটিকেই জালে পাঠায় রিয়াল, চার শটের একটি থেকে গোল করতে ব্যর্থ অ্যাতলেটিকো। ৫-৩ গোলে জিতে যায় লস ব্ল্যাংকোরা, জিদান পায় প্রথম শিরোপার স্বাদ। জানুয়ারির ৪ তারিখ দায়িত্ব নিয়ে মে’র ২৮ তারিখ এনে দেন ট্রফি, মাত্র ১৪৫ দিনের মাথায়। আর হয়ে যান ইতিহাসের মাত্র সপ্তম ব্যক্তি যিনি খেলোয়াড়-কোচ দুই ভূমিকায় পেয়েছেন এই স্বাদ।
• রিয়াল মাদ্রিদ – দেপোর্তিভো লা করুণা
২০১৬-১৭ সিজনে একমাত্র লা লিগা ট্রফি জেতেন জিদান। সে যাত্রায় দেপোর্তিভো লা করুণার বিরুদ্ধে অ্যাওয়ে ম্যাচে ২-৬ গোলের বিশাল ব্যবধানে জেতে মাদ্রিদের অভিজাতরা। দেপোর্তিভো তেমন চ্যালেঞ্জিং দল না হলেও ওই ম্যাচ জিদানের জন্য কঠিনই ছিল। সম্পূর্ণ দ্বিতীয় সারির দল নামিয়ে যে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছিল মি. ফ্রেঞ্চম্যান, তাতে সফল না হলে বিচ্ছিরি কিছুই হতো। শিষ্যরা নিরাশ করেনি তাকে। আস্থার প্রতিদান দিয়ে বড় জয়ই এনে দিয়েছে কোচকে।
• রিয়াল মাদ্রিদ – বার্সেলোনা
খেলোয়াড়, সহকারী কোচের ভূমিকায় এল ক্ল্যাসিকোর সাক্ষী হলেও কোচ হিসেবে এটিই ছিল জিদানের ফার্স্টএভার এল ক্ল্যাসিকো। লা লিগার ফর্ম কথা বলছিল বার্সার হয়ে, তার উপর খেলাও ন্যু ক্যাম্পে। তাছাড়া অালচেলত্তি, মরিনহোরা নিজেদের প্রথম ক্ল্যাসিকো জিতে ফিরতে পারেননি। জিদানের তাই প্রত্যাশার চাপ ছিল না তেমন। তথাপি লস মেরেঙ্গুয়েজদের জয়ই উপহার দেন তিনি, রোনালদো-বেনজেমার গোলে কাতালুনিয়া থেকে ২-১ গোলে জয় নিয়ে ফেরে জিদান এন্ড কোম্পানি।
• রিয়াল মাদ্রিদ – পিএসজি
সদ্য সমাপ্ত চ্যাম্পিয়ন্স লিগের রাউন্ড অব সিক্সটিনে রিয়ালের মুখোমুখি হয় ফরাসি জায়ান্ট পিএসজি। নেইমার-এমবাপ্পের মতো ইয়ং সেনসেশনদের দলে ভিড়িয়ে ইউরোপসেরা হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে নাসের আল খেলাইফির দল। দুরন্ত ফর্ম নিয়েই প্রথম লেগ খেলতে ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ বার্ণাব্যুতে নামেন নেইমার কাভানিরা। ৩৩ মিনিটে র্যাবিওটের গোলে যেন স্বপ্নের প্রতিফলন। কিন্তু ৪৫ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে মাদ্রিদকে সমতায় ফেরান রোনালদো। বলা ভালো পিএসজিকে ছিটকে দেন ম্যাচ থেকে। ৮৩ মিনিটে সিআরসেভেনের ২য় গোল, ৮৬ মিনিটে মার্সেলোর স্কোরে ৩-১ গোলের জয় নিশ্চিত হয়। পিএসজি সমানতালে লড়ে গেলেও শেষপর্যন্ত ভালবাসা দিবসে পরাজয় উপহার নিয়েই ফিরে যায়।
• রিয়াল মাদ্রিদ – জুভেন্তাস
২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল। ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে টানা দুইবার ফাইনালে রিয়াল। জিদানের সামনে শিরোপা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ। পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র ১ গোল হজম করা জুভেন্তাসের রক্ষণকে ফাঁকি দিতে কেমন ছক কষেছেন জিদান, চায়ের টেবিলে ঝড় উঠেছে এমন আলোচনায়। কিন্তু যা করলেন মাদ্রিদ বস, তাতে রীতিমত আঁৎকে উঠেছে জুভ শিবির। ২০ মিনিটে রোনালদোর গোলে এগিয়ে যাওয়া, ২৭ মিনিটে মারিও মান্দজুকিচের গোল জুভদের সমতায় ফেরায়। ১-১ স্কোরলাইনে টানেলে যায় দু’দল। বিরতির পর ফিরে বন্যতায় মাতে রিয়াল। ৬১ মিনিটে কাসেমিরোর দূরপাল্লার শটে হতভম্ব বুফন, মিনিট তিনেক পর রোনালদোর ২য় গোল তছনছ করে দেয় তুরিনের বুড়ির রক্ষণ। ৯০ মিনিটে মার্কো এসেন্সিও গোল করে দ্বাদশ ইউরোপিয়ান কাপ আনেন মাদ্রিদে। তাতেই ইতিহাস গড়েন জিদান, ইউসিএল টাইটেল ধরে রেখে।
• রিয়াল মাদ্রিদ – মালাগা
অ্যাওয়ে ম্যাচ। ২০১৬-১৭ সিজনে লা লিগার শেষ রাউন্ডের খেলা। মালাগাকে ০-২ গোলে পরাজিত করে রিয়াল। জিদান পান কোচ হিসেবে প্রথম লিগ টাইটেল।