ঢাকার রাস্তার পাশের দেয়ালগুলোতে নানান রকম চিত্র ও কথা দেখে অনেকেরই দৃষ্টি আটকে যায়। আপনাদের হয়তো মনে আছে, সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সুবোধ কবে হবে ভোর?-এই ধরণের অনেক লেখা দেখেছেন। কয়েক দিন আগে সুবোধের খোঁজে পুলিশ-ডিবি গলদঘর্ম অভিযানে নেমেছিল। আমাদের নাগরিকদের মনেও অনেক কৌতূহল এই গেরিলা শিল্পীদের নিয়ে।
‘গ্রাফিতি’ প্রতিরোধের সংস্কৃতি হিসেবে সারা দুনিয়াতেই সমাদৃত। কখনো কখনো স্ট্রিট কালচারেরও একটি আলোচ্য বিষয়। এর শিল্পীদের গেরিলা আর্টিস্ট বলা হয়ে থাকে। বিশাল নাগরিক দেয়ালকে ক্যানভাস করে রাতের অন্ধকারে যত দ্রুত এঁকে ফেলা যায়- এরকম একটি সিদ্ধান্ত থাকে গ্রাফিতির তৎপরতায়। অনেক রাষ্ট্রেই গ্রাফিতি নিষিদ্ধ এবং এ সংশ্লিষ্ট অপরাধ রাষ্ট্রদ্রোহ বলে বিবেচিত হয়। এই বিষয়ে সব সময় ক্ষমতাসীন সরকার বা রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রীয় ব্যক্তিরা জিরো টলারেন্স মুডে অবস্থান করে। শিল্পীরা গ্রেফতার হয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে। বিশ্ব ইতিহাসে গ্রাফিতির উন্মেষ ঘটেছিল আধিপত্যের কাছে অসহায়ত্ব থেকে। এটা হতে পারে সরাসরি বা মানসিক। প্রবল ক্ষমতাকে যখন কোন ভাবইে সরাসরি বা সামনাসামনি মোকাবেলা করা সম্ভব হয় না তখন এই ধরণের গেরিলা পদ্ধতিতে প্রতিবাদ চলে। অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট, এন্টি ইজরায়েল ম্যুভমেন্ট কিংবা হোক কলরব বা আরব বসন্ত এ সবকিছুতেই ছিল গ্রাফিতির ব্যাপক প্রভাব। অনেকে এই ধরণের প্রতিবাদকে সফল প্রতিবাদ হিসেবেই বিবেচনা করে থাকেন। জনমনে নতুন বোধ সৃষ্টির মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরের সাহসী সৈনিক হয়ে দাঁড়ায় গ্রাফিতির শিল্পীরা এবং তার গ্রাফিতিতে প্রতিফলিত চিন্তা জনমনকে আন্দোলিত করতে সক্ষম হয়।
গ্রাফিতির প্রধান উদ্দেশ্যের মধ্যে চিন্তাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটা দ্বারা যা বোঝানো হোক না কেন? তার চে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানুষ কি চিন্তা করছে! এ নিয়ে মানুষের বক্তব্য কি? বাংলাদেশেও গ্রাফিতির ব্যবহার দেখা যায়। নব্বইয়ের ঢাকার রাস্তায় মানুষের মুখে উচ্চারিত হয় আইজুদ্দিনের নাম। ‘কষ্টে আছি আইজুদ্দিন শিরোনাম’ নিয়ে কলাভবনের পাশের দেয়ালে একটা গর্জন দিয়ে ওঠে আইজুদ্দিন। এই শহরের দেয়ালগুলো ধারণ করেছিলো অসহায় মানুষের সমস্ত কষ্ট। আইজুদ্দিনের গ্রাফিতির চিন্তার কেন্দ্রে ছিলো আত্মসমর্পণ। দেয়ালে দেয়ালে সে তাঁর কষ্টের কথা জানিয়েছিল। জানিয়েছিলো ‘গরীবের জন্য ডাক্তার নেই’। তারপর একদিন চুরির মামলায় হাতে হাতকড়া নিয়ে আইজুদ্দিনের পাঠ চুকে যায়। সে সময় একবার হলেও মানুষ মনে করেছিলো জীবন-যাপনের অপ্রাপ্তির কথা।
অতি সাম্প্রতিক সময়ে, ঢাকার দেয়ালগুলো আবার জেগে ওঠে। সুবোধ! তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই, সুবোধ তুই পালিয়ে যা- এখন সময় পক্ষে না, সুবোধ তুই পালিয়ে যা ভুলেও ফিরে আসিস না, সুবোধ, কবে হবে ভোর?’-এরকমই স্লোগান নিয়ে সুবোধ আমাদের ভাবায়। ৪৭ বছরের স্বাধীনতার সূর্য নিয়ে চলে যাওয়া সুবোধ আমাদের জন্য কি চিন্তার বার্তা পৌছে দিতে চাচ্ছে?
সুবোধ যেন আমি, আপনি অথবা অন্য কেউ, সম্ভবত আপনার সামনের কেউ। আবার যেন আমাদের কেউ না। আমরা জানি সুবোধের ব্যাথা, বোধ, কষ্ট কিন্তু সরাসরি আমরা এমন ভাবে বলতে চাই না। বলতে পারি না। ভালো থাকার ছল করতে করতেই অত্যাচারী সময়টা পার করছি আমরা। তাই সুবোধ খুব চেনা আর অনেক অচেনাও একই সাথে।
সুবোধের চতুর্দিকে টর্চার সেলের বেড়া। কোনোদিকে আর ‘বোধ’ অবশিষ্ট নেই। মৌলিক চাহিদার প্রাইভেট প্রাক্টিসে অব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রীয় আধিপত্য, সাংস্কৃতিক বিশৃঙ্খলা, চেতনার ভয়াবহ অপপ্রচার বা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা, শিক্ষা ব্যবস্থায় মেরুদণ্ডহীন রীতি-নীতি, মিডিয়ায় আধিপত্যের ন্যাক্কারজনক রূপ— মত প্রকাশে সর্বোচ্চ বাধা তৈরি করা -এ সবকিছুর প্রতিবাদ খালি গা, জিন্স, খাচাবন্দি সূর্য; এককথায় এমন চিন্তাই সুবোধ আমাদের মধ্যে উস্কে দিতে চায়। আর এই গ্রাফিতি ঘিরে জনপ্রতিক্রিয়া হল – আমিই সুবোধ, আমরাই সুবোধ। সুবোধের স্ট্রাগল গণতন্ত্রের অধিকারহীনতা থেকে, চেতনার সন্ত্রাস থেকে, খাদ্যের লাগামহীন বিনিময়মূল্য থেকে উৎসরিত। আমাদের প্রত্যেকেই এই আধিপত্যের শিকার। সুবোধ অবশ্য প্রশ্ন রেখে গেছে তার ট্যাগলাইনে। ‘হবে কি?’। এভাবেই সুবোধ ভাবাতে বাধ্য করে।
সুবোধের সাথেই আবির্ভাব ঘটে নাবিলার। লাল পোস্টারে সাদা ছাপায় লেখা ‘নাবিলা জানো? একজন মুমূর্ষ রোবটের জন্য রক্তের প্রয়োজন। রক্তের গ্রুপ ঘ+ (এন পজিটিভ)।’ রোবটের জন্য রক্ত। তবে কি রোবটের মতো প্রতিবাদহীন মানুষের জন্য করুণার বার্তা নিয়ে এসেছে এই স্টেনসিল। প্রযুক্তির মতো মানুষকে ব্যবহার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আস্ফালনকে আর একবার মনে করিয়ে দিয়ে গেলো।
সুবোধ এবং নাবিলার জন্ম হয়েছে এই শতকের দ্বিতীয় দশকে। যখন মানুষের সবচে’ বড় অসহায়ত্ব রাষ্ট্রীয় আধিপত্য। চেতনা সন্ত্রাসের সাথে যুক্ত হয়েছে প্রশ্ন ফাঁস, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, অহেতুক কর আরোপ, মানসিক দাসে পরিণত করা, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, ক্ষমতাসীনদের আগ্রাসী মনোভাব। আর এ বছরের মাঝামাঝি মহামারি হয়ে দেখা দিয়েছে ‘বন্দুকযুদ্ধ’র মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। তবে কি সুবোধ নাবিলারা দেশকে ভালোবেসে রাষ্ট্রদ্রোহী হবার উস্কানি দিচ্ছে?
সুবোধ আসলে আমাদের অধিকার নিয়ে ভাবাচ্ছে। মানুষকে ভেতর থেকে জাগাতে চাইছে। আবার যে আন্দোলন নির্ভর হয়ে সমাজ-দেশ বদলানোর উপযুক্ত সময় চলছে -এটাই বার বার করে মনে করিয়ে দিচ্ছে শৈল্পিক এই অস্ত্র দিয়ে।
এখন আর জনগণ জাগলে সেটা রাষ্ট্রদ্রোহ হবে না। সেটা হবে প্রতিরোধ যুদ্ধ। জনগণের প্রকৃত মুক্তির সংগ্রাম হবে এটা। সংগ্রামতো বায়ান্ন, ঊনসত্তর আর একাত্তরের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যায় নি। রাষ্ট্রে উন্নয়নপ্রীতির মধ্য দিয়ে ক্রমাগত কায়েম করা হচ্ছে ফ্যাসিবাদ। কাজেই সংগ্রামই এখন অধিকার আদায়ের একমাত্র পথ। প্রতিরোধ যুদ্ধই অবলম্বন।