ডলি বেগমের সংগ্রামী জীবনকথা

ডলি বেগমের সংগ্রামী জীবনকথা

আসছে ৭ ই জুন, কানাডার প্রাদেশিক নির্বাচনে একমাত্র বাংলাদেশি প্রার্থী ডলি বেগম। কে এই ডলি বেগম। কীভাবে তিনি এই জায়গায় পৌছালেন আজ সংক্ষেপে সেই গল্পটাই বলব।

সিলেটের মনু নদী পাড়ের মেয়ে ডলি বেগম। সংসারের সুখ ও সাচ্ছন্দ্যের আশায় তার বাবা মধ্যপ্রাচ্যের নানান দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাই জন্মের পর ডলি ও তার ছোট একটি ভাই তাদের বাবাকে খুব কম সময়ের জন্য পেয়েছিল। কয়েক বছর পর পর বাবার সাথে দেখা হতো। অবশেষে তার বাবার শেষ গন্তব্য হয়ে দাঁড়ালো কানাডার টরোন্টো নগরী। যখন তারা অভিবাসী হয়ে টরোন্টো নগরীতে বাবার বুকে এসে আশ্রয় পেলো অল্প কিছুদিন পরই তাদের সকল ভালোবাসা আর স্বপ্ন কর্পুরের মত উড়ে গেল।

তুষার ঢাকা শীতের এক সন্ধ্যায় বাবা ফিরছিলেন কাজ থেকে, বাসার একেবারে সামনে এসে যেই রাস্তাটা পেরুতে যাবেন, অমনি কোথা থেকে যেন ধেয়ে আসে একসারি গাড়ি। বরফে ঢাকা রাস্তায় কে কার থেকে বেশি জোরে গাড়ি ছোটাবে এই প্রতিযোগিতায় চালকেরা হয়তো এতটাই মত্ত যে খেয়ালও করল না কখন মেয়েটির বাবাকে পিষে ফেলেছে প্রথম গাড়িটা। চাকার নিচে মানুষের শরীর দুমড়ে দেয়ার ঝাকুনি যখন তাদের ছুটে চলা থামালো, ততক্ষণে বাবার মাথা থেকে শুরু করে পুরো শরীরের বেশিরভাগ প্রায় থেঁতলে গেছে। চারিদিকে মানুষ জমে গেল। ছুটে আশা অ্যাম্বুলেন্স আর ফায়ার ট্রাক এর লাল নীল আলোতে পুরো এলাকা জ্বলজ্বল। জটলার মানুষজন চিনতে চাচ্ছে গাড়ির চাকার নিচে আধা থেতলে যাওয়া মানুষটি কে। ঠিক তখনি রাস্তার অন্য পাশ দিয়ে মায়ের হাত ধরে হেটে বাড়ি ফিরছিলো ডলি। জটলার কিছুটা কাছাকাছি এসে অন্য অনেকের মতোই মা ও একটু উঁকি দিলেন কি হয়েছে দেখার জন্য। মুহূর্তেই তাঁর পৃথিবী দুলে উঠল। পথের উপরই বসে পড়লেন তিনি। চোখের সামনের সব কিছু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে উঠলো তার।

অষ্ফুট শব্দে তিনি শুধু বলতে পারলেন ‘তোর আব্বা!’ আর ওই দুটি কথাতেই মেয়েটির সাজানো স্বপ্নগুলো মুহূর্তেই যেন বিবর্ণ হয়ে গেল।

এর পরের কয়েকটি বছর যেন মরণের সাথে জীবনের যুদ্ধ। হাসপাতালে ডাক্তাররা বললেন এই থেঁতলে যাওয়া মানুষটিকে বাঁচানো কঠিন। দলে দলে লোক দেখতে এলেন, মনে মনে হয়তো শেষ বিদায়ও জানিয়ে গেলেন। এভাবেই কয়েকদিন, এরপর শুধু তারা ৩ জন। ১২/১৩ বছরের ছোট্ট সেই মেয়েটি, আরো ছোট্ট তার ভাইটি, আর অভাবিত এই দুর্ভাগ্যের ধাক্কায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় তাদের মা। পুরো দিন তিনি সেইন্ট মাইকেল হাসপাতালে স্বামীর পাশে বসে থাকেন, সন্ধ্যায় ফেরেন। দিনের বেলায় তাই ১২/১৩ বছরের সেই ছোট্ট মেয়েটিকেই হতে হলো ঘরের কত্রী। নিজের আর ভাইয়ের লেখাপড়া, খাওয়া দাওয়া, দু’ ভাই বোন হাত ধরে মাথা হেট করে চুপচাপ স্কুলের অপরিচিত জগতে টিকে থাকার লড়াই চলতে থাকল। লড়াই কেন বললাম? একটি ছোট উদাহরণই দেই। ধার্মিক বাবা-মায়ের ইচ্ছায় মাথায় স্কার্ফ পরতো মেয়েটি। একদিন স্কুলের দুষ্ট ছেলের দল তার স্কার্ফটি টান দিয়ে খুলে নিল। তা দিয়ে কাপড়ের একটি বল বানিয়ে নিজেরা একজন আরেকজনের দিকে ছুঁড়ে দেয়ার খেলায় মাতলো। ভয়ে আড়ষ্ঠ মেয়েটি এক কোণায় স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তার ছোট্ট ভাইটি সেই ছুঁড়ে দেয়া স্কার্ফের বলটি উদ্ধার করে আনার জন্য ওর পিছু পিছু ছুটছে। দুজনের চোখ গড়িয়ে অশ্রুধারা, নাকি এ সেই ফেলে আসা মনু নদীর কান্না? দুঃসহ সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে সেদিনের সেই ছোট্ট (আর আজকের সফল যুবক) ভাইটির চোখ এখনও চোখ ছলছল হয়ে আসে। গ্রামের সহজ-সরল গৃহবধু মা ইংরেজি বলতে পারতেন না। হঠাৎ ব্যাংক থেকে টাকা তোলা অথবা হাসপাতালে নার্সের কথা বোঝা, এই সবে সেই ছোট্ট মেয়েটির ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিই ছিল তাদের ভরসা।

যাইহোক, কখনো স্কুলের চাপ, কখনো বাবার অনুপস্থিতিতে দিশাহারা, কখনো অজানা এক ভাষায় লেখাপড়া রপ্ত করার প্রানান্ত চেষ্টা, এইসব মিলিয়ে যখনই ভাই-বোনের প্রাণ অস্থির, তখন তাদের আশ্রয় ছিল বাসার আশেপাশের ছোট্ট পার্কগুলো। স্কুল থেকে ফিরে ভাইবোন দুজন সেখানে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা হাত ধরে বসে থাকতো, মা হাসপাতাল থেকে কখন বাসায় ফিরবেন এই অপেক্ষায়। ইন্সুরেন্স কোম্পানিও জবাব দিয়ে দিয়েছে, নিউ ইমিগ্র্যান্ট বাবার নাকি ‘ফিউচার আর্নিং পোটেনশিয়াল’ বেশি ছিল না, তাই ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা খরচ বাদ দিলে বাড়তি তেমন টাকাও তারা পাবে না। মাস পেরিয়ে বছর গড়ালো। প্রায় আড়াই বছর হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যায় থেকে এরপর বাবাকে পাঠানো হল পুনর্বাসন পর্যায়ে। জীবন যুদ্ধের এই মোড়ে এসে যেন আমাদের সেই ছোট্ট মেয়েটি হঠাৎ নিজেকে খুঁজে পায়। সে নিজেই নিজেকে গড়ার যাত্রা শুরু করে। তাকে যে সময়ের চেয়ে দ্রুত বেড়ে উঠতে হবে, তার ভাইটির জন্য, মায়ের জন্য, বাবার জন্য। হেরে যাবার জন্য যে তার জন্ম হয়নি! লেখাপড়ায় আর স্কুলের নানান কর্মকান্ডে নিজেকে ডুবিয়ে দিল। পড়াশোনা, খেলাধুলা, স্কুলের নানান ক্লাবের নেতৃত্ব ইত্যাদি কারণে এক বছরে জিতে নেবার মতো যতগুলো পুরস্কার ছিল, তার সবই জিতে নিল। নানান সমাজকল্যাণ মূলক কর্মকান্ডে অবদানের জন্য সে জিতে নিয়েছিল প্রাদেশিক সরকারের দেয়া অত্যন্ত সম্মানজনক ‘অন্টারিও ভলান্টিয়ার সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড’।

ভালো ফলাফলের কারণে সুযোগ পেল বিশ্বসেরা ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টো সেইন্ট জর্জ এ। নিজে যে কঠিন বাস্তবতা পার করে এসেছে, তার চেয়ে ভালো আর কে জানবে অল্প আয়ের পরিবারগুলোর কষ্ট? ঝাঁপিয়ে পড়ল সে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, টিউশন ফি কমানোর আন্দোলন, ছাত্রদের নিরাপত্তাসহ নানান অধিকার আন্দোলন, সবক্ষেত্রেই তার সদর্প পদচারণা। সাফল্যের সাথে গ্রাজুয়েশন শেষ করার পাশাপাশি মেয়ে শিশুদের লেখাপড়ায় ধরে রাখা বিষয়ে গবেষণা করতে ছুটে গেল তার শেকড়ের কাছে, বাংলাদেশের সিলেটে। সেই গবেষণা প্রকাশিত হল ইউনিভার্সিটির জার্নালে। এলো ইংল্যান্ডের বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইউ.সি.এল থেকে উচ্চতর শিক্ষার ডাক। সেখান থেকেও সাফল্যের সাথে সে অর্জন করলেন মাস্টার্স ডিগ্রী। এরই মধ্যে ছুটে গেলেন আফ্রিকার ইথিওপিয়ায়, দুঃস্থ মানুষের সেবায়, চাকরি শুরু করলেন পুরো উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বড় প্রফেশনাল ইউনিয়নগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনে রিসার্চ অফিসার হিসাবে। এই টরন্টো শহরের ওয়ার্ডেন উডস এর মতো বিশাল সমাজ কল্যাণ সংস্থার ভাইস-প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন, পাশাপাশি কো-চেয়ারপারসন হিসাবে দায়িত্ব নিলেন স্বাস্থ্য খাতে নিবেদিত স্কারবোরো হেলথ কোয়ালিশন এর, বিখ্যাত যুব সংগঠন ‘পাওয়ার ইউনিট ইয়ুথ অর্গানাইজেশন’ এর প্রথম বাংলাদেশী প্রেসিডেন্ট হলেন।

আজ ডলি কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের জোরে লড়াইয়ে নেমেছেন জনপ্রতিনিধি হবার জন্য। প্রকৃত জনকল্যাণে কঠোর পরিশ্রম করে নিজেকে প্রমাণ করেই সে নির্বাচনের মনোনয়ন পেয়েছে। আশাকরি, অন্টারিওর টরোন্টোবাসী প্রবাসীরা ডলিকে জোর সমর্থন জানাবেন। এই সংগ্রামের তিনি সাফল্য পাবেন এটাই আশা করছি।