সৈয়দ মুজতবা আলী •
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অদ্ভুত যোগোযোগের ফলে অনেক তথ্য ও অনেক প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়েছে। শুনেছিে র্যোন্টগেনের রঞ্জনরশ্মি আবিষ্কার, ফ্যারাডোর বৈদ্যুতিক শক্তির আবিষ্কার এ রকম যোগযোগের ফল। সাহিত্যে এ রকম ধারা বড় একটা হয় না। শুধু ছোটগল্পের বেলা তাই হয়েছে। কিন্তু একথাও স্মরণ রাখা উচিত যে, র্যোন্টগেন ও ফ্যারাডে যদি বহু বৎসর ধরে আপন আপন জ্ঞানচর্চায় নিবিষ্ট না থাকতেন, তাহলে যেসব যোগাযোগের ফলে রঞ্জনরশ্মি ও বৈদ্যুতিক শক্তি আবিষ্কার হল, সেসব যোগাযোগ বন্ধ্যাই থেকে যেত। ছোটগল্পের বেলাও তাই মোপাসাঁ যদি সাহিত্য সাধনায় পূর্বের থেকেই নিযুক্ত না থাকতেন, তবে ফ্লাবেরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ সম্পূর্ণ নিষ্ফল হত।
ফ্লবের যে কী অদ্ভুত সুন্দর ফরাসি লিখে গিয়েছেন, তার বর্ণনা দিতে পারেন শুধু ফ্লবেরই। ভলতেরের পরেই ফ্লবেরের নাম করতে হয় এবং এঁদের মাঝখানে যে কোনো দ্বিতীয় শ্রেণির লেখক পেলেও বাংলা ভাষা বর্তে যাবে। আর ফ্লবেরের আশা শিকেয়ে তুলে রাখাই ভালো, তাঁর মতো লেখক জন্মাবার পূর্বে এদেশের গঙ্গায় বিস্তার চড়া পড়ে যাবে। তার কারণ এ নয় যে আমাদের দেশে শক্তিমান লেখকের অভাব, বেদনাটা সেখানে নয়, আসল বেদনা হচ্ছে আমাদের লেখকেরা খাটতে রাজি নন। ফ্লবেরের লেখা পড়ার সময় বোঝাই যায় না তার পিছনে কী অসম্ভব পরিশ্রম রয়েছে, কারণ সে পরিশ্রমের উপর ফ্লবেরকে আরও পরিশ্রম করতে হয়েছে গোড়ার পরিশ্রমটা ঢাকবার জন্য। ভলতেরের সরল স্বচ্ছ শৈলীর প্রশংসা করলে তিনি নাকি করুণ হাসি হেসে বলতেন, ‘ফরাসি জাতটা কি আর জানে তাদের কষ্ট বাঁচাবার জন্য আমি নিজে কতটা কষ্ট স্বীকার করি?’
ফ্লবের এ কথাটা বললে মানাত আরও বেশি- তিনি তো শেষটায় সে পরিশ্রম সইতে না পেরে লেখাই ছেড়ে দিলেন।
ধুয়ে মুছে কেচে ইস্ত্রি করে পাট না করা পযন্ত ফ্লবের ভাষাকে রেহাই দিতেন না। তাই যখন শাগরেদ মোপাসাঁর ভিতর ফ্লবের গুণের সন্ধান পেলেন তখন মোপাসাঁর লেখার ওপর নির্মম র্যাঁদা চালাতে আরম্ভ করলেন। আর কী সব অদ্ভুত ফরমায়েশ- দশ লাইনে করুণ বর্ণনা লেখ, পনেরো লাইনে বীররস বাৎলাও, এটা ছিঁড়ে ফেল দাও, ওটা ছাপিয়ো না- অর্থাৎ ফ্লবের শাগরেদ মোপাসাঁকে ধুয়ে মুছে কেচে তৈরি করে প্রায় পকেটস্থ করে ফেলেছেন, এমন সময় তাঁর ডাক পড়ল সেই লোক থেকে যেখানে রসসৃষ্টি করা যায় বিনা পরিশ্রমে- স্বর্গলোকে পরিশ্রম নেই বলেই মর্তলোকের সৃষ্টি হয়েছিল এ কথা বাইবেলে লেখা আছে।
এই তালিমের ফলেই ছোটগল্পের সৃষ্টি। মোপাসাঁর পূর্বের লেখকরা কি বর্ণনা, কি চরিত্র-বিশ্বেষণ, কি ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত সবকিছুই লিখতেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। ছোটগল্প লিখতে হলে যে বাকসংযম দরকার, বিস্তর কথা অল্প কথায় প্রকাশ কররাব যে কেরামতির প্রয়োজন, প্রকাণ্ড আলোটার চতুর্দিক কালো কাপড়ে ঢেকে তার সামনের দিকে পুরু কাচ লাগালে যে রশ্মির তীব্রতা বাড়ে সেই জ্ঞান মোপাসাঁর পূর্বে কারও ছিল না, অথবা তাই নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন কেউ অনুভব করেন নি। সর্বাঙ্গ বেনারসিতে ঢেকে মুখ থেকে শুধু ঘোমটা সরিয়ে ফিক করে এক ঝলক হেসে সুন্দরী চলে গেল- মোপাসাঁর পূর্বে ফরাসিরা যেন এ অভিজ্ঞতার কল্পনাই করতে পারেননি। তাঁদের কায়দাটা কী ছিল সে কথা ফেনিয়ে বলার সাহস আমার নেই- কলকাতা এসব বাবদে প্যারিসের মতো ‘উদার’ নয়।
এসব নিছক যোগাযোগের কথা। মোপাসাঁর আপন কৃতিত্ত্ব তবে কোনখানে? গল্পটাকে বিশেষ এক জায়গায় এনে আকষ্মাৎ ছেড়ে দেওয়া, এবং সেই আকস্মাৎ ছেড়ে দেওয়াটাই গল্পের সম্পূর্ণতাকে প্রকাশ করল– ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ক্লাইমেকস্’– এখানেই মোপসাঁর বিশেষত্ব। মোপাসাঁর পূর্বের ঔপন্যাসিকেরা তাবৎ নায়ক-নায়িকাদের জন্য একটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত না করে উপন্যাস বন্ধ করতেন না। নটে গাছটি তাঁর এমনি কায়দায় মুড়তেন যে, পাঠকের মনে আর কোনো সন্দেহ থাকত না যে এদের জীবনে আর কিছু ঘটতে পারে না, এরা এখন থেকে ‘পুত্র কন্যা লাভ করতঃ পরমানন্দে জীবন যাপন করিল’ অথবা ‘অনুতাপের তুষানলে তিলে তিলে দগ্ধ হইতে লাগিল!’।
ক্লাইমেকস্ আবিষ্কার মোপাসাঁর একান্ত নিজস্ব। মোপাসাঁর পর বিস্তর লেখক এন্তার ছোটগল্প লিখেছেন, কেউ কেউ মোপাসাঁর চেয়েও ভালো লিখেছেন; কিন্তু অস্বীকার করবার উপায় নেই যে সব গল্পই মোপাসাঁর ছাঁচে ঢেলে গড়া। মোপাসাঁ যে কাঠামোটি গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই কাঠামোটিতে কোনো ফেরফার করার সাহস করারোরই হল না।
চেখফই (Chekhov, Tschehoff) ইত্যাদি নানা বানানে নামটি লেখা হয়, কিন্তু উচ্চারণ ‘চেখফ্’) প্রথম এই কাঠামোতে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে ক্লাইমেকস্ বাদ দিয়েও সরেস ছোটগল্প লেখা যায়। শুধু তাই নয়, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে খুব কম ঘটনাই এ রকম ধারা ‘বুমস্-প্যাঙ’ করে সশব্দে ক্লাইমেক্সে এসে অরকেস্ট্রা শেষ করে। চেখফের অনেক গল্প ক্লাইমেক্সে শেষ হয় সত্য; কিন্তু সেটা গল্পের নিজস্ব প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। সব গল্পই যদি পাঠক ক্লাইমেক্সের প্রত্যাশা করে করে পড়ে, তবে সেগুলো একঘেয়ে হয়ে যেতে বাধ্য– সব কবিতাই তো আর সনেট নয় যে শেষের ছত্রে কবিতার সারাংশ জোর গলায় বলে দেওয়া হবে। তাই চেখফের বহু ক্লাইমেকস-বর্জিত গল্পের ভারকেন্দ্র এমনভাবে সমস্ত গল্পে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে যে, পাঠক রসিয়ে রসিয়ে নিশ্চিন্ত মনে গল্পগুলো পড়তে পারে– ক্লাইমেক্সের আচমকা ইলেকট্রিক শকের জন্য নাক-কান খাড়া করে থাকতে হয় না।
আর ভাষার দিক দিয়ে চেখফ্ মোপাসাঁকেও ছাড়িয়ে যান। টলস্টয় ফ্লবেরের চেয়ে অনেক বড় স্রষ্টা এবং চেখফ্ যদিও টলস্টয়ের শিষ্য নন তবু তিনি বহু বৎসর ধরে টলস্টয়ের সাহচর্য ও উপদেশ পেয়েছিলেন। টলস্টয় স্বয়ং গোর্কির চেয়ে চেখফকে পছন্দ করতেন বেশি– তিনি নাকি একবার গোর্কিকে বলেছিলেন, চেখফ্ মেয়ে হলে তিনি তাঁর কাছে নিশ্চয়ই বিয়ের প্রস্তাব পাড়তেন।
রবীন্দ্রনাথের গোড়ার দিকের গল্পগুলো বড় ঢিলে। প্রমাণ করা কঠিন, কিন্তু আমার মনে হয়, এই ঢিলের ভাব তাঁর প্রথম কাটল মোপাসাঁর গল্পের সঙ্গে পরিচিতি হওয়ার পর। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মোপাসাঁর মতো ঠাস-বুনুনি দেখতে পাওয়া যায়, আর কাঠামোটাও হরেদরে মোপাসাঁর। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো লেখক আপন বৈশিষ্ট্য বর্জন করে লিখবেন– তা সে কাঁচা লেখাই হোক আর পাকা লেখাই হোক– সেকথা অনায়াসে অস্বীকার করা যায়। রবীনাথের গল্প মোপাসাঁ-চেখফ্ দুজনের গল্পকেই হার মানায় তার গীতিরস দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত গল্পটি কেমন যেন সংগীতের কোনো এক রাগে বাঁধা। এখানে সংস্কৃত নাটকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মিল রয়েছে। মৃৎশকটিকা, শকুন্তলা, রত্নাবলি নাটক গ্রিক কাঠামোতে ফেলা যায় সত্য; কিন্তু এগুলোতে যে গীতিরস রয়েছে, গ্রিক নাটকে তা নেই– তাই আমরা সংস্কৃত নাটকে যে আনন্দ পাই, গ্রিক নাটকে সেটি পাইনে।
রবীন্দ্রনাথ বিশেষ বয়সে শেলি-কিটসের প্রভাবে পড়েছিলেন সত্য, কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য, রবীন্দ্রনাথ সে প্রভাব একদিন সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন। গল্পের বেলাতেও রবীন্দ্রনাথ একদিন মোপাাঁর প্রভাব ঝেড়ে ফেলে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শেষের দিকের গল্পগুলোতে কী যেন এক অনির্বচনীয়ের প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। ‘মিস্টিক’ কথাটাতে সবকিছুই ঢাকা পড়ে যায় বলে শব্দটা ব্যবহার করতে বাধো বাধো ঠেকে। কিন্তু মানবচরিত্রের আলো-অন্ধকারের আবছায়া আঁকুবাঁকু, মানব-চরিত্রের যে দিক দৈনন্দিন জীবনে যায় না মানুষের সেই দুর্জ্ঞেয় অন্তস্তল রবীন্দ্রনাথ চেষ্টা করেছিলেন আধা-আলোরই ভাষা এবং ভঙ্গি দিয়ে প্রকাশ করতে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ একা, মোপাসাঁ-চেখফের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র সেখানে সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।