নব্বইয়ের দশকটা নানবিধ কারণেই আমাদের মনের বিশাল একটা জায়গা দখল করে রেখেছে। ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণে আটকে যাওয়া বর্তমান সময় আর নেট পূর্ববর্তী নব্বইয়ের দশকটার মাঝে আকাশ পাতাল তফাত।
আমার চোখে নব্বইয়ের সবচেয়ে বড় আবেদন ছিল একান্নবর্তী পরিবারগুলো। এর চল বহু আগে হলেও নব্বইয়ের দশকই শেষ, যে এই একান্নবর্তী পরিবারের জৌলুশটা ভোগ করেছে। ‘আমার’ এর বদলে তখন সবই ছিলো ‘আমাদের’। পক্ষে-বিপক্ষে বহুমত, যুক্তি-তর্ক আসতে পারে তবে নব্বইয়ের একান্নবর্তী পরিবারের স্বাদ যারা পেয়েছেন তাদের কাখে এখনো সেটি ‘মধু মধু’। সাঁঝ বেলায় বিদ্যুতের লোডশেডিংটা তখন ছিলো নেয়ামত। পুরো পরিবার হৈ হুল্লোড় করে বাড়ির উঠানে, ছাদে কিংবা পুরো পাড়ার সবাই মিলে খোলা মাঠে জামায়েত হওয়াটা ছিলো সাধারণ এক দৃশ্য। ভাব ভালোবাসার আদান-প্রদান, গালগপ্প কি হতো না সেই সময়? আসর করে পুঁথিপাঠের দৃশ্যও দেখা যেত। তখন ইট পাথর শহুরে জাঁকিয়ে বসেনি। তাই প্রায় সব মহল্লাতেই পুকুর ছিল। ভরা পূর্ণিমার রাতে পুকুরে না নামার পাপ সজ্ঞানে কে করেছে বলুন?
হারিয়ে গিয়েছে, সবই ঠাঁই নিয়েছে স্মৃতির জংধরা সেলে। এখনকার অভিবাবকরা তো ভীষণ সচেতন। এতটাই যে, ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সাথে মূল প্রশ্নের মিল কেন নাই, সেইটা নিয়ে প্রধান শিক্ষকের অফিস পর্যন্ত ঘেরাও করতে দুবার ভাবেন না তারা। তখন, অবশ্য এত সচেতনতা ছিল না। পরীক্ষার আগে মায়েরা একটা ফরমান জারি করতো আর পরীক্ষা শেষে পিতাজিরা হাজির হতেন পুলিশ সুপারের ভুমিকায়। পরীক্ষা চলাকালীন পুরো একমাস ডিমের ওপর জারি হতো মৌখিক নিষেধাজ্ঞা। তাতে, পরীক্ষার্থীর ফলে কি প্রভাব পড়তো তা তো জানার সুযোগ হয় নাই, তবে এই এক মাস মুরগিরা নিজেদের ফিগারের যত্ন নেয়ার একটা সুযোগ পেত। আর রেজাল্ট শেষে গোঁফে তা দিয়ে পিতামশাই যখন বেত হাতে হাজির হতেন গৃহ রিমান্ডে অপরাধীর শাস্তি দেয়ার জন্য, সেটাও ছিল মজার এক দৃশ্য। যতক্ষণ পর্যন্ত পিতার শত্রুর কোনো সন্তান আসামির চেয়ে খারাপ রেজাল্ট করেছে এটা আসামি নিশ্চিত করে না বলতে পারত ততক্ষণ পর্যন্ত জারি থাকত রিমান্ড। ফেল করা তখনই জায়েজ যখন পিতার শত্রুর সন্তান আরো একটি বেশি বিষয়ে ফেল করেছে তখন!
এই রিমান্ড বা মুরগির ফিগার ঠিক রাখার ক্ষেত্রেই কৈশোর আটকা থাকত না। বরং পুরো দিন দেখা যেত মাঠ দাপিয়ে বেড়াতে। ডাংগুলি, মার্বেল, বৌছি, সাতচাড়া, দাড়িয়াবান্ধা, হাডুডু, গুলতি নিয়ে পাখি শিকার, কানামাছি কতশত খেলার চল যে তখন ছিল তার ইয়ত্বা নেই। এত সব খেলা খেলো বইয়ের সাথে সখ্য গড়বার ফুসরত মিলত কমই। তবে সবাই যে এমনটা করেছে তা না। অনেকেই তখনো পদার্থ বিজ্ঞান, গণিত, রসায়নের রস বের করে ছেড়েছিল দিন রাত পড়ে। অভিবাবকরা অসচেতন ছিলেন এই কথা যদি বলতে চান আমি আপত্তি জানাবো। তখনকার অভিবাকরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সাথে মূল প্রশ্নের কেন মিল নেই সেই ক্ষোভে প্রধান শিক্ষককে অন্তত ঘেরাও করেননি।
সবচেয়ে মজার ছিল ভরা বাদলার দিন। কাঁদা মাঠে ফুটবল, ভেলায় চড়ে ভ্রমণ, হাত বড়শিতে মাছ ধরা, ব্যাঙের বিয়ে দেয়া, আহ্ সেই সময়। তবে, বাদলার দিনে যে শুধু এটুকুতেই আনন্দ সীমাবদ্ধ থাকতো তাও না। বাইরে বৃষ্টির শব্দ আর হেঁশেলের চুলায় ভুনা খিচুড়ি চড়বে না, এ তো অসম্ভব। ভুনা খিচুড়ি, মাংস আর বেগুন ভাজা; অমৃত, অমৃত। এখনও যে হয় না তা না, তবে অনেক ক্ষেত্রেই এ খিচুড়ির জনম হয় কোনো হোটেলের হেঁশেলে। গিন্নীর আবার সিরিয়াল দেখার তাড়া আছে কি না? বাহিরে আপনি যতই হম্বিতম্বি করুন এই জায়গায় সবাই কেমন যেন মেছো বেড়াল হয়ে যান।
নব্বইয়ের কথা যখন উঠল, তখন আরো একটি বিষয়ের জিকির না করে পারছি না। সিনেমা। এই সিনেমা যে কি জিনিস তা নব্বইয়ের আদমিরা ছাড়া কেউ বুঝবে না। সবাই মিলে টাকা দিয়ে ভিসিআর আর দুইটা ‘বই’ এর ক্যাসেট জোগাড় করে পুরো দিন চলত তা দেখার প্রস্ততি। সাঁঝ বেলায় উঠোনে পুরো মহল্লা এক হয়ে যেত এই বই দেখার জন্য। আমরা তো এখন রুপ রস খুজে বার করতে অক্ষম। বই দেখত তখনকার মানুষেরা। নায়িকা বাবার সাথে অভিমান করে নায়কের সমান লম্বা কোলবাশিকে জাপটে ধরে কেদেছে কি কাদেনি, দর্শক সারিতেই উঠতো কান্নার রোল। ছোট্ট একটা প্রশ্ন আজীবনই জ্বালাতন করেছে, কান্নার সময় নায়িকাদের কোলবালিশই লাগত কেন? যাই হোক, নায়িকার সে কান্নার আওয়াজ বহুদূরে থাকা নায়ক বাবাজির কানে ঠিকই পৌঁছে যেত। আর দেরি কিসের? চৌধুরী সাহেবের সামনে বদলা নিতে নায়ক হাজির। দর্শকদের তখন যদি একবার দেখতেন! পারলে চৌধুরীর চৌকাঠ ভেঙ্গে নায়িকাকে তারাই উদ্ধার করে আনে। একটা বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বয়ান করি। এক ‘বেদের মেয়ে জোৎস্না’ দেখে আমারই দশ-বারোজন আত্মীয় সিরিয়াল ধরে হুশ হারিয়েছিলেন! বুঝুন হালত!
জোৎস্নার কথা যখন আসলো, প্রেমের কথা আসতে বাধ্য। তখনকার প্রেম তো আবার ডিজিটাল ছিল না। পত্র মিতালিই ছিল একমাত্র পথ। ভুলে চুকে পত্র যদি পাত্রীর বদলে পিতার হাতে পড়তো প্রেমিক বরের অবস্থা কি হতো আন্দাজ করাই যায়। জেল জরিমানা বা হুমকি ধামকি না, সরস পিতারা বেছে নিতেন ভিন্নপথ। কন্যার নিকার বন্দোবস্ত করে সেই প্রেমিককেই বলতেন, তোমার বোনের তো নিকাহ ঠিক, তোমাকে ছাড়া তো আর কাউকে পাই না ভরসা করার মতো। নিকাহর পুরো দিকটা তুমি সামাল দিও বাবা! একে তো প্রেমিকার নিকাহ, তার ওপর বড়ভাইয়ের অসহনীয় সম্মোধন; না তখনো বিদ্রোহের বীজটা তেমন বড় হয়নি। তাই মুখ চুন করে প্রেমিক বড় বিরস বদনে বিসর্জন দিত প্রেমিকার স্বপ্ন। সবাই যে গোবেচারা ছিল তাও না। অনেকে আবার এর বিকল্প হিসেবে লেবুর রস দিয়ে চিঠি লেখার পন্থা আবিষ্কার করেছিলেন। সেটি অবশ্য মাঠে মারা পড়েছিল চিঠি পাঠের উপায় সম্পর্কে পাত্রীর জ্ঞানের অভাবে। অনেকে তো মশকরা ভেবে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ করে দিয়েছিল!
যুবা সমাজের চেয়ে কম সরস ছিল না বাকিরাও। এখন তো বৎসরে একদিন পালন হয় ভালোবাসা দিবস হিসাবে। তখন, এই একদিবসীয় ভালোবাসা সূচনার প্রারম্ভ কাল। সে যুগের বিবাহিতরা এসবের থোড়াই কেয়ার করতেন। প্রতিটি দিন হতো ভালোবাসার, প্রেমময়। যার নতুনা হিসেবে ফি বছর একটা সুসংবাদ শুনতো সকলে। এই একদিবসীয় ভালোবাসাটা পেয়ার মহব্বতে ভাটার টান এনে দিয়েছে।
এখন আরো একটি নব্য প্রথা দেখা যায়, ‘হাত খরচ’। তখন আর যাই হোক হাতের জন্য আলাদা খরচ বরাদ্দ ছিল না। কোনো দিক দিয়ে মেরে কেটে জমানো টাকাটাই হতো সম্বল। দশ আনা, পঁচিশ আনা, পঞ্চাশ পয়শার লজেন্সগুলো ছিলো অমৃত। বিশ্বাস করুন, এখনো মুখে লেগে আছে দশ আনার নারকেলের লেই লজেন্সের স্বাদ। আর কাঠফাটা রোদে ১ টাকার পাইপ আইস্ক্রিম। এটার শুরুর দিকের দামটা ঠিক কত ছিলো মনে নেই। আরেক জিনিস ছিল হাওয়াই মিঠাই। এখন তো প্যাকেটে করে ফেরিওয়ালারা কাঁধে ফেরি করে বিক্রি করেন এটি। তখন দেখা যেত পুরো মেশিন পত্তর সহই এলাকায় হাজির হতেন তারা। তৈরি থেকে শেষ পর্যন্ত, পুরো প্রক্রিয়াটা দেখা ছিল এক এলাহী কারবার।
বাক্সবন্দি শৈশব বলতে আমরা এখন যা দেখি তখন তো সেটি ছিল না। একক সত্ত্বার যে চিত্র সেটিও ছিল কল্পনাতীত। বৃদ্ধ বলুন বা কিশোর, সবারই ছিল নিজেদের গ্রুপ। সুখ দুঃখ থেকে সব কিছুই ভাগাভাগি হত সবার মাঝে। মোবাইলের তখন এমন প্রভাব না থাকায় যোগাযোগ হত পত্রে পত্রে। ফিরতি পত্র পাঠ করার দৃশ্যগুলোও ছিল মজার। পত্র পাঠক মাঝে, গুরগম্ভীর ভঙ্গিমায়। তার চারপাশে গোল হয়ে সবাই শ্রোতা। পত্রের কোনো এক অংশ শুনে সবাই হাসছে, ত কোনো অংশে হয়ে পড়ছে আবেগপ্রবণ। রুপকথার গল্পই মনে হয়ে এখন পেছনে ফিরে দেখলে।
নব্বইয়ে গ্রামাঞ্চলে একটি কমন দৃশ্য ছিল। দলবেধে ছাত্ররা বই হাতে হেটে যেত স্কুলের দিকে। পথিমধ্যে কোন আমগাছের আম যদি দীপিকার রুপ নিয়ে টিজ করার চেষ্টা করছে, রক্ষা নাই। বই মাটিতে রেখে তরতর করে গাছে উঠে দীপিকাকে যে কোনো মূল্য ছিনিয়ে নিতেই হবে। তা করতে গিয়ে স্কুলের খানিকটা দেরি হলেও ক্ষতি নাই। এখনকার হালত পুরাই উল্টা। ব্যাগের চাপে গুজো শিক্ষার্থীর সুযোগ কই ওপরে তাকিয়ে দীপিকার রুপ দেখার? বইয়ের চাপে আধাকুজো হয়ে যাচ্ছে জন্ম থেকেই।
নব্বইয়ের আরেক মধুর স্মৃতি নিকাহ। পাড়া মহল্লায় নিকাহ যারই লাগুক মনে হত সবাই যেন আনন্দে মুখর। দিনরাত হৈ-হুল্লোড়। টাশকি খাইতেন জামাই বেচারা। বারাত নিয়ে আসার পর একসাথে এত শালা-শালী দেখে বান্দা চোখে সর্ষের ফুল দেখতেন তিনি। পাশে থাকা বন্ধুকে কনুই মেরে জিজ্ঞাস করতেন, কি রে? মেয়ারা তো শুনেছিলাম দুই ভাইবোন। কথা থেকে বিয়ের মাঝের সময়টাতে শশুর শালা এতোগুলার প্রোডাকশন দিল কিভাবে? এখনও নিকাহ হয়। বিচিত্র স্টাইলে। হলুদের রাত্রে শরাব ছাড়া আবার এ বিয়ে কবুল হয় না। শরাবের তালে ভজপুরি নৃত্যে ইজ্জতের দফারফা করেই শেষ হয় এই সময়ের নিকাহ।
কত কি মনে পড়ে। বায়োস্কোপ, কটকটি, তারাবাতি কুকুরের লেজে বেঁধে দেয়া, মুরগি চুরি করে গেরস্তকে দাওয়াত দিয়ে সে মুরগি ভক্ষণ। আহ্, সেই সব দিনগুলো। আগে একসাথে টিভি দেখতে বসলে প্রেমিক প্রেমিকার আবেগী ডায়ালগেই কিশোররা মুখ লুকাতো। এখন তো আরেকটু হলে কিসিংয়ের মাঝে সব মিসিং হবার যোগাড়। হায়ার হায়াৎ শেষ। এখন সময় বেহায়াদের।
এটা বলবো না যে, নব্বইয়ের সবই সহীহ ছিল। কিন্তু যতটুকুই ছিল যথেষ্ট ছিল ইয়াদ করে আফসোস করার জন্য।