বাংলার আসমান এখন আর নীল নেই। ইট-পাথরের গাঁথুনি ভেদ করে উর্ধ্বপানে চোখ তুলে তাকালে নীল অম্বরের বদলে চোখে পড়ে বাহারি রঙের পতাকা। নিশ্চুপ স্বরে যেন জানিয়ে দেয়, এসে গিয়েছে ফুটবল বিশ্বকাপ।
পাড়ার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সুরম্য অট্টালিকায় সুবিন্যস্ত কেশের অধিকারি কেউকেটাসহ সকলেই এই বিশ্বকাপ জ্বরে আক্রান্ত থাকবে একটি মাস। পাল্লা দিয়ে বিকোবে পতাকা, জার্সি। আশ্চর্যই বটে; যে দেশটি কখনো বিশ্বকাপের প্রাক-বাছাই পর্বই পার হতে পারে না, ফুটবল নিয়ে তাদের এই উন্মত্ত উন্মাদনা; না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
বিশ্বকাপ প্রসঙ্গের অবতারণা করে শুরু করলেও আমার আগ্রহের মূল বিষয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বাফুফে। বিশ্বকাপের মাঝে এমন অথর্ব একটি সংস্থা নিয়ে অাগ্রহী হওয়ার কারণও রয়েছে বৈকি। যে দেশটির মানুষ ফুটবল দেখার জন্য সাধের ঘুমকে হারাম করতে পারে, নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে ভিনদেশের পতাকা বানিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়; সে দেশটি ফিফার র্যাংকিংয়ে ১৯৭তম স্থানে কেন থাকবে?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে সামর্থ্যের বেহাল দশায় দিশাহীন অবস্থায় রয়েছে ফুটবল। কথাটা এক প্রকার সত্যও বটে। ভুটানের কাছে যে দল ভূপাতিত হয় তাদের আদৌ সামর্থ্য আছে কি না সে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে সামর্থ্যের সাথে সাথে সংগঠকদের ভূমিকাও ভাববার মত। ভুটান বিপর্যয়ের পর একটি বছর আন্তর্জাতিক ম্যাচের বাইরে থাকার অদ্ভুত সিদ্ধান্ত যে বোর্ড নিতে পারে তাদের কর্মকান্ড কিছুটা হলেও খতিয়ে দেখা উচিত।
মাত্রই কিছুদিন আগে বাফুফে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের জন্য কোচ নিয়োগ দিয়েছে। নব্য নিয়োজিত কোচ জেমি ডে’র যোগ্যতা সম্পর্কে যা জানা যায় তা হল– ভদ্রলোক জাতীয় দলের কোচ হবার পূর্বে ইংল্যান্ড এর পঞ্চম স্তরের একটি দলের সহকারী কোচ ছিলেন! বিস্ময়কর বটে। তবে, বাফুফের অতীত কর্ম বিবেচনায় বিষয়টিকে পুরোপরি বিস্ময়কর বলা যাচ্ছে না। কারণ, এর আগে শুধু বিখ্যাত এক খেলোয়াড়ের পাশে নিজের হাস্ব্যোজ্বল বদন এর ফটক দেখিয়ে কোচের কর্ম বাগিয়ে নিয়েছিলেন এক ভদ্দরলোক। সে তুলনায় ডে’র বায়োডাটাকে সমৃদ্ধই বলা চলে।
বাকি সব বাদ দিয়ে বাফুফের কোচ কেন্দ্রিক কীর্তি নিয়ে আলোচনা করলে কয়েক কিস্তি লিখেও বোধ করি শেষ করা যাবে না। সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত জিমি ডে সালাউদ্দিন জামানার দশম বিদেশি কোচ। বিষম খাবার মত ঠেকলেও এটাই বাস্তব। আগের ন’জনের মধ্যে কেউ পালিয়েছেন, কেউ এক ম্যাচেই অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছেন আবার কেউ দলীয় স্বার্থে কঠোর হবার দায়ে বরখাস্ত হয়েছেন! বঙ্গের কোচের চেয়ার এখন রঙ্গে পরিণত হয়েছে।
অবস্থা কতটা সঙ্গীন হলে কোনো দেশের ঘরোয়া লিগের পঞ্চম স্তরের একটি দলের সহকারী কোচের হাতে জাতীয় দলের দায়িত্ব তুলে দেয়া লাগে সেটা বুঝতে নিউটনের সূত্র জানা লাগে না। অথচ, তাকে নিয়েও বেশ বড় গলাতেই কথা বলছে বাফুফে। বলাটা সমস্যা না, পঞ্চম স্তরের কোনো দলের সহকারী কোচের দায়িত্বে থাকাটাও সমস্যা না; সমস্যা হচ্ছে প্রণয়ের প্রথম পর্যায়ে বাফুফের এই গদগদ ভাবটা আর শেষ পর্যন্ত বজায় না থাকাটা। এটা বোধকরি বাফুফে কর্তাদের অতিমাত্রায় বাংলা সিনেমা দেখার ফল। যে সিনেমাগুলোতে প্রণয় পর্বের মধুর দৃশ্য চিত্রায়িত হলেও প্রণয় পরবর্তী পরিণয়ে পরিণতি দেখানো হয় না। এই সিনেমা পরিচালকদের খেয়ালের খেসারত বাফুফের কর্তারা দিচ্ছেন।
অথচ, কাজী সালাউদ্দিন এখনো কাতার বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নে কাতর। নির্লজ্জ্বতার সর্বশেষ সীমাও বোধকরি বাফুফে অতিক্রম করে বসে আছে। জাতীয় দল নামক যে দলটা খেলে তা আজ অব্দি পায়নি পেশাদার রুপ। খেলোয়াড়দের বেতন-ভাতা নেই, নেই অন্যান্য আনুষাঙ্গিক সুবিধা। এ হালতে যে দলটি ভুটানকে হারানোই বিশ্বজয়জ্ঞান করছে তারা কাতারে পতাকা উড়াবে, এটা এক রকম নিষ্ঠুর শঠতা।
একটা সময় বাংলাদেশ-ভারত ছিল প্রায় সমশক্তির দল। এখন ভারত যেখানে সাফে নিজেদের বয়সভিত্তিক দলকে বাজিয়ে দেখার চিন্তা করছে সেখানে বাফুফে সাফকেই সাফল্যের সর্বোচ্চ মানদণ্ড ধরে বসে রয়েছে। এএফসি, ফিফা থেকে প্রাপ্ত অনুদানগুলো ঠিক কোন কাজে ব্যায় হয় তার বোধকরি একটি প্রকাশ্য জবাবদিহিতা এখন একান্ত প্রয়োজন। কারণ, অর্থাভাবকে দায়ী করে বাফুফে ফুটবলকে জাদুঘরে পাঠানোর ইন্তেজাম প্রায় পাকা করে ফেলেছে।
আজ পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ একাডেমি গড়ার সামর্থ্য হয়নি বাফুফের। তবে, বুলি ঠিকই আছে। রয়েছে বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতার বিষয়ে ব্যাপক অনীহা। এবার অনুর্ধ্ব ১৮ যে টুর্নামেন্টটি হল সেটিও ওপরওয়ালাদের চাপে পড়ে। অথচ, এ কর্তারাই বলেন যে, ফুটবলের উন্নতিতে বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকে খেলোয়াড় তুলে আনবার বিকল্প নেই। কথায় আর কাজে অমিলের জন্য যদি নোবেল এর ব্যবস্থা থাকত, বাফুফে বাদে ভিন্ন কেউ সেটি স্বপ্নেও পেত না।
মজার বিষয় হচ্ছে নিজ দেশের ফুটবল পরিচালনায় ব্যর্থ এই কর্তারাই সাফের উচ্চপদে অাসীন। এর দ্বারা সাফ কতটা শক্তিধর প্রতিষ্ঠান তার সম্পর্কেও কিছুটা আঁচ করা যায়। অদ্ভুত এক তামাশা যেন চলছে এ অঞ্চলের ফুটবলকে ঘিরে।
বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষই স্বপ্ন দেখে বিশ্বকাপের সময় লাল-সবুজে আসমান ঢেকে দেবার। কিন্তু সে স্বপ্নপূরণের দায়িত্ব যাদের, তারা ব্যস্ত পদ-পদবী বাগিয়ে বড় বড় বয়ান দিতে। তাই, ফুটবল পাগল একটি জাতি হবার পরেও প্রাক-বাছাইতেই শেষ হয়ে যায় স্বপ্ন। আর মাত্র তিনধাপ নামলেই র্যাংকিংয়ে দু’শ ছোঁবে বাংলাদেশ। যে দেশের মানুষ প্রিয় ফুটবলারের জন্য জীবন দিতে পরোয়া করে না, তাদের এই অবস্থায় পৌছে দেয়ার জন্য কৃতিত্ব দাবি করতেই পারেন কাজী সালাউদ্দিন। কারণ, কাতার ভ্রমে তিনি ভুগলেও বাকিরা বাংলার ফুটবলের কঙ্কালসাড় দেহটিই দেখছে।