কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী যেহেতু বিদেশে রয়েছেন সেজন্যে একটা সাইন নেওয়া যাচ্ছে না, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) ফেরৎ এলেই দু’ এক দিনের মধ্যে সাইন নেয়া হবে এবং সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি সমাধান হয়ে যাবে। এমনটি জানালেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর।
আন্দোলনকারীদের সংগঠন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ন আহ্বায়ক নুরুল হক নুর মঙ্গলবার রাত এগারটার দিকে নিজের ফেসবুক একাউন্টের মাধ্যমে লাইভ বক্তব্যে একথা জানান। তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, একটা সাইন করতে যদি ৪৯ দিন লাগে তাহলে একটা দেশ চলবে কীভাবে।
নুরুল হক নুর বলেন, “সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ‘কোটা বাতিল’ এর ঘোষণা দিয়েছিলেন, একাধিকবার বলেছেন যে ‘কোটা বাতিল’ কোটা থাকলে পরবর্তীতে আবার অন্য একদল দাবিদাওয়া জানাবে, আন্দোলনে নামবে, নানারকম কথা বলবে প্রশ্ন উঠবে, তারচেয়ে ঝামেলা নাই, কোটাই বাতিল’।”
নুর বলেন, এই ঘোষণার পর কিন্তু কোন প্রশ্ন থাকার কথা ছিল না, আমার বোধগম্য হয় না যে কেনো কী অদৃশ্য কারণে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার ৪৯ দিন পার হয়ে গেল, তারপরেও এখনো কোন প্রজ্ঞাপন জারি করা হল না।
তিনি জানান, সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে উচ্চ পর্যায়ের ২ জন প্রতিনিধি আমাদেরকে গত ১৪ মে বলেছিলেন যে সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে, অথচ পনেরো দিন পার হয়ে গেল কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “কিছু লোক হয়তো সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার জন্য কিছুটা টালবাহানা করছে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর সরাসরি একটি প্রজ্ঞাপনই জারি হওয়ার কথা।”
এ সময় তিনি কোটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অনুকূলে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়ে টালবাহানা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন।
ছাত্রসমাজ যেদিন অন্যায়ের প্রতিবাদ থেকে সরে আসবে সেদিন এই জাতির বুকে দুর্ভোগ নেমে আসবে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ভয় দেখানো হুমকি-ধামকিতে পিছপা হবেন না। আমাদের সাধারণ ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
এ সময় তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আমরা আমাদের যৌক্তিক দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আছি, যদি আমাদের দাবি না মেনে নেয় হয়, প্রয়োজনে আমরা আবার রাজপথে নামব।”
তিনি বলেন, আমাদের এই আন্দোলন আমরা চাকরি পাবো এই আশায় করিনি, বৈষম্যমুক্ত সমাজের আশায়, পরবর্তী প্রজন্মের সুবিধার জন্য আমরা যৌক্তিক আন্দোলনে নেমেছি। একটি যোগ্য মানুষ কেন তার নিজের যোগ্যতায় চাকরি পাবে না।”
আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ফাটল সৃষ্টির জন্য, আন্দোলন থেকে বিরত থাকার জন্য ভয় দেখাচ্ছে কিছু বিকৃত মস্তিষ্ক ও কুচক্রী। তারা যদি পারতো তাহলে আপনাদের ওপর আরো আঘাত করতো। সুতরাং ভয় পেলে চলবে না, ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদেরকে নানারকম অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে অবস্থান করতে হয় বলে জানিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর এক্ষেত্রে সবাইকে প্রতিবাদী ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানান। ছাত্রদের ওপর নিপীড়নকারী ছাত্রনেতাদেরকে সন্ত্রাসী বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রয়োজনে এই সন্ত্রাসীদেরকে পিটিয়ে বিদায় করতে হবে।
বড় বড় ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ কখনো সাধারণ ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন না। ভাই যদি বলে ক্যান্টিন থেকে ৫ জনের খাবার মেরে নিয়ে আসো নিয়ে আসবেন, হলগেটে গিয়ে ৩ জনকে মারধর করে আসো, মারধর করে আসবেন। এই দুষ্টচক্র থেকে ছাত্র রাজনীতিকে বের হয়ে আসতে হবে।
নুরু বলেন, আপনার প্রোগ্রামে না গেলে রুমে তালা মেরে দিবেন, হল থেকে বের হরে দিবেন, এটা আপনার বাপের সম্পত্তি না যে যখন খুশি এসব করবেন। ছাত্ররা মেধার জোরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, এবং পড়াশোনার খাতিরে হলে থাকতে আসে।
গত ৮ এপ্রিল থেকে চারদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করেন।
পরের দিন সচিবালয়ে দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন আন্দোলনকারীরা।
বৈঠক শেষে মন্ত্রী বলেন, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তাদের অত্যন্ত সুন্দর আলোচনা হয়েছে। আমরা তাদের বলেছি- আগামী ৭ মের মধ্যে সরকার বিদ্যমান কোটার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। সেই পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত থাকবে। এ সময় সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুনও ৭ মে পর্যন্ত তাদের কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেন।
এ ঘোষণার পর ৯ এপ্রিল রাতে আন্দোলন স্থগিত হয়ে যায়। তবে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর এক বক্তব্য কেন্দ্র করে ১০ এপ্রিল থেকে ফের আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। তারা কোটা সংস্কারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সিদ্ধান্ত আসার দাবি জানান।
পরে ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদের অধিবেশনে কোটা পদ্ধতি বাতিল ঘোষণা করে সব চাকরিতে শতভাগ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পর দিন শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আনন্দ মিছিল বের করেন।
এর দুই সপ্তাহ পর গত ২৬ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে কোটা বাতিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের দাবি জানান আন্দোলনকারীরা। না হলে ফের আন্দোলনে নামার ঘোষণা দেন তারা।
২৭ এপ্রিল আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানকের সঙ্গে বৈঠকে বসেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল।
এরপর গত ১৪ মে প্রজ্ঞাপনের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নিয়ে সারাদিন রাস্তা অবরোধ করে রাখেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।