যে তিনটি ছবি বলেছিল ‘আমরা ভালো নেই’

যে তিনটি ছবি বলেছিল ‘আমরা ভালো নেই’

বলা হয়ে থাকে, কখনো কখনো আলোকচিত্রের কোন ক্যাপশন প্রয়োজন হয় না। চিত্রটির আবহ বা অনুষঙ্গ আমাদের বলে দেয় ঘটনা— ঘটনার আড়াল আর পরবর্তী ভবিষৎ। প্রতিদিন হাজার হাজার ক্লিক হয় ক্যামেরা আর মোবাইলের ট্রিগারে। এর মধ্যে স্মৃতি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় ভালোবাসা,স্নেহ , মায়া-মমতা, বন্ধুত্ব, রোমাঞ্চকর অগ্রযাত্রা। কিন্তু এসবের বাইরেও ছবি তোলা হয়। ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়ে সমাজ-সময়-রাজনীতি। ধরা পড়ে অবক্ষয়। মানব সভ্যতার বিপর্যয় হয়ে ওঠে সে সমস্ত ছবির উপাদান। তেমনি তিনটি ছবির গল্প: যা আমাদের বলেছিল— আমরা ভালো নেই।

 

ফেলানী-র কাঁটাতারে ঝুলে থাকা দেহ

২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি। অনন্তপুর সীমান্ত পার হতে গিয়ে অনন্তপুরে হারিয়ে যেতে হয়েছিল পনেরো বছরের ফেলানী খাতুনকে। ওড়নায় বাঁধা ফেলানীর সেই লাশ সেদিন মনে করিয়ে দিয়েছিল, আমরা ভালো নেই। দক্ষিণ এশিয়ার মতো দেশগুলোতে সীমান্ত অনুপ্রবেশ একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এ অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্য পুশব্যাক পদ্ধতিও ব্যবহার করে সীমান্তরক্ষা বাহিনীগুলো। কিন্তু ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ তকমা নিয়ে খাবার টেবিলে বসে পড়া ভারত অবলম্বন করে ‘গুলি’। প্রায় দশ বছর ধরে ফেলানীর বাবা আর ফেলানী দিল্লিতে কাজ করতো। বিয়ে ঠিক হওয়ায় ফেলানীকে জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তন করানোর জন্যই তিনি কুঁচবিহারের এক দালালকে ৩ হাজার টাকা চাঁদা দেন। ৬ জানুয়ারি দিন শেষের রাত ৩টায় অনন্তপুর সীমান্ত পার হওয়ার সময় যে মুহূর্তে ফেলানীর বাবা নুরু হোসেন বাংলাদেশ সীমান্তের মইয়ে পা দেন। বিএসএফ গুলি করে। বাম পাশে ফেলানী থাকায় গুলিটি তার গায়ে লাগে। পরবর্তীতে ফেলানীর লাশ কাঁটাতারে ওড়নায় বাঁধা অবস্থায় কয়েক ঘন্টা ঝুলে থাকতে দেখা যায়। সেই ছবিটিই তুলে ছিলো কুঁচবিহার রাজ্যের স্থানীয় এক সাংবাদিক।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানী খাতুন

যে ক্ষত মনে করিয়ে দেয়: ফেলানী হত্যাকাণ্ডের পর সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে ভাবিয়েছিল আমাদের। এ হত্যাকাণ্ডের তুমুল প্রতিবাদ করা হলেও নীতিগত দিক থেকে ভারত সরকারের মধ্যে তেমন কোন পরিবর্তন দেখা যায়নি। নির্দোষ প্রমাণ করা হয়েছে হত্যার সাথে জড়িত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে। কমেনি হত্যার প্রবণতাও। মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, এই আট বছরে ৪০৩ জন বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে বিএসএফ। যার মধ্যে ২৬৯ জনকে সরাসরি গুলি করে এবং বাকিদের শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে।

 

সমুদ্র সৈকতে আয়লান কুর্দি

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের এক বিকেল। তুরস্কের বদ্রুম উপকূলে স্নিগ্ধ বাতাস লাগছে আয়লানের শরীরে। আয়লান ঠাণ্ডা থেকে আরও ঠাণ্ডা হয়ে উঠছে। আয়লানের গায়ে সমুদ্রের পানি এসে লাগছে। আয়লান স্থির হয়ে শুয়ে আছে। না আয়লান ওসব ভয় পাবে না কোনদিন। সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া থেকে যখন হাজার হাজার স্বজাতির লোক আশ্রয়ের খোঁজে পাড়ি জমাচ্ছিল ইউরোপে। তেমনি এক যাত্রায় গ্রীসের নৌকাডুবিতে প্রাণ হারায় আয়লান। যুদ্ধ কবলিত সিরিয়া থেকে আগেই সপরিবারে তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছিলেন আয়লানের বাবা আব্দুল্লাহ কুর্দি। ৩ সেপ্টেম্বর নৌকায় করে গ্রীস যাচ্ছিলেন। নৌকা ডুবে যাওয়ার পর হাত ফসকে পড়ে যায় তিন বছর বয়েসি আয়লান। ভূমধ্যসাগর গিলে নেয় আয়লানের ভাই গালিব ও মা রেহানাকেও। লাল টি-শার্টের আয়লান ভেসে ওঠে নীল সমুদ্রের তীরে। এই ছবিটিই আমাদের জানিয়েছিল, আমরা ভালো নেই। আয়লানের এই ছবিটি তুলেছিলেন তুরস্কের স্থানীয় একটি সংবাদ সংস্থার আলোকচিত্রী।

ভূমধ্যসাগরের উপকূলে পড়ে থাকা আয়লান কুর্দির লাশ

যে ক্ষত মনে করিয়ে দেয়: আয়লানের মৃত্যু আমাদের নিঃশব্দে বলার চেষ্টা করেছিল ‘নিরাপদ আশ্রয়’ নামক একগুচ্ছ শব্দ। পুঁজিবাদী বিশ্বের যুদ্ধাত্মক মনোভাব সাধারণ বা শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছ থেকে তাদের আশ্রয় কেড়ে নিচ্ছে। কেড়ে নিচ্ছে বেঁচে থাকার অধিকার। সিরিয়া-সংকট শুধু রাজনৈতিক প্রেক্ষায় নেই, রয়েছে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের মতো সাম্প্রদায়িক চেতনায়। রয়েছে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের প্র্যাকটিস মাঠ হিসেবে। আয়লানের ঘটনার পর ইউরোপের বহুদেশ তাদের দরজা খুলে দিলেও ‘শরণার্থী আশ্রয়’ কোনদিনই স্থায়ী সমাধান নয়। গৃহযুদ্ধের এই করাল গ্রাস ২০১৮ সালে এসেও এতটুকু কমেনি। রাশিয়া, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সের মতো দেশ ঘি ঢেলে যাচ্ছে অনবরত।

 

হুইল চেয়ারে ফাদি আবু সালাহ

১৫ মে ২০১৮, পেছনে কালো ধোঁয়া। নীচে খা খা মাঠ। সামনে কাঁটাতার। রশি’তে পাথর বেঁধে ঘোরাচ্ছে ফাদি আবু সালাহ। লক্ষ্য ইসরায়েল। হুইল চেয়ারের এই সৈনিক এক স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনি। ২০০৮ সালে গাজায় বোমা হামলার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে যোগ দিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে দু’পা হারান তিনি। ১৫ মে ছিল ফিলিস্তিনিদের নকবা দিবস। সেদিন জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের প্রতিবাদে জড়ো হয় প্রায় পঞ্চাশ হাজার ফিলিস্তিনি। শান্তিপূর্ণ সে আন্দোলনে সকাল থেকেই হুইল চেয়ারে হাজির হন সালাহ। ইসরায়েলি বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। নিহত হন সালাহ। নিহত হওয়ার আগে অপ্রতিরোধ্য এই সৈনিকের যুদ্ধরত ছবিটিই আমাদের জানান দিয়ে গেল, আমরা ভালো নেই। জানাল, কতটুকু পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে— দু’পা হারানো একজন মানুষ যোদ্ধা হয়ে ওঠে আর জন্মভূমির জন্য মৃত্যুকে বরণ করে নেয়।

গাজা উপত্যাকায় যুদ্ধরত ফাদি আবু সালাহ

যে ক্ষত মনে করিয়ে দেয়: ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইহুদিবাদী ইসরায়েল সাড়ে সাত লাখের অধিক ফিলিস্তিনিকে নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করে দেয়। এরপর থেকেই ক্রমে শুরু হয় ইসরায়েলি নৃসংশতা। জেরুজালেম কার? মুসলমান, খ্রিস্টান না ইহুদির? জেরুজালেম যারই হোক। এ এক ঠুনকো অজুহাত।  নিরীহ মানুষকে হত্যাকে সমর্থন করবে কে? তৃতীয় বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো এখানেই যেন এক চরম খেলায় মত্ত। ফিলিস্তিনিদের উপর চলা আক্রমণকে উপভোগ করে চলেছে। পৃষ্ঠপোষকতা করছে বর্বর এই হত্যাযজ্ঞকে আর প্রতি মুহূর্তে জন্ম দিচ্ছে ফাদি আবু সালাহর মতো এক একজন সৈনিক। সালাহর এই অসহায়ত্ব আর ইসরায়েলি আগ্রাসন আমাদের সামনে হাজির করে মানবিক বিপর্যয়ের আরেকটি দৃশ্য – অস্তিত্ব রক্ষার প্রাগৈতিহাসিক তাড়না।