বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চরম মানবতাবিরোধী এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থি একটা কর্মসূচি হলেও বাংলাদেশে এমন একদল মানুষ পাওয়া যাচ্ছে– যারা মনে করেন, এটা ‘অপরাধী’দের সংখ্যা কমাতে একটা ভালো ‘পদ্ধতি’।
গত কয়েকদিন একটি দৈনিকে একজন বিশিষ্ট উপন্যাসিক এবং একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকেও এইরূপ তত্ত্ব বিক্রি করার চেষ্টায় দেখলাম। মুশকিল হলো, উপরোক্ত গুনীজনদের দাবি পরিসংখ্যান একদম সমর্থন করছে না।
যদি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ‘অপরাধী’দের সংখ্যা কমাতো তাহলে নিশ্চয়ই এইরূপ হত্যাকাণ্ড ক্রমে কমে আসতো। কিন্তু কার্যত তা হয়নি।
বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নথিভুক্ত করে এমন একটি সংগঠন ‘অধিকার’-এর মহাফেজখানা ব্যবহার করে সর্বশেষ নয় বছরের যে পরিসংখ্যান পেলাম– তাতে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, বিচার বহির্ভূত হত্যা কমছে না, বরং বাড়ছে। এর ভিন্ন অর্থ হলো, তথাকথিত ‘অপরাধী’ও কমছে না। অর্থাৎ অপরাধ কমানোর ‘পদ্ধতি’ হিসেবে এটা মোটেই কার্যকর নয়।
অধিকারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০০৯ সালে বিচার বহির্ভূত পদ্ধতিতে মানুষ খুন হয়েছে ১৫৪ জন। পরের বছরগুলোতে একই ধরনের খুন ছিল নিম্নরূপ:
২০১০–১২৭ জন
২০১১–৮৪ জন
২০১২–৭০ জন
২০১৩–৩২৯ জন
২০১৪–১৭২ জন
২০১৫–১৮৫ জন
২০১৬–১৭৮ জন
২০১৭–১৩৯ জন,
২০১৮ সালের প্রথম চার মাসেই মারা গেছে ৬৯ জন। এবং বছরের মে মাসেই এমন হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছে শতাধিক।
বলা বাহুল্য, এসব পরিসংখ্যান নিশ্চয়ই ‘রাষ্ট্র’ আরও ভালোভাবে অবহিত। ক্রসফায়ার, গুলি, পিটিয়ে খুন বা নির্যাতনে হত্যা করেও যে ‘অপরাধী’ কমছে না বা এভাবে খুনোখুনি করে যে ‘অপরাধ’ কমে না সেটা জেনেও ‘রাষ্ট্র’ কেন এইরূপ ‘অভিযান’-এ নামে এর উত্তর হলো ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্র’ চরমভাবে বলপ্রয়োগ ছাড়া আর টিকে থাকতে পারছে না। আসলে সকল ‘রাষ্ট্র’ই কমবেশি এভাবেই টিকে থাকে। এটা একটা বৈশ্বিক সত্য। যদিও নানান দেশে নানান মুখোশের আড়ালে ‘রাষ্ট্র’-এর এই খুনি স্বভাব ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলে অনবরত।
অর্থাৎ, সরাসরি বললে, যে কোন রাষ্ট্রই মূলত বলপ্রয়োগের একটি সংগঠন মাত্র। বাংলাদেশ রাষ্ট্র এক্ষেত্রে কোন লুকোচাপা করতে অনিচ্ছুক। সেদিক থেকে বাংলাদেশে এসে রাষ্ট্রতত্ত্ব বেশ সোজাসাপ্টা রূপ নিয়েছে।
কিন্তু সোজাসাপ্টা এই পাঠের বিপরীতে যারা রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগকে অপরাধ নির্মূলের শোভন ন্যায্যতায় আড়াল করতে চান তাদের লক্ষ্য কী? সমাজ কী এইসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সম্পর্কে সচেতন?
প্রশ্ন জাগে, খুনোখুনির পাশে দাঁড়ানো বাংলাদেশের এই বুদ্ধিজীবীরা সম্প্রতি টেকনাফে খুন হওয়া জনৈক কাউন্সিলর একরামের খুনের বহুল আলোচিত গল্পটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? বিশেষত যখন দেখা যাচ্ছে, জনৈক মোজহার মিয়ার ইয়াবা ব্যবসায়ী পুত্র একরামকে ধরতে যেয়ে রাষ্ট্রীয় অভিযান কার্যত অপর নাগরিক আবদুস সাত্তারে পুত্র কাউন্সিলর একরামকে খুন করে ফেলেছে। এক্ষেত্রে ক্রসফায়ারের প্রেসনোট মৃত একরামের বাড়ি হিসেবে নাজিরপাড়া নামে যে এলাকার ঠিকানা উল্লেখ করছে কার্যত সেই নামে টেকনাফ পৌরসভায় কোন এলাকাও নেই।
কিংবা তার আগের সপ্তাহে চট্টগ্রামের বরিশাল কলোনির হাবিবের খুন পরবর্তী ঘটনাবলীকে কীভাবে ধামাচাপা দেয়া যাবে– যখন দেখা যাচ্ছে জনৈক হাবিব শেখকে বাঁচাতে যেয়ে ‘সোর্স’রা নিরীহ এক হাবিবুর রহমানকে খুনের তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়ে এবং সেই খুনকে তদন্তের হদিস থেকে আড়াল করতে আবার সোর্স মোশারফকেও খুন হয়ে যেতে হয়।
বস্তুত খুনের এই উৎসব বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অজানা এক নৈরাজ্যিক গন্তব্যে নিয়ে চলেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর এক্ষেত্রে ‘উচ্চশিক্ষিত’ একদল ‘বুদ্ধিজীবী’ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আপাত এই উম্মত্ত বলপ্রয়োগ প্রক্রিয়ায় শরিক হয়ে গেল। ইতিহাস সাক্ষী।