গ্যাব্রিয়েল ওমার বাতিস্তুতা, আর্জেন্টিনার ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার। ভক্ত সমর্থকদের কাছে বাতিগোল নামেই বেশি পরিচিত নব্বইয়ের দশকের এই খেলোয়াড়। ছিলেন আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতা। মেসি তার গোল দেওয়ার রেকর্ড ভেঙে দিলেও জাতীয় দলের হয়ে মাত্র ৭৭ ম্যাচে ৫৪ গোল দেয়া বাতিস্তুতার মত নিয়মিত গোল স্কোরার আর্জেন্টিনা দেখেনি এখনো। এখনো বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বকাপে গোলের হ্যাটট্রিক রয়েছে তার, যে কৃতিত্ব আর কারো নেই। যে আর্জেন্টিনা প্রায় ২৪ বছর ধরে সিনিয়র ন্যাশনাল টিমে আন্তর্জাতিক শিরোপাহীন, সেই আর্জেন্টিনাকে মাত্র ২ বছরের মাঝে ৪টি আন্তর্জাতিক ট্রফি জিতিয়েছিলেন এই বাতিস্তুতা। ক্লাব ক্যারিয়ারে খেলেছেন রিভার প্লেট, বোকা জুনিয়ররস, ফিওরেন্তিনা ও রোমার মতো ক্লাবে। কিছুদিন আগেই ফিওরেন্তিনার হল অফ ফেইমে জায়গা পান ফিওরেন্তিনার ২৬৯ ম্যাচে ১৬৮ গোল করা এই গোলমেশিন। আর্জেন্টিনার গোলমেশিন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা ফিফার সাথে কথা বলেন আর্জেন্টিনার বর্তমান দল ও খেলোয়াড়দের সংকট নিয়ে। জবানের পাঠকদের জন্যে সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করে দেওয়া হল–
ফিফা : মেক্সিকোর সাথে ১৯৯৩ কোপা আমেরিকায় করা গোল থেকেই আর্জেন্টিনা ফাইনাল জেতে। আপনি কখনো ভেবেছিলেন এর পর আর্জেন্টিনা এত দীর্ঘ সময়ের শিরোপা খরায় ভুগবে?
গ্যাব্রিয়েল ওমার বাতিস্তুতা : না, আমি ভেবেছিলাম আমরা ৯৫ এর শিরোপাও জিতব (হাঁসতে হাঁসতে)। কিন্ত হ্যাঁ আসলেই আমি ভাবিনি। কখনোই না। এটা অবিশ্বাস্য যে আর্জেন্টিনা এরপর আর ফাইনাল জেতেনি। আর্জেন্টিনা সবসময়ই শিরোপার কাছাকাছি যায়। শিরোপা জেতা কখনোই সহজ ছিল না আমাদের জন্যে।
এর কারণ কি হতে পারে?
বাতিস্তুতা : কারণ বের করা এত সহজ হবে না। যদি আপনি কারণ খুঁজতে থাকেন তাহলে একটা কারণ হতে পারে আর্জেন্টিনার খেলোয়ড়েরা সারা বছরই দেশের বাইরে খেলতে থাকে। অন্য যেকোন জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের থেকে বেশি ম্যাচ খেলে থাকে। যখন তারা কোপা অ্যামেরিকায় খেলতে আসে তখন কেউ নিজদের সেরাটা দিতে পারে না। তাই সবাই তখন থাকে ক্লান্ত এবং অনেকেই ইনজুরিতে চলে যায়। ব্রাজিল ছাড়া এমন কোন দল দেখাতে পারবেন না যাদের দলের ২৫ টা খেলোয়াড়ই সারা বছর বাইরের লিগে খেলে।
আপনি দলকে সমর্থন দেন? সমসাময়িক সময়ে আর্জেন্টিনার খেলা কোন ফাইনাল দেখেছেন আপনি?
বাতিস্তুতা : হ্যাঁ আমি দেখি কিন্ত আমি খুবই শান্ত। অবশ্যই আমি আর্জেন্টিনা ফুটবলের একজন ভক্ত, আমি চাই তারা জিতুক। আর্জেন্টিনার কাছে ভক্তদের আশা থাকে অনেক। আমি জানি আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায় যেমনটা আমার অভিজ্ঞতা হত যখন আমি মাঠে ছিলাম। আমি তাদের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করি। পার্থক্য একটাই, এখন আর আমি নার্ভাস হয়ে যাই না।
সার্জিও আগুয়েরো এবং গঞ্জালো হিগুয়েনদের মত স্ট্রাইকাররা আর্জেন্টিনার জার্সিতে অনেক সমালোচিত হচ্ছে। এই বিষয়ে আপনার কোন মন্তব্য আছে?
বাতিস্তুতা : দুর্ভাগ্য তাদের পিছু ছাড়ছে না। বিশেষ করে হিগুয়েনের। সে দুইটা কোপা এবং বিশ্বকাপ তিনটা ফাইনালেই গোল দেয়ার গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেন। আমি দুর্ভাগ্য বলব কারণ তিনটা ফাইনালেই তিনি সুযোগ বের করেছিলেন গোল দেয়ার। ব্যাপারটা মোটেও এমন না যে তার সাথের খেলোয়াড়েরা সব করেছেন কিন্ত তিনি কিছুই করেননি। সে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় ছিলেন। কিন্ত তার দুর্ভাগ্য এইযে সে খুব বাজে ফিনিশিং করে। উদাহরণস্বরূপ জার্মানের সাথে ফাইনাল খেলায় সে একটা বল রিকভার করেও গোলের সামনে থেকে গোল দিতে ব্যর্থ হয়। সে সবই ঠিকঠাক করেছিল শুধু গোল দিতে ব্যর্থ ছিল। এমন হতেই পারে। ফাইনাল খেলা না হয়ে যদি খেলাটা গ্রুপ পর্বের হত তাহলে কেউ এই গোল মিস করা নিয়ে মাথা নষ্ট করত না। বরং হয়ত আমরা তার প্রশংসা করতাম গোল দেয়ার সুযোগ তৈরি করতে পারায়।
হিগুয়েন এখন আপনার সামনে থাকলে আপনি কি বলতেন?
বাতিস্তুতা : একই কথা যা আমি এখন বলছি। আমি তার সাথে কথা বলেছিলাম, এবং এই কথাগুলোই আমি তাকে বলি। আমি তার চেষ্টাকে দশে নয় দেব। কিন্ত সমর্থকেরা এভাবে দেখেন না। তারা জানেন না ওই সময় আপনার মাথায় কি কাজ করে। ভেবে দেখুন, পায়ে বল পাওয়ার পর থেকে শ্যুট করা পর্যন্ত আপনার মাথায় কত কি ঘুরপাক খায়। এই সকল চিন্তাগুলো বিষয়টাকে ঘোলাটে করে দেয়। সম্ভবত ওই সময় একটা রিবাউন্ড পেয়ে গেলে তার জন্যে কাজটা সহজ হয়ে যেত। এটাই ফুটবল।
মেসির প্রসঙ্গে আসা যাক। আর্জেন্টিনার হয়ে আপনার গোল দেয়ার রেকর্ড দীর্ঘদিন অটুট থাকার পরে মেসি নিজের করে নেয়। আপনি কি অবাক হয়েছিলেন?
বাতিস্তুতা : একদমই। আমি এমন কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি ভেবেছিলাম সে আরও আগেই এই রেকর্ড ভাঙবে। এই রেকর্ডটা ছিল আমার খুবই একান্ত, কিন্ত সে এটা অতিক্রম করেছে। একদা আমিও অন্য কারো রেকর্ড ভেঙেই সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলাম।
মেসি কতদূর পর্যন্ত যেতে পারবে বলে আপনি মনে করেন?
বাতিস্তুতা : তার সামর্থ্য রয়েছে আরো পঞ্চাশটা গোল করা। তার বয়স এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তার এখনো অনেক খেলা বাকি রয়েছে। আমি মনে করি মেসি আরো অনেক কিছু করতে পারবে।
একটা বিষয় খোলাসা করতে চাই। কথিত আছে আপনি বলেছিলেন ‘আমি কখনোই ফুটবল পছন্দ করতাম না’। এটা কি সত্যি নাকি গল্প?
বাতিস্তুতা : হ্যাঁ আমি বলেছিলাম। কিন্ত এটা ছিল সংবাদ মাধ্যমের হাত থকে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে। আমি তাদের মাথায় এই কথাটা ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলাম যেন তারা আমাকে এর কোন প্রশ্ন না করতে পারে। আমাদের এমনিই ট্রেনিংয়ে অনেক কসরত করতে হতো। ভুলে গেলে চলবে না, আমি যখন ইতালিতে ছিলাম তখন ইতালির ফুটবলে স্বর্ণযুগ চলছিল। আমাদের অনেক চাপ থাকতো এবং প্রায় সবাই-ই ফুটবল নিয়ে কথা বলতো এবং আমার কাছে এটা খুবই একঘেয়ে লাগত। অবশ্য আমি এই খেলা পছন্দ করি। খেলার কৌশল, প্রশিক্ষণ, যা কিছু হয় খেলার মাঠে সব। আমি ফুটবলে বেঁচেছি, আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবস্থান করে ফুটবল। এখন আমার হাঁটাচলায় সমস্যা ফুটবলের জন্যেই। কারণ আমার যতটুক দেয়ার ক্ষমতা ছিল আমি তারচেয়েও বেশি দিয়েছি।
সত্যি বলতে আমি ফুটবল ভালোবাসি এবং ফুটবল খেলার সাথে সম্পর্কিত সবকিছুই। আমার অপছন্দের বিষয় হচ্ছে সাক্ষাৎকারগুলো (হাঁসি), ফুটবল নিয়ে বিতর্ক এবং বর্তমান সময়ের আগে যারা ফুটবলের কর্তা সেজে বসেছিল। আমি এসব কিছুই পছন্দ করি না। আমি খেলা পছন্দ করি, কিন্ত খেলার সাথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সবকিছুকে না।
আপনি কেন বললেন আপনি ইতালির ‘স্বর্ণযুগে’ খেলেছেন? আপনি কি সমসাময়িক সময়ের ইতালিয়ান ফুটবল পছন্দ করেন না?
বাতিস্তুতা : না ঠিক তা না। ফুটবল এখন তেমন নাই। আমি আশা করি এটা শেষের শুরু না, বরং এটা নতুন কিছুর শুরু। কিন্ত ৮০, ৯০ এর দশকে ফুটবল অন্যরকম ছিল। তখন পৃথিবীর সেরা সব খেলোয়ড় ইতালিতে আসতে চাইত। কিন্ত দীর্ঘদিন যাবত এমনটা দেখা যায় না। এছাড়া খেলার মানও একটু কমে এসেছে। তারা এখনো অনেক কৌশলী এবং সুশৃঙ্খল ফুটবল খেলে, কিন্ত সমস্যা হচ্ছে তাদের লিগে চ্যাম্পিয়নদের অভাব রয়েছে। এমনকি তারা নিজেরাও এটা বলে। বাইরে থেকে দেখলে ইংলিশ এবং স্প্যানিশ লিগ বেশি আকর্ষণীয়। তাদের দলগুলোতে বড় বড় নামযাদা খেলোয়াড় রয়েছে। কিন্ত খেলার প্রতি ইতালিয়ানদের যে আবেগ রয়েছে, যে গৌরব ইতালির রয়েছে, আমি মনে করি খুব শীঘ্রই তারা তাদের যোগ্য অবস্থানে ফিরে আসবে।