কিছু পুরুষের বিকৃত খায়েশ ও ইসলামের আলোকে বহু বিবাহ

কিছু পুরুষের বিকৃত খায়েশ ও ইসলামের আলোকে বহু বিবাহ

আলোচনা যেহেতু সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন এলাকায় অনেক আলোচিত বহুবিবাহ নিয়ে এবং এটা শুরু করেছেন দ্বীনি ভাইরা, তাই শুরু করছি দ্বীনের ভিত্তি কোরআন এই ব্যাপারে কি বলে তার আলোকেই।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা যেহেতু পবিত্র কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে মুসলমান পুরুষকে একের অধিক বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন, দুই (মাসনা), তিন (সুলাসা), কিংবা চার (রুবাআ), তাই ইসলামে বহু বিবাহ জায়েজ, এই ব্যাপার নিয়ে কোন বিতর্ক নাই। কিন্তু শর্ত আছে। আপনি শর্তগুলো না মেনে যদি একের অধিক বিয়ে করেন তাহলে আপনি শরীয়তের ধোয়া তুলে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার বাসনা করছেন। যারা এমন শরিয়তের দোহাই দেন আমি তাদের নিয়ে বিতর্কে যাব না।

কোরআন কোন গল্পের বই না, কোরআনের প্রতিটি আয়াতের পেছনে শানে নজুল আছে, বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আয়াত সমূহ নাজিল হয়েছে। কোরআনের কোন আয়াত নাজিল হওয়ার পেছনের ঘটনা না জেনে, সেই আয়াতকে অাক্ষরিকভাবে তুলে এনে প্রয়োগ করতে গেলে ভুল করে ফেলার সম্ভাবনা প্রচুর। কেন, এমন হতে পারে, কিভাবে এমনটা ঘটতে পারে এর ব্যাখ্যা জানা অত্যন্ত জরুরি।

কিছু মুসলমান পুরুষ যেমন চার বিয়ে জায়েজ পর্যন্ত জেনেই সুখ অনুভব করে, তেমন কিছু ইসলামোফোবিয়াগ্রস্ত মানুষ আছে কোরআন বলেছে সব অমুসলিমদের হত্যা করো জেনেই ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম বানাতে পেরে সুখ অনুভব করে। এই দুই দলের মাঝে মিলটুকু হল নিজের সুবিধা মতো বয়ান তৈরির জন্য আয়াতের শানে নুজুল জেনে নিজেদের সুখ নষ্ট করার প্রয়োজন তারা অনুভব করেন না। যা মুসলিম হিসাবে অত্যন্ত দুঃখজনক।

এবার আসি সূরা নিসায়। সুরাটি মাদানী সুরা। অর্থাৎ নবীজি (দঃ) মদিনায় থাকা কালে যখন মুসলমানেরা বদরের যুদ্ধ, খন্ডকের যুদ্ধ, ওহুদের যুদ্ধ, ইত্যাদি যুদ্ধে জড়িত তখন এই সুরা নাজিল হয়েছিল। ইসলামের প্রথম দিকে এসব যুদ্ধের জন্য দরকার ছিল অকুতোভয়, পিছুটানহীন যোদ্ধা, যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি হিসাবে মনের শান্তি ছিল এই যে, তারা যদি শহিদও হয় তবে তাদের ফেলে যাওয়া স্ত্রী-সন্তানদের ভরণ পোষণ, নিরাপত্তা, আর ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে না, তাদের দরকার ছিল সম্পূর্ণ বিনা চিন্তায় আল্লাহর নামে জিহাদে ঝাপিয়ে পড়া।

সে সময় সমাজে কেউ মারা গেলে তার সম্পদ অন্যান্য আত্মীয় স্বজন কুক্ষিগত করে ফেলতো। তখন সমাজে এতিমদের খুব তুচ্ছ করে দেখা হতো। সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল না, তাদের কোন মর্যাদা ছিল না, যেহেতু তাদের হাতে কোন সম্পদ থাকতো না, যার কারণে সাধারণত তাদের কেউ বিয়ে করতেও চাইতো না। তখন নাজিল হয় সূরা নিসা।

“وَآتُواْ الْيَتَامَى أَمْوَالَهُمْ وَلاَ تَتَبَدَّلُواْ الْخَبِيثَ بِالطَّيِّبِ وَلاَ تَأْكُلُواْ أَمْوَالَهُمْ إِلَى أَمْوَالِكُمْ إِنَّهُ كَانَ حُوبًا كَبِيرًا “(৪ঃ২)

“এতিমদেরকে তাদের সম্পদ বুঝিয়ে দাও। খারাপ মালামালের সাথে ভালো মালামালের অদল-বদল করো না। আর তাদের ধন-সম্পদ নিজেদের ধন-সম্পদের সাথে সংমিশ্রিত করে তা গ্রাস করো না। নিশ্চয় এটা বড়ই মন্দ কাজ।”

“وَإِنْ خِفْتُمْ أَلاَّ تُقْسِطُواْ فِي الْيَتَامَى فَانكِحُواْ مَا طَابَ لَكُم مِّنَ النِّسَاء مَثْنَى وَثُلاَثَ وَرُبَاعَ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلاَّ تَعْدِلُواْ فَوَاحِدَةً أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ذَلِكَ أَدْنَى أَلاَّ تَعُولُواْ” (৪ঃ৩)

“আর যদি তোমরা ভয় কর যে, এতিম মেয়েদের হক যথাথভাবে পুরণ করতে পারবে না, তবে সেসব মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন, কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ আশঙ্কা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে, একটিই অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে; এতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা।”

খেয়াল করুন, এখানে এতিমদের ওপর জোর দেয়া হয়েছে পুরুষদের অধিকারের উপর নয়। এখানে বলা হয় নাই, তোমরা যদি নিজ নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না বলে আশংকা করো (কোন শারীরিক চাহিদার জন্য) তাহলে করো মাসনা, সুলাহা, রুবাআ। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ এতিমদের সমাজে পুন:প্রতিষ্ঠার দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।

চলুন এবার হাদিসের আলোকে দেখতে চেষ্টা করি–

জানা মতে হজরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বমোট ১০টি বিয়ে করেছিলেন। ২৫ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন ৪০ বছর বয়স্কা বিবি খাদিজা (রা.) কে। যেই সময়ে বহুবিবাহ ভীষণ একটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, মক্কার সমাজে তখন উনি এক স্ত্রী বিবি খাদিজার সাথে বিবাহিত জীবনযাপন করেছিলেন দীর্ঘ ২৪ বছর, বিবি খাদিজার মৃত্যু পর্যন্ত, ততদিনে নবীজির (সা.) বয়স ৪৯। বিবি খাদিজার মৃত্যুর পর প্রায় ৩-৪ বছর উনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন নাই। ওনার বয়স তখন প্রায় ৫৩, যৌবনের সমাপ্তি ঘটেছে ততদিনে।

নবীজি (সা.) এই ৫৩ বছর বয়স পর্যন্ত অন্য কোন নারীর প্রতি মনযোগ প্রকাশ করেন দেখান নাই। এরপর বেঁচে ছিলেন আরও ১০ বছর। আর এই দশ বছরে বিয়ে করেছিলেন ৯ জনকে মতভেদে ১১ জন নারীকে। নবীজির বিবিদের মাঝে বিবি খাদিজা আর বিবি আয়েশা ছাড়া বাকি বিবিদের বেশির ভাগই ছিলেন যুদ্ধের বিধবা।

ওনার দ্বিতীয় স্ত্রী বিবি সাউদা ছিলেন প্রায় ওনার সমবয়সী, ৬ সন্তানের জননী, এবং বিধবা। বিবি হাফসা, বিবি হিন্দ, বিবি জয়নাব, বিবি সাফিয়া, বিবি জুয়াইরিয়া প্রত্যকেই ছিলেন ওহুদ-বদর ইত্যাদি যুদ্ধের বিধবা। বিবি রায়হানা ছিলেন একজন ইহুদি দাসী, আর বিবি জয়নাব বিন্ত জাহাশ ছিলেন তালাকপ্রাপ্ত। এছাড়াও মক্কার সাথে শান্তি চুক্তির পর বিয়ে করেছিলেন মক্কাবাসী বিবি রামলা (বিধবা) কে। এখানে ইসলামিক ঐতিহাসিকদের কিছু মতভেদ আছে, কিন্তু সেসব মতভেদ আমার লেখার উদ্দেশ্য না।

আমার উদ্দেশ্য দেখানো যে এতিম আর বিধবাদের দায়িত্ব নেয়ার জন্যই মূলত ওনার অনেকগুলো বিয়ে। হজরত আবু বকরের (রা.) চার স্ত্রীর প্রথমজন (হজরত আবু বকর যাকে পৌত্তলিক ধর্ম থেক ইসলামে না আসার জন্য তালাক দেন) ছাড়া বাকি তিন জনই ছিলেন যুদ্ধে স্বামীহারা, বিধবা এবং এতিম।

হজরত আলী (রা.) বিবি ফাতেমা (রা.) বেঁচে থাকা পর্যন্ত দ্বিতীয় বিয়ে করেন নাই। অনেক ঐতিহাসিকের মতে নবীজি (সা.) হজরত আলীকে (সা.) বিবি ফাতেমা (রা.) বেঁচে থাকতে দ্বিতীয় বিয়ে করার অনুমতি দেন নাই।

বাংলাদেশের পুরুষ সমাজ, এবার আপনারাই বলুন আপনারা কোন উদ্দেশ্যে দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ বিয়ে করতে আগ্রহী? আপনাদের উদ্দেশ্য কি এতিমদের আর বিধবাদের রক্ষা করা, নাকি অন্য কিছু? আপনাদের দেশে কি অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ চলছে? সেই জিহাদে কি আপনাদের ভাই ব্রাদারেরা শহীদ হচ্ছেন? দেশে কি এতিম আর বিধবাদের সংখ্যা অত্যাধিক হারে বেড়ে গেছে? নাকি আপনারা রোহিঙ্গা-সিরিয়ান-ইয়েমেনী বিধবা বা এতিমদের দায়িত্ব নেয়ার জন্য বহু বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করছেন? নাকি অন্য কোন কারণ?

অন্য কোন কারণ থাকলে তা আপনারা কেবল ইসলাম নয় বরং রাষ্ট্রীয় কানুনের আওতায় পড়েন। এছাড়া আপনারা যে দেশে বাস করেন, মানে বাংলদেশ, সেখানে যেহেতু আপনারা ইসলামিক কোন দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে কেবল মাত্র ইসলামিক আইনে দেশ পরিচালনা করতে পারেন নাই, সেক্ষেত্রে আপনি বর্তমান রাষ্ট্রীয় আইন মেনে চলতে বাধ্য, আর সেই আইন অনুযায়ী দ্বিতীয় (মাসনা) বিয়ে করার আগে আপনার প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেয়াটা অপরিহার্য।

আর ইসলামের দোহাই দিয়ে একাধিক বিয়ের চিন্তা করার আগে বুঝে দেখুন এতো বিধবা আর এতিম আপনি কোথায় পাবেন?