ফুটবল একটি আবেগের নাম, একটি বিপ্লবের নাম, একটি শিল্পের নাম; রংটা সবুজ ঘাস আর তুলিটা শিল্পির পা, কেউ শিল্পটাকে রাঙায় বা-পায়ে কেউ ডান-পায়ে আবার কেউ দু’পায়েই। এই শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম একজন হচ্ছে নীল-সাদার দেবদূত ম্যারাডোনা। ফুটবলের বরপুত্র ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ারে খেলেছেন আর্জেন্টিনো জুনিয়র্স, বোকাজুনিয়র্স, বার্সেলোনা, নাপোলি, সেভিয়া এবং নিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে। জাতীয় দলের হয়ে তিনি চারটি বিশ্বকাপ খেলেছেন। তন্মধ্যে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন এবং ১৯৯০ তে রানার্সআপ। ১৯৯৪ সালে ড্রাগ টেস্টে ধরা পড়ে শেষ হয় ক্যারিরার। কিন্ত সব সময়ই তিনি যেন আলোচনায় থাকতে পছন্দ করেন। তাই ম্যরাডোনা যখন কথা বলেন তখন আপনি চিত্তাকর্ষক কিছুর আশাই করতে পারেন। ফিফার সাথে কথোপকথনে ম্যারাডোনা প্রকাশ করেন বিশ্বকাপে তার প্রিয় পাঁচটি মুহুর্তের কথা।
১৮ জুন ১৯৮২
আর্জেন্টিনা ৪–১ হাঙ্গেরি; ম্যারাডোনার প্রথম বিশ্বকাপ গোল
‘আমি শুধু চেয়েছিলাম বল গোলে ঢুকুক। আমরা বেলজিয়ামের সাথে প্রথম খেলায় হেরেছিলাম। আমি এর আগে অনুর্ধ্ব বিশ বিশ্বকাপে গোল করেছিলাম; কিন্ত কোন কিছুই বিশ্বকাপের গোলের সাথে তুলনাযোগ্য নয়। এটা এমন একটা অনুভুতি যেন মা আমার বিছানায় সকালের নাস্তা নিয়ে হাজির হল। এটা নির্মল আনন্দ। অনেক কিছুই তখন মাথায় খেলা করতে থাকে’।
২ জুলাই ১৯৮২
আর্জেন্টিনা ১–৩ ব্রাজিল; বাতিস্তাকে লাথি মেরে লাল কার্ড
“আমি পরবর্তীতে বাতিস্তার সাথে কথা বলেছিলাম। আমরা ৩-১ গোলে পিছিয়ে ছিলাম এবং তারা এটা নিয়ে মজা নিচ্ছিল এবং আমি হারতে একদমই পছন্দ করি না। বাতিস্তা আমাকে বলেছিল, ‘না দিয়েগো। আমরা ফুটবলকে আমাদের ভেতরে ধারণ করি।‘ কিন্ত সত্যি বলতে যদি আমরা তিন গোলে এগিয়ে থেকে ‘ওলে ওলে ওলে’ করতাম তাহলে অবশ্যই যেকেউ অনেক রেগে যেত। শিরায় একটু রক্ত থাকলেও তাতে আগুন ধরে যাবে। কিন্ত হ্যাঁ, আমি ভুল খেলোয়াড়কে লাথি মেরেছিলাম। অবিশ্বাস্য!”
২২ জুন ১৯৮৬
আর্জেন্টিনা ২–১ ইংল্যান্ড; শতাব্দীর সেরা গোল
“আমি কখনোই এরকম আরেকটা গোল দেইনি। আমি এমন অনেক গোল দিয়েছি যেগুলা দেয়া কষ্টকর ছিল, কিন্ত ইংল্যান্ডের সাথে গোলটা ছিল বিশ্বকাপে। প্রত্যকেটা খেলোয়াড়ের স্বপ্ন এটা। আমরা সবাই-ই স্বপ্ন দেখি অনেক খেলোয়াড়কে কাটিয়ে গোল দেয়ার। কিন্ত আমার বোধগম্য হয় না পিটার শিলটন কি করেছিল। আমি জানি না ভৌতিক কিছু তাকে সরিয়ে নিয়েছিল কিনা। সে আমার জন্যে পুরো গোল খালি করে দিয়েছিল। আমি শুধু তাকে কাটিয়ে গেলাম এবং গোল!”
“আমার মা বলত, ‘আমি কখনোই এই গোলটা দেখে ক্লান্ত হই না’। আমি প্রায়ই তাকে দেখতাম এই গোলের ভিডিও দেখতে এবং বলতাম, ‘মা! আবারো এই গোল দেখছো!’ তখন সে বলত তার ছেলের গোল দেখতে তার ভালো লাগে। ‘তোমার ইচ্ছা হলে চলে যাও। কিন্ত আমি তোমার সবগুলা গোল দেখতে থাকব’।”
৩ জুলাই ১৯৯০
ইতালি ১–১ আর্জেন্টিনা (পেনাল্টিতে আর্জেন্টিনা জয়ী) পেনাল্টি স্পট থেকে জেঙ্গাকে পরাস্ত করা
“আমার খুবই অবাক লাগছিল কারণ ইতালিয়ানরা আমাকে বলছিল, জয় তাদের প্রাপ্য ছিল, এই খেলা পেনাল্টিতে যাওয়া উচিৎ হয়নি। লুইজি এবং জেঙ্গা আমাকে বলেছিল ড্র হওয়াটা ন্যায্য ফলাফল ছিল না। কিন্ত এমন একটা খেলায় যোগ্যতার প্রশ্ন ওঠে না।”
“আমি এর আগে যুগোস্লোভিয়ার সাথে পেনাল্টি থেকে গোল করতে ব্যর্থ হই। তাই আমি যখন স্পট থেকে পেনাল্টি নিতে যাই তখন নিজেকে বলি, ‘এই পেনাল্টি মিস করলে তুমি একটা বেকুব, যদি মিস কর তাহলে তুমি একটা আবাল, সবচেয়ে খারাপ খেলোয়াড়। তুমি এতগুলো মানুষকে ধোকা দিতে পারোনা যারা তোমাকে ভালোবাসে। মা, বাবা, ভাই, আর্জেন্টিনার মানুষ, কাউকে ধোকা দিতে পারোনা’। তারপরই আমি জেঙ্গাকে পরাস্ত করি এবং ফাইনাল নিশ্চিত করি। হ্যাঁ আমি ইতালিকে বিদায় করেছিলাম।”
২৪ জুন ১৯৯০
আর্জেন্টিনা ১–০ ব্রাজিল; ক্যানিজিয়াকে একটা ঐশ্বরিক অ্যাসিস্ট
‘ব্রাজিলিয়ানরা গোলটার জন্যে আলেমাওকে দোষারোপ করে, কিন্ত আমি তাকে খুব দ্রুতই পরাস্ত করে ফেলেছিলাম। আসলে এটা আলেমাও এর ভুল ছিল না, ভুল ছিল দুঙ্গা’র। কারণ দুঙ্গাই আমাকে সুবিধা করে দিয়েছিল আলেমাওকে অতিক্রম করে যেতে।”
“যখন ক্যানি (ক্লদিও ক্যানিজিয়া) গোল করে তখন আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই, আমার মা এবং সকল দেবদূতদের ধন্যবাদ জানাই। কিন্ত ক্যানি কোন উদযাপনই করে নাই, শুধু হাত ওপরে তোলে। যেন এটা কিছুই ছিল না। আমি তখন তাকে ডেকে বললাম, ‘শোন, এই মুহুর্তে তুমি কি করেছ তুমি জানো?’ ক্যানি বলল, ‘হ্যা, একটা গোল দিলাম’। ‘না তুমি শুধু একটা গোল দাও নাই, তুমি পুরো একটা জ্যান্ত মাঠকে নির্বাক করে দিয়েছো।”
“খেলা শেষে ব্রাজিলিয়ানদের সম্মানার্থে আমি ড্রেসিংরুমে যাই কারেসা’র জার্সি পরে। সে আমার বন্ধু। আমরা ডাকাতিটা না করলে ব্রাজিল যোগ্য দল হিসেবে পরের রাউন্ডে যেত। ব্রাজিল পুরো ম্যাচ জুড়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল কিন্ত আমরা জিতেছিলাম। এটাই ফুটবলের সৌন্দর্য এবং এর জন্যেই ফুটবল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর খেলা।”