বোরোর বাম্পার ফলনে লাভ মিল মালিকদের, লোকসানে কৃষক

বোরোর বাম্পার ফলনে লাভ মিল মালিকদের, লোকসানে কৃষক

দেশের এবার বোরোর বাম্পার ফলন হলেও প্রচুর চাল আমদানির কারণে কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছেন। বিগত তিন বছরের মধ্যে বর্তমানে ধানের দাম সবচেয়ে কমে নেমে এসেছে, এতে লাভবান হচ্ছেন মিল মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় বড় ব্যবসায়ীদের কারণে ধানের এই বাম্পার ফলনের সুফল কৃষক কিংবা ভোক্তারা পাবেন না। সরকারের ১০ লাখ ৫০ হাজার টন ধান ক্রয়ের সিদ্ধান্তের সুবিধা ভোগ করবেন শুধুমাত্র বড় বড় মিল মালিকরা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। এবং এক্ষেত্রে কৃষকরা বঞ্চিত হবেন তাদের পাওনা ন্যায্যমূল্য থেকে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এবং টিসিবি’র (ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশ) তথ্য মতে, গত এক মাসে ধানের দাম ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। চালের দাম কমেছে মাত্র ২ থেকে ৬ শতাংশ।

রংপুর, রাজশাহী, পাবনা ও কুষ্টিয়ায় বিরিধান-২৮ বিক্রি হচ্ছে ৬২৫ থেকে ৬৮০ টাকা মণ। সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মতে বিগত ৩ বছরে ধানের দাম এতটা কমেনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, এই সময়ে ধানের উৎপাদন খরচ উত্তরাঞ্চলের এলাকাভেদে ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকা প্রতি মণ। ধানের দাম ব্যাপক হারে কমেছে গত এপ্রিলের শেষের দিকে যখন হাওরাঞ্চলে ধানকাটা শুরু হয়। সেসময় হাওরাঞ্চলের কৃষকরা মণ প্রতি ৭৬০ থেকে ৭৮০ টাকা উৎপাদন খরচের ধান ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হন।

সরকার এবার দেড় লাখ মেট্রিক টন ধান ২৬ টাকা কেজি দরে ১ হাজার ৪০ টাকা মণ প্রতি কিনবে বলে জানা গেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার এবার ৩৮ টাকা কেজি দরে সাড়ে ৮ হাজার মিল মালিকদের নিকট থেকে ৯ লাখ মেট্রিক টন চাল ক্রয় করবে।

খাদ্য অধিদপ্তরের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, ‘এবছরও সরাসরি কৃষকদের নিকট হতে ধান বা চাল ক্রয় করা সম্ভব হচ্ছে না’।

এবছর ৪৮ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে, যেখানে ২০১৭ সালে আবাদ হয়েছিল ৪৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মোহসিন বলেন, সরকার এবছর রেকর্ড পরিমাণ ১ কোটি ৯৫ লক্ষ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন আশা করছে। ইতোমধ্যে দেশে ৬৫ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে।

তিনি আরো বলেন, ধানের ভালো দাম থাকায় কৃষকরা এ বছর বোরোর আবাদে উৎসাহিত হয়েছেন। তবে বৃষ্টির কারণে ধান মাড়াই ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা।

হঠাৎ বন্যায় ‘১৭ অর্থবছরে হাওরাঞ্চলে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেবার বোরোর উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৮১ লক্ষ মেট্রিক টন, এটি বিগত ৮ বছরের মধ্যে কম ছিল। আমনের উৎপাদনও ১ কোটি ৩৫ লক্ষ টন থেকে ১ কোটি ৩০ লক্ষ টনে নেমে এসেছিল।

কিন্তু এ বছর হাওর অঞ্চলে রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা এ অঞ্চল থেকে ১৫ লক্ষ মেট্রিক টন ধান পেয়েছি।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের কৃষক আজিজুল হক বলেন, এ মৌসুমের বোরো ক্ষেতের উৎপাদন খরচ বিঘাপ্রতি কমপক্ষে সাড়ে ১১ হাজার টাকা থেকে ১২ হাজার টাকা। কিন্তু আমরা ১ বিঘা জমি থেকে ১৪/১৫ মণ ধান পাচ্ছি, যার দাম ৮ থেকে সাড়ে ৮ হাজার টাকা।

আজিজুল হক জানান, সরকারি দফতরে তাদের কোন যোগাযোগ নেই। দলীয় নেতাকর্মীরাসহ স্থানীয় বেপারি ও মিল মালিকরাই সরকারি ধান চাল কেনাবেচার সুবিধা ভোগ করে। আমরা এসবের কিছুই পাই না।

ইতোমধ্যে সর্বকালের রেকর্ড পরিমাণ চাল আমদানি করা হয়েছে। ‘১৮ অর্থবছরে এরই মধ্যে ৩৭ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়েছে। খাদ্য অধিদপ্তরের মতে, আগের রেকর্ডের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৮০ লক্ষ টন।

খাদ্য অধিদপ্তরের মহাব্যবস্থাপক মো. বদরুল হাসান বলেন, চলতি অর্থ বছরের শেষ নাগাদ চাল আমদানি ৪০ লক্ষ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের দাম বর্তমানে অন্য সময়ের তুলনায় কম, এখন ৪১৫ থেকে ৪৪০ ডলার প্রতি টন চাল বিক্রি হচ্ছে।

‘আমরা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ১৪ লাখ টন চাল কেনার পর এখন স্থানীয় বাজার থেকেই চাল সংগ্রহ করছি’ বলেন তিনি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর ফেলো গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান ইংরেজি দৈনিক ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসকে বলেন, ‘একদিকে বোরোর বাম্পার ফলন অন্যদিকে প্রচুর পরিমাণে চাল আমদানির ফলে কৃষকরা বেকায়দায় পড়েছেন। গত বছর উৎপাদন কম থাকায় চাল আমদানির ব্যাপারটি স্বাবাবিক ছিল। যেহেতু গত দু বছরের তুলনায় এবার উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে, অতএব আদমানি বন্ধ করা দরকার।

তিনি সরকারকে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান চাল ক্রয়ের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন। এতে সরকার কিছু মুনাফাও করতে পারে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের ফেলো ড. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ধারাবাহিক আমদানি বেসরকারি খাতকে বেকায়দায় ফেলতে পারে। বেশি মুনাফার আশায় আমদানি নির্ভরতা বাড়িয়ে উৎপাদন বিমুখ হয়ে পড়লে সেটি স্থানীয় মিলগুলোর জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।

এবং একই সাথে ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষকদের সরাসরি অর্থ সহায়তা ও নানাবিধ প্রণোদনা দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, সরকারের অন্তত ২০ লক্ষ টন চাল সরাসরি কৃষকদের থেকে নেওয়া উচিৎ। এতে একটা ভাল প্রভাব পড়বে। এবং এর ফলে সীমিত আয়ের মানুষগুলো ন্যায্যমূল্যে চাল কিনে খেতে পারবে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ গোলাম হাফিজ কেনেডি জানান, চাল আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি নীতিতে কৃষক ও ভোক্তার সুবিধা খেয়াল রাখার ক্ষেত্রে সব সময় একটা সংকট লক্ষ্য করা যায়।

তিনি বলেন, যখন স্থানীয় উৎপাদন ভালো হয়, পরবর্তী ৩ মাসের জন্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত। আর সরকারের উচিত কৃষক যাতে প্রতি কেজি ধানে ২৬ টাকা পায় সে ব্যাপারে কঠোর উদ্যোগী হওয়া। এবং অবশ্যই কৃষকদের নিকট থেকে সরাসরি না কিনতে পারলে সেটা সম্ভব হবে না।

ভারতে গত ৩ সপ্তাহ যাবৎ সেদ্ধ চালের বাজার পড়তির দিকে রয়েছে, এবং এটি এ বছরের সর্বনিন্মে গিয়ে ঠেকেছে। ভারতে রুপির মূল্যও কমে গিয়েছে। চালের অন্যান্য বড় বড় রপ্তানিকারক বাজারগুলোতে চালের দাম স্থিতিশীল রয়েছে।

ভারতের বাজারে টন প্রতি বিভিন্ন জাতের আধাসেদ্ধ ছাঁটা চাল ১০ ডলার করে কমে ৩৯৪ থেকে ৩৯৮ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিযোগিতার বাজারে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের চালের চেয়ে ভারতীয় চালের বাজার ভালো।

২০১৭ সালের বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য হারে চাল আমদানি শুরু করে। এতে দেশে চালের দামও বেড়ে যায় সেসময়।

বাংলাদেশে বছরে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয়। এর অর্ধেকের বেশি পূরণ করে থাকে গ্রীষ্মকালীন বোরো ধান।

গত বছর মজুত ফুরিয়ে যায় এবং দেশের বাজারে চালের দাম ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সরকার এশিয়ার দেশ ভারত, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে চাল আনতে বাধ্য হয়। গত জুলাই থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ ৩৭ লক্ষ টন চাল আমদানি করে ফেলেছে।

মো. মোহসিন জানান, বাজারের উর্দ্ধগতি দেখে কৃষকরা বোরো মৌসুমে বেশি বেশি জমিতে আবাদ করেছেন। ৪৯ লক্ষ হেক্টর জমিতে এবার বোরোর চাষ হয় যেখানে এবার বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ লক্ষ হেক্টর। ভালো দামের কথা ভেবে কৃষকরা একটুকরা জমিও খালি রাখেননি।

চাল বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য। নির্বাচনের বছর হওয়ায় চালের বাজারে অস্থিতিশীলতা সরকারকে বেশ ভাবাচ্ছে।