বেল ও বেন্জেমায় ভর করে রিয়ালের হ্যাট্রিক শিরোপা জয়

বেল ও বেন্জেমায় ভর করে রিয়ালের হ্যাট্রিক শিরোপা জয়

রিয়াল মাদ্রিদ   ৩ – ১    লিভারপুল
বেঞ্জেমা(৫১”)                সাদিও মানে(৫৫”)
বেল(৬৪”৮৩”)

লিভারপুলকে ৩-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ইতিহাস রচনা করল রিয়াল মাদ্রিদ। টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় যে যেন তেন কথা নয় তা সকল ফুটবল ভক্তদের ই বোধগম্য। মাঠে ১১ জন মাদ্রিদ গ্ল্যাডিয়েটরের দাপট চললেও মূল কাজ যে সাইড লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্রেঞ্চ ম্যানের ঠান্ডা মাথার কারসাজি তা অস্বীকার করার জো নেই। তাই মাদ্রিদ ভক্তরা যে প্রথমে জিদানকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবে তা বলাই বাহুল্য। এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে লিভারপুলের পারফর্মেন্স ছিল চোখ ধাঁধানো। তাছাড়া মো. সালাহ, ফিরমিনহো ও সাদিও মানের আগুন ঝরানো পারফর্মেন্স থাকলেও শেষ পর্যন্ত শিরোপার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে খালি হাতে ফিরতে হলো অল রেডসদের। ম্যাচের ৩১ মিনিটে শোল্ডার ইন্জুরির কারণে মাঠ ছাড়তে হয় অল রেডসদের অন্যতম হাতিয়ার মো. সালাহকে। আর এতেই অনেকটা ম্যাচ থেকে মানসিক ও পারফর্মেন্সের দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে লিভারপুল। তবে প্রথমার্ধ বেশ ভালোভাবে পার করলেও দ্বিতীয়ার্ধে লিভারপুলের জার্মান গোলকিপার লরিস কারিয়ুসের ভুলে প্রথম গোলটা পেয়ে যায় ব্ল্যাংকোসরা। যদিও তার চার মিনিট পর ম্যাচে ফিরেছিল লিভারপুল, তবে বেলের একটি দূর্দান্ত বাই সাইকেল কিকের গোল এবং লরিস কারিয়ুসের ভুলে শেষ পর্যন্ত ৩-১ গোলের ব্যবধানে জয় পেয়ে নিজেদের হ্যাট্রিক চ্যাম্পিয়ন্স নিশ্চিত করে রিয়াল।

রিয়াল মাদ্রিদ (৪-৩-১-২)

নাভাস, কার্ভাহাল, রামোস, ভারান, মার্সেলো, ক্যাসেমিরো, মদ্রিচ, ক্রুস,  ইস্কো, বেঞ্জেমা, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।

সাব : কার্ভাহাল-নাচো, ইস্কো-বেল, বেঞ্জেমা-অ্যাসেন্সিও

লিভারপুল (৪-৩-৩)
কারিয়ুস, আরনোল্ড, লোভ্রেন ,ভার্জিল ফান ডাহক, রবার্টসন, উইনাল্ডাম, হেন্ডারসন, মিলনার, মানে, ফিরমিনহো, মোহাম্মদ সালাহ।

সাব : সালাহ-লালানা, মিলনার-এমরে কান।

প্রথমার্ধ

সিজনের শুরু থেকেই দূর্দান্ত পারফর্ম করে ফাইনালে উঠেছিল লিভারপুল। এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সর্বোচ্চ দলীয় স্কোর (৪১গোল),

তিন জন স্ট্রাইকারের ১০+ গোল, সর্বোচ্চ এ্যাসিস্টদাতা এমনকি সর্বোচ্চ ক্লিনশীটও ছিল অলরেডসদের দখলে।এমন আগুন ঝরানো পারফর্মেন্সের সামনে যেকোন দলেরই আতংকে থাকার কথা। তবে লিভারপুলের প্রতিপক্ষ ছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ রিয়াল মাদ্রিদ। যে দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের রয়েছে ৩-৪ টির মত চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা।

তবে কিয়েভে ফাইনাল ম্যাচের প্রথম ১০ মিনিটে লিভারপুলের পারফর্মেন্স দেখে কারও বলার ক্ষমতা ছিল না এই একাদশের কারোরই অতীতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা নেই। ম্যাচের প্রথম ২০ মিনিট আক্রমণ পাল্টা আক্রমণের জমজমাট লড়াইয়ের প্রথম বাঁধা আসে ২৫ মিনিটে। রামোস ও সালাহর বল দখলের লড়াই চলাকালীন মাটিতে পড়ে গেলে রামোসের শরীরের ভারে হাতে ব্যথা পান মিশরীয় ফুটবল সম্রাট মো. সালাহ। প্রাথমিক ভাবে তাকে চিকিৎসা দিয়ে মাঠে নামানো হলেও ম্যাচের ৩০ মিনিটে লিভারপুলের নেয়া কর্নার কিকের পর মাঠে বসে পড়েন সালাহ। তখনই লিভারপুল ফ্যানদের মনের অজানা ভয় বাস্তবে রূপ নেয়।হাতের ইন্জুরির জন্য মাঠ ছাড়তে হয় লিভারপুলের প্রধান হাতিয়ার সালাহকে।

সালাহর মাঠ ছাড়ার পর লিভারপুলের খেলোয়াড়রা ডিফেন্সিভ ফুটবল খেলতে শুরু করেন। এই সুযোগ কাজে লাগানোর লক্ষ্যে প্রেসিং ফুটবল খেললেও গোলের দেখা পাচ্ছিল না জিদানের শিষ্যরা। উল্টো ম্যাচের ৩৬ মিনিটের মাথায় রিয়াল মাদ্রিদের একটি আক্রমণের সময় পায়ের গোঁড়ালিতে ব্যথা পেয়ে মাঠ ছাড়তে হয় মাদ্রিদ রাইট ব্যাক কার্ভাহালকে।

ম্যাচের ৪৩ মিনিটে রোনালদোর একটি অসাধারণ হেড রুখে দিলেও বেঞ্জেমার আলতো টোকায় বল জড়ায় লিভারপুলের জালে তবে তার পূর্বেই বেঞ্জেমা অফ সাইডের ফাঁদে পড়ায় গোলটি বাতিল হয়। প্রথমার্ধের শেষ পর্যন্ত কোনো দল গোল করতে না পারায় গোলশূন্য ড্র হয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের প্রথমার্ধ।

দ্বিতীয়ার্ধ

প্রথমার্ধে রিয়াল মাদ্রিদ প্রেসিং ফুটবল খেলে গোল না পাওয়ায় দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই গোলের জন্য মরিয়া ছিল লস ব্ল্যাংকোসরা। ম্যাচের ৪৮ মিনিটে গোলের একদম সহজ সুযোগও পেয়ে যায় মাদ্রিদের স্প্যানিশ মিড ফিল্ডার ইস্কো। তবে বল ক্রসবারে লেগে ফিরে আসলে হতাশ হয় ব্ল্যাংকোস সমর্থকরা।

তবে রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের গোলের জন্য বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। ম্যাচের ৫১ মিনিটে লিভারপুল গোলকিপার কারিয়ুস লং পাসের একটি বল দ্রুত ক্লিয়ার করতে গিয়ে বল হারালে তার পাশেই থাকা রিয়াল মাদ্রিদের ফ্রেঞ্চ ম্যান করিম বেঞ্জেমা সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দলকে লিড এনে দেন।

যদিও সেই লিড বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি টানা দু’ বারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী রিয়াল মাদ্রিদ। ম্যাচের ৫৫ মিনিটে ফিরমিনহোর কর্নার শ্যুটে লোভ্রেন হেড করলে বল পেয়ে যান সাদিও মানে।

সুবিধাজনক জায়গায় বল পেয়ে গোল দিতে কোনো ভুল করেননি তিনি। তার গোলে ১-১ এ সমতায় ফিরে লিভারপুল।

ম্যাচের ৬১ মিনিটে দলের আক্রমণভাগে শক্তি বাড়ানোর জন্য ইস্কো কে তুলে মাঠে নামান মাদ্রিদের হান্ড্রেড মিলিয়ন ম্যান গ্যারেথ বেলকে। তিনি জিদানরে আস্থা রেখেছেন।

গ্যারেথ বেল এর এই শটটিকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাস সেরা গোল হিসেবেই বিবেচনা করা হবে

মাঠে নামার মাত্র ৪ মিনিট পরই গোল করে দলকে আবার লিড এনে দেয় ওয়েলসের অধিনায়ক। মার্সেলোর করা ক্রসে দূর্দান্ত এক বাই সাইকেল শ্যুটে গোল করেন তিনি। এটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন গোলগুলোর মধ্যে একটি হয়ে অনেকটা সময় ফুটবল ভক্তদের হৃদয়ে গেথে থাকবে।

ম্যাচের শেষের দিকে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণে খেলা শেষ মুহুর্তের দিকে এগিয়ে চললেও শেষ পর্যন্ত আর কোনো গোলের দেখা পাচ্ছিল না কোনো দলই।

আবারও ম্যাচের একদম শেষ মুহুর্তে আরেকটি ভুল করে বসলেন লিভারপুলের জার্মান গোলকিপার লরিস কারিয়ুস। এবার বেলের নেয়া একদম সোজাসুজি শ্যুট ফ্লিক করলেও বল লিভারপুলের জালে জড়িয়ে যায়।

ম্যাচের ৮৩ মিনিটে ৩-১ গোলে এগিয়ে গেলে রিয়াল মাদ্রিদের জয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। তবুও ম্যাচের শেষ মুহুর্তেও নিজেদের সেরাটা দিয়ে খেলছিল রিয়াল মাদ্রিদ। কারণ ম্যাচের শেষ মিনিটের একটি ভুলও যে ট্রফি হাত ছাড়া করতে পারে সে ইতিহাস ২০১৪ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে নিজেরাই রচনা করেছিলেন। তবে ম্যাচের একদম শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়াই করেও আর ব্যবধান কমাতে পারেনি লিভারপুল। তাই ২০০৭ সালের পর আবারও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে উঠেও হতাশ হতে হলো অল রেডসদের।

অন্যদিকে ৩ সিজনে টানা ৩ টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতারর রেকর্ড করে নিজেকে রিয়াল মাদ্রিদ ইতিহাসে কোচ হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে নাম লেখিয়ে ফেললেন জিনেদিন জিদান।

ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ :  গ্যারেথ বেল (রিয়াল মাদ্রিদ)