মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর অনিন্দ্যসুন্দর ১১টি নিদর্শন

মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর অনিন্দ্যসুন্দর ১১টি নিদর্শন

সভ্যতার বিনির্মাণে মুসলিম স্থপতিদের গুরুত্ব কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। যুগে যুগে বিভিন্ন মুসলিম শাসকগোষ্ঠী তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শিল্পকলায় উৎকর্ষতার প্রমাণ বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। তেমনিভাবে আজও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মুসলিম স্থাপনাশৈলীর অনেক নিদর্শন রয়েছে। এই সকল নিদর্শন কালের বিবর্তনে শুধু টিকেই থাকেনি বরং গৌরব নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।

কাদা মাটির মসজিদ (মালি)

মালির জেন্নে-তে অবস্থিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই কাদামাটির মসজিদটি শুধু আফ্রিকা নয় পৃথিবীরই এক বিষ্ময়। ১৩ শতকে নির্মিত মসজিদটির বর্তমান কাঠামো ১৯০৭ সালে তৈরি। প্রাচীন নকশাত অনুকরণে স্থানীয় নির্মাণ সামগ্রী যেমন: রোদে শুকানো কাদামাটির ইট, কাদার প্লাস্টার, কাঠের পিলার দ্বারা তৈরি মসজিদটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এক ব্যতিক্রমধর্মী স্থাপত্য। প্রতি বছর বর্ষা মোউসুমে ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রায় চার হাজর স্বেচ্ছাসেবক এই মসজিদের মেরামতে অংশ নেয়।

 

লালবাগ কেল্লা (বাংলাদেশ)

বাংলাদেশে মোঘল শাসনামলের অন্যতম স্থাপত্য, লালবাগ কেল্লা পুরনো ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে বুড়িগঙ্গা নদীর সন্নিকটে অবস্থিত। ১৬৭৮ সালে মোঘল যুবরাজ মুহাম্মদ আজম বাংলার সুবেদার থাকাকালীন সময় এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। কিন্তু তিনি এবং উত্তরসুরি শায়েস্তা খানও নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেননি। কেল্লার কেন্দ্রীয় অংশ জুড়ে রয়েছে তিনটি ভবন। পূর্ব দিকে দেওয়ান-ই-আম ও হাম্মাম, পশ্চিমে মসজিদ ও মাঝখানে বিবি পরীর সমাধি।

 

মসজিদে কুবা (সৌদি আরব)

মসজিদে কুবা মদিনার উপকন্ঠে অবস্থিত। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৬২২ সালে মদিনায় হিজরতকালে মজসিদটি নির্মাণ করেন। রাসুল (সা.) এর নবুয়াত প্রাপ্তির পর এটিই হচ্ছে প্রথম মসজিদ। সর্বশেষ ১৯৮৬ সালে এটি পুন:র্নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে মসজিদটিতে ৪টি মিনার ও ৫৬টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদটির মর্যাদা সম্পর্কে আল কুরআনের সূরা তওবায় ১০৮ নং আয়াতে ইঙ্গিত রয়েছে।

 

তোপকাপি প্রাসাদ (তুরষ্ক)

তোপকাপি প্রাসাদ ১৪৫০ দশকে সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ এর নির্দেশে নির্মিত হয়। কয়েকটি দালানের সমন্বয়ে গঠিত স্থাপত্যটি প্রায় ৪০০ বছর ধরে ৩০ জন উসমানি সুলতানের প্রশাসনিক দপ্তর ও আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাসাদ থেকে মর্মর সাগর ও বসফরাস প্রণালীর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।

 

কাসর আল আশেক (ইরাক)

কাসর আল আশেক সামারার আব্বাসীয় খলিফা আল মু’তামিদ (৮৭০-৮৯২ খ্রী) এর প্রাসাদ। বাগদাদ থেকে ১২৫ কি.মি. উত্তরে টাইগ্রিস নদীর তীরে সামারা শহরে এর অবস্থান। ৮৭৭-৮৮২ সালে জিপসাম দিয়ে নির্মিত এই স্থাপত্যটি ১৯৮০’র দশকে খননকাজের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করা হয়।

 

শাহ মসজিদ (ইরান)

ইরানের ইস্ফাহান প্রদেশে অবস্থিত শাহ মসজিদ ১৬১১-১৬৩০ সালে সাফাভিদ সুলতানের সময় নির্মিত হয়। নীল রংয়ের গম্বুজ ও ৫০ মিটার লম্বা দৃষ্টিনন্দন মিনার ছাড়াও মসজিদের দেয়ালে রয়েছে ক্যালিগ্রাফি ও বৈচিত্র্যময় নকশার সমন্বয়। এর প্রবেশপথ, নামাজস্থল, মিনার ও গম্বুজ নির্মিত সাত রংয়ের মোজাইকে। অনিন্দ্যসুন্দর এই মসজিদটি ইসলামী যুগের পার্সি স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন।

 

সালাহউদ্দিনের দুর্গ (মিশর)

বিখ্যাত মুসলিম শাসক ও সেনাপতি সালাহউদ্দিন আইয়ুবী কায়রো শহরের পূর্বপ্রান্তে মুকাত্তাম পর্বতে ১১৭৬-৮৩ সালে দুর্গটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে আইয়ুবী সুলতান আল কামেল এর আমলে ১২১৮-৩৮ সালে এর সম্প্রসারণ কাজ শেষ হয়। নির্মাণ পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে দুর্গটি ততকালীন মুসলিম শাসকদের আবাসস্থল ও শাসনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

 

মুহাম্মদ আমিন খান মাদ্রাসা (উজবেকিস্তান)

মাদ্রাসাটি উজবেকিস্তানের খিভা শহরে অববস্থিত। এটি স্থানীয় শাসক মুহাম্মদ আমিন খান কর্তৃক ১৮৪৫-১৮৫৫ সালে নির্মিত হয়। বহুমূল্য স্বচ্ছ বর্ণিল ইটে অলংকৃত ভবনটির অভ্যন্তরে ১২৫টি কক্ষ রয়েছে। এর প্রবেশদ্বারে আরবিতে লেখা রয়েছে, ‘বিমুগ্ধতা ছড়াতে এই সুন্দর দালানটি চিরদিন দাঁড়িয়ে থাকবে’।

 

স্তারি মোস্তা সেতু (বসনিয়া-হার্জেগোভিনা)

স্তারি মোস্তা সেতুটি বসনিয়া হার্জেগোভিনার মোস্তা শহরের নেরেতভা নদীর উপর নির্মিত। ১৫৫৭-১৫৬৬ সালে উসমানি শাসনামলে তৈরি সেতুটি ১৯৯৩ সালে ক্রোয়েশিয়া-বসনিয়া যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলে পরবর্তীতে ২০০৪ সালে পুনর্নির্মাণ করা হয়। সেতুটি বলকান অঞ্চলের মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন।

 

লালকেল্লা (ভারত)

মোঘল সম্রাট শাহজাহানের আমলে ১৬৪৮ সালে দিল্লীর লালকেল্লা নির্মিত হয়। যমুনা নদীর সন্নিকটে অবস্থিত স্থাপত্যটি ছিল মোঘল সম্রাটদের আবাসস্থল। ২.৪২ কিলোমিটার সীমানা ঘেরা প্রাসাদ, মসজিদ, বাজার, ছোট খাল, বাগান ইত্যাদির সমন্বয়ে এলাকাটি ছিল শহরের অভ্যন্তরে আরেক শহর। কেল্লা কমপ্লেক্সের উল্লেখযোগ্য স্থাপনা হচ্ছে লাল পাথরের স্তম্ভে নির্মিত দেওয়ান-ই-আম, সাদা মার্বেলে নির্মিত দেওয়ান-ই-খাস। পার্সি, ইউরোপীয় ও ভারতীয় শিল্পকলার অদ্ভুত সংমিশ্রণে সৃষ্ট স্থাপনাটি মোঘল সৃষ্টিশীলতার এক অনন্য নিদর্শন।

 

আল হামরা দুর্গ (স্পেন)

১২৩৮-১৩৫৮ সালে নাসরীয় সুলতানদের দ্বারা নির্মিত কাল’আত আল হামরা বা স্পেনের লাল দুর্গ ইসলামী ইতিহাসের গৌরবময় স্থাপত্য। এটি আন্দালুসিয়ার গ্রানাডায় সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালার সন্নিকটে অবস্থিত। সুলতানের প্রাসাদ, রাজকর্মচারীদের আবাসস্থল ও দুর্গ এরূপ তিন অংশে বিভক্ত স্থাপনাটি। বিরল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে অভ্যন্তরের খুটি, দেয়াল, কক্ষ ও ভবনগুলো পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বাণী, আরবি কবিতা ও উপদেশে অলংকৃত।