বিদ্যুতের সিস্টেম লস, অপচয় রোধ, চুরি, বিল পরিশোধে ভোগান্তি, বকেয়া ও ভুতুড়ে বিলসহ বিভিন্ন দুর্নীতি-হয়রানি দূর করার জন্য প্রিপেইড মিটারের প্রতি বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয় গ্রাহকদের। তবে এ মিটারের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে এসব সমাধানের বদলে গ্রাহকদের মধ্যে ভোগান্তি ও অতিরিক্ত খরচের একটি শাখা তৈরি হয়েছে। স্বল্প ভেন্ডিং স্টেশন ও ব্যাংক শাখার কারণে বিল পরিশোধে সবাইকে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এছাড়া বিদ্যুৎ বিলে নানান খাতে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পেইড মিটারে বিল পরিশোধে কোনো ঝামেলা থাকবে না– এমনটিই আশা করেছিলেন গ্রাহকরা। কিন্তু দীর্ঘলাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে এখন বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয়। এতে অতিরিক্ত অর্থ ও প্রচুর ব্যয় হওয়ায় বেড়ে গেছে হয়রানি। বিদ্যুৎ বিল নির্ধারণের দায়িত্বপ্রাপ্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সংস্থাটি বিদ্যুতের ব্যবহার অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করে থাকে।
লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ২ হাজার টাকা রিচার্জ করে ১ হাজার ৬৮৪ টাকা অ্যাকাউন্টে জমা হয়। আর বাকি ৩১৬ টাকা সার্ভিস চার্জ, ডিমান্ড চার্জ ও ভ্যাটসহ অন্যান্য খাত দেখিয়ে কেটে রাখা হয়। আবার এক হাজার টাকা রিচার্জ করলে গ্রাহক কার্ডে থাকে ৬৫২ দশমিক ৩৮ টাকা। কারণ সার্ভিস চার্জ ২০, ডিমান্ড চার্জ ৬০, মিটার ভাড়া, ই-মিটারিং চার্জ ও ভ্যাট হিসাবে ৫ শতাংশ হারে ৪৭ দশমিক ৬২ টাকাসহ ২৪৮ টাকা কেটে নেয়া হয়েছে। এভাবে ৫০০ টাকা বা ১০ হাজার টাকা অথবা টাকার হার যাই হোক না কেন, রিচার্জ করলেই ওই ৩১৬ টাকা কেটে নেয়া হয়। আবার মাসে যতবাবই রিচার্জ করা হবে ততবাবই ৩১৬ টাকা কাটা হচ্ছে। হিসাবটি এভাবেও করা য়ায়- ৩০০ টাকার রিচার্জে পাওয়া যায় ২০৫ টাকা, ৫০০ টাকায় ৩৯৬ টাকা ও ৩ হাজার টাকায় ২ হাজার ৭০০ টাকা।
এদিকে ডিমান্ড চার্জ, মিটার ভাড়া, সার্ভিস চার্জ মাসে একবারই কাটার কথা এবং ডিমান্ড চার্জ ও মিটার ভাড়া এক সময় পরিশোধ হয়ে গেলে টাকা আর কাটার কথা নয়। নিয়ম অনুযায়ী ব্যবহৃত বিদ্যুতের ওপর ভ্যাট প্রদেয়। কিন্তু ডিমান্ড চার্জ, মিটার ভাড়া, সার্ভিস চার্জ ও অন্যান্য খরচের ওপরও ভ্যাট নেয়া হচ্ছে। আর প্রতি মাসে মিটার ভাড়া ও ডিমান্ড চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে ভাড়াটিয়াকে। অথচ মিটার হলো বাড়ির মালিকের নামে। এর ভাড়া ও ডিমান্ড চার্জ বহন করার কথা বাড়িওয়ালার। এতে নির্দিষ্ট আয়ের ভাড়াটিয়ার ওপর এই প্রি-পেইড মিটার এখন একটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আগে সাধারণত ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে মাস শেষে বিল নিয়ে তা বাড়িওয়ালাই ব্যাংকে জমা দিতেন। এখন ওই দায়িত্ব ভাড়াটিয়ার ওপর এসে পড়েছে। টাকা শেষ হওয়ার আগেই রিচার্জ করা সম্ভব না হলে ঘরে বিদ্যুৎ থাকবে না। তাই তারা নিজের অন্য কাজ ফেলে বিল দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু সমস্যাটি হচ্ছে প্রিপেইড মিটারের গ্রাহক নিজেই বিল দিতে যাচ্ছেন।
অন্যদিকে কখনো কখনো ব্যাংকগুলো বিভিন্ন অজুহাতে বিদ্যুৎ বিল রিচার্জ করে না। তখন বাধ্য হয়ে যত দূরেই থাক না কেন, বিদ্যুৎ অফিসে যেতে হয়। সেখানেও থাকে লম্বা লাইন। ওই লাইনে যত গ্রাহকই থাকুন তাদের দাঁড় করিয়ে রেখেই বিল গ্রহণকারী দুপুরের খাবার বিরতিতে চলে যান। ফেরেন দু’ঘণ্টা পর। আবার অফিস সময় শেষ হয়ে গেলে গ্রাহকদের লাইনে রেখেই বিল নেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। বিদ্যুৎ বিভাগের উদাসীনতা ও বিল আদায় সহজ না করে প্রিপেইড মিটার চাপিয়ে দেয়ায় এভাবেই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন গ্রাহক।
বিদ্যুৎ বিল না নেয়া ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন অজুহাতের একটি হলো রসিদ না থাকা। কেননা বিদ্যুৎ বিভাগ বিল নেয়ার রসিদ সময়মতো ব্যাংকগুলোয় সরবরাহ করে না। তাই ভুয়া ও ভুতুড়ে বিলের হয়রানি থেকে মুক্তি পেতে প্রি-পেইড হলেও মেলেনি গ্রাহকের মুক্তি।
আরেক ভোগান্তি হলো টাকা রিচার্জ করে কার্ডের ২০০ ডিজিটের বিশাল আকৃতির গোপন নম্বরটি মিটারে চাপতে গিয়ে লক হয়ে যায়। এ বিষয়টি বিদ্যুৎ বিভাগকে জানিয়েও কোনো লাভ হয় না। অনেক কাঠখর পুড়িয়ে ৩ হাজার টাকা দিলে বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন ওই লক খুলে দেয়। টাকা দিলেই কেবল লক খুলে দিয়ে যায়।
বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটারকে প্রথমে সবাই আশীর্বাদ হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু তা এখন ভোগান্তির বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এটি সাধারণ মানুষের জন্য নতুন এক কষ্টের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণে বিদ্যুৎ বিভাগকে উদাসীনতা পরিহার করে এখনই পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।