নজরুল নিয়া আলোচনা-সমালোচনার ধারা যদি আমরা মনযোগ দিয়ে খেয়াল করি তাইলে দেখব আমাদের সমাজের বিভাজিত চিন্তাপদ্ধতির একটা চাবুকও মাটিতে পড়ে নাই। শুধু চাবুকের কথা বললে একপেশে হবে কথাটা। ফুলও কম পড়ে নাই। কিন্তু ফুল-চাবুক যাই জুটুক না কেন, নজরুল পাঠ করবার ক্ষেত্রে আমাদের বাংলাদেশের এই মূহুর্তের সঙ্কটকে আমরা পাশ কটিয়ে গেছি। আমরা নজরুলের বিচার বিশ্লেষণে নিজেদের হীনমন্যতাকেই প্রাধান্য দিয়েছি। সংক্ষেপে এই দিকটা একটু আলাপ করেই লেখা শেষ করব।
বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে নজরুলকে নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে যে সমস্যাগুলো প্রায় কমন তার কয়েকটি সংক্ষেপে বলে নিবো।
হিন্দু-মুসলমান প্রসঙ্গ, প্রগতিশীল আর প্রতিক্রীয়াশীল দ্বন্দ্ব, বড় কবি বনাম ছোট কবি বাহাস। আধুনিক কবি না সেকেলে কবি– এই সব কথাই ঘুরে ফিরে আলোচনায় আসে। এর মধ্যে কমিউনিস্টপন্থিরা আবার আরও সরস। তাদের কাছে নজরুলের সাম্যবাদ ঠিক গ্রহণযোগ্য নয় কারণ এর মধ্যে ধর্ম ব্যাপারটা সরাসরি হাজির আছে। নজরুল হিন্দু কি যবন কোন ঘরই বাদ দেন নাই। ফলে রিলিজয়ন বিশেষ করে ইসলাম নিয়া যারা ফোবিয়াগ্রস্ত, নজরুল তাদের কাছে এক অস্বস্তির নাম। এর মধ্যে হালের ক্রিটিক্যাল চিন্তাবিদরা আবার নজরুলের এই সব প্রবণতাকে সেক্যুলার প্রবণতা বলে সাব্যস্ত করেছেন। সেক্যুলার কনটেন্ট নজরুলে নাই তা বলা যাবে না। কিন্তু আমাদের এখানকার প্রগতিশীল-বামপন্থা যে নিরিখে সেকুলার ধারাটা চর্চা করে তার সাথে নজরুলের কোন যোগ নাই। নজরুলের রিলিজিয়ন কখনোই বাইরের ব্যাপার বলে সাব্যস্ত যেমন হয়নি, তেমনি রিলিজিয়নের ভেতরে থেকেও ঐক্যের বীণা বাজাতে সুরের ঘাটতি হয়নি। মানে ঐক্যের জন্য নিজের মুসলমান পরিচয় নিয়ে কোন হীনমন্যতার আভাস অন্তত নজরুলের লেখালেখিতে নাই। বরং এই পরিচয়কে ধরেই ঐক্য নিয়ে ভেবেছেন। নব্যসেক্যুলারদের মতো হিন্দু হয়ে বাঙালি হতে হয় নাই নজরুলকে। এই দিকটা বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। এখানে যাস্ট নোক্তা দিলাম।
কমিউনিস্টদের অভিযোগ হল, নজরুল মুসলীম লীগের জাতীয় চেতনার ধারায় প্রভাবিত ছিলেন। নজরুলের মানবতাবাদকে তারা ইউরোপীয় হিউম্যানিজম থেকে আদালা করে দেখেন না। কিন্তু নজরুল যদি তারা ‘পাঠ’ করেন তাইলে তাদের ঘোর কাটবে বলেই আমার বিশ্বাস। আমি কয়েকটি রচনার দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। নজরুলের কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ -এসবের মূলসুরই হচ্ছে শোষণ-বঞ্চনা, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, রাজনৈতিক নিপীড়ন, উপনিবেশিক শাসনসহ নানান অনাচার এবং অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা। বাংলা সাহিত্যের আমূল এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তনের এই মহান নায়ক বাংলা সাহিত্যকে যেভাবে গণমানুষের কাতারে নিয়ে এসেছেন আর কোন কবি কিংবা সাহিত্যিক তা পারেননি। বাংলা সাহিত্য যেখানে ছিল সমাজপতি, রাজন্যবর্গ এবং সমাজের তথাকথিত উঁচুশ্রেণীর জীবন চেতনার আলেখ্য; সেখানে নজরুলই সাহিত্যের পাতায় যথাযথভাবে স্থান দিয়েছেন গণমানুষের চাওয়া-পাওয়া, আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ, তাদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভকে। নজরুলই সাহিত্যকে রাজসিংহাসন থেকে টেনে নিয়ে এসেছেন জনতার কাতারে। নজরুলের হিউম্যানিস্ট ভাবাদর্শকে রাজনৈতিক ভাবে ক্রিটিক করার কমিউনিস্টধারার প্রতি আমরা সন্তুষ্ট থাকতে পারি না। বিশেষ করে যখন রাজনৈতিক লড়াইয়ে নজরুল জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইয়েই শামিল ছিলেন, এই দিক দিয়ে নজরুল শুধু সাংস্কৃতিক না, আমাদের রাজনৈতিক লড়াইয়েও কাজে লাগবে। এই প্রসঙ্গে নজরুলের নিজের ভাষ্য আমরা পাই রাজবন্দীর জবানবন্দীতে। তিনি লিখেছেন,
আমরা নজরুলকে পড়ি কিন্তু ‘পাঠ’ করি না। নজরুলকে সাম্প্রতিক করে তোলার জন্য যে মেহনত দরকার তা আমরা করি না। আমরা যার যার গোষ্ঠির সাংস্কৃতিক সম্পত্তিতে নজরুলের স্বত্ব নিজেদের দখলে নিতে নানা রকম ফ্যাশনেবল কর্থাবার্তা চালু করেছি মাত্র।
“আমি পরম আত্মবিশ্বাসী। তাই যা অন্যায় বলে বুঝেছি, তাকে অন্যায় বলে বলেছি, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি, কাহারো তোষামোদ করি নাই, প্রশংসা এবং প্রমাদের লোভে কাহারো পিছনে পোঁ ধরি নাই, -আমি শুধু রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি নাই। সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধে আমার সত্য তরবারির তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, -তার জন্য ঘরে-বাইরের বিদ্রুপ, অপমান, লাঞ্চনা, আঘাত আমার উপর অপর্যাপ্ত পরিমাণে বর্ষিত হয়েছে, কিন্তু কোন কিছুর ভয়েই নিজের সত্যকে, আপন ভগবানকে হীন করি নাই, লোভের বশবর্তী হয়ে আত্ম-উপলব্ধিকে বিক্রয় করি নাই, নিজের সাধনালব্ধ বিপুল আত্মপ্রসাদকে খাটো করি নাই, কেননা আমি যে ভগবানের প্রিয়, সত্যের হাতের বীণা; আমি যে কবি, আমার আত্মা যে সত্যদ্রষ্ট রিষির আত্মা”। (পৃষ্ঠা:৭৮-৭৯)
এখন আমরা যারা রিলিজিয়নকে পশ্চিমা বা আধুনিক অর্থে বুঝি তাদের কাছে কবির এই আত্ন-ভগবানকে চেনা কি সম্ভব? রবীন্দ্রনাথ নিজের আত্মপরিচয়ের মূল শাসকে হিন্দু বলে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমি যে হিন্দু এই সম্পর্কে আমার ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কোন বালাই নাই। তিনি ইতিহাসের আলোকে নিজের যে আত্মপরিচয় নির্ধারণ করেছেন তা শুধু হিন্দু বললে ভুল হবে, বলতে হবে সেকুলার হিন্দু। কিন্তু নজরুলের এসবের দরকার ছিল না। কেননা তার মধ্যে ধর্মের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার সাথে নিজের প্রাণধর্মের একটা মোকাবিলা তিনি করে নিয়েছিলেন। ফলে শরিয়তের ধর্ম বা ইসলাম আর কবির প্রাণধর্ম -এই দুইটার তফাত নিয়ে আলোচনা না করে নজরুলের হিন্দু-মুসলমান নিয়ে কথা বলা গণমূর্খতা। নজরুল নিজের মতো করে এইটার মোকাবেলা করেছেন বলা যায়। এই মোকাবেলার যে রুপকে আমরা কাব্যে দেখি তাকে পপুলার অর্থে আমরা বিদ্রোহী বলি।
সংক্ষেপে আমি নজরুল থেকে একটা প্রসঙ্গ টেনে যা লিখতে চাইলাম তা হল– আমরা নজরুলকে পড়ি কিন্তু ‘পাঠ’ করি না। নজরুলকে সাম্প্রতিক করে তোলার জন্য যে মেহনত দরকার তা আমরা করি না। আমরা যার যার গোষ্ঠির সাংস্কৃতিক সম্পত্তিতে নজরুলের স্বত্ব নিজেদের দখলে নিতে নানা রকম ফ্যাশনেবল কর্থাবার্তা চালু করেছি মাত্র। তা না হলে এত দিনেও কেন নজরুলকে নিয়ে গোষ্ঠিবাদি আলোচনা করতে হয়। নজরুলের কবিতা আধুনিক কি না তা নিয়া গবেষণা করতে হয়?
যে কবি কবিতায় বাংলার কৃষক জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার চিত্র এঁকেছেন। তারা কীভাবে প্রাণ প্রাচুর্যে দেশের সমৃদ্ধি ঘটায় এবং বঞ্চিত হয় এগুলো সত্যদ্রষ্টার নয়নে হাজির করেছেন। জুলুমের অবসানের জন্য কৃষক জাগরণের আবশ্যকতাও কবি ব্যাখ্যা করেছেন। বাংলার কৃষি আর কৃষক জীবনের চালচিত্র নিয়ে লেখার জন্য পত্রিকাও প্রকাশ করেছেন। এই ধারার কবির উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হচ্ছে : ‘সর্বহারা’ (১৯২৬) কাব্যের ‘কৃষকের গান’, ‘জিঞ্জির’ (১৯২৮) কাব্যের ‘অঘ্রাণের সওগাত’, ‘প্রলয় শিখা’ (১৯৩০) কাব্যের ‘চাষার গান’, ‘নতুন চাঁদ’ এর ‘ওঠরে চাষী’, ‘কৃষকের ঈদ’, মক্তব সাহিত্যের ‘চাষী’ এবং অগ্রন্থিত ‘চাষীর গীত’, ‘কৃষকের গান’, ‘জাগরে হলধর’ প্রভৃতি। তাছাড়া গোটা প্রাণটাই ছিল মজলুমের প্রেমের বায়ুতে ঠাসা। এই হল নজরুল।
আমাদের বুঝতে হবে, কবি কোন আদর্শপূজারী নাও হতে পারেন। জগতে নানা ধর্ম আছে, মত আছে। এই সবের সাথে কবি সম্পর্ক করেন। কোনটা কে যুগধর্ম বলেন, মানবধর্ম বলেন, আচারধর্ম বলেন। কিন্তু কবি চর্চা করেন প্রাণধর্ম। নজরুলের মূল হল এই প্রাণধর্ম। এই জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে তিনি জগতের অপরাপর মানুষ বা প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক করেছেন। প্রাণধর্মের মধ্যে মোরালিটির প্রাবল্য থাকতেই পারে। সেই দিক থেকে স্বাভাবিক ভাবেই তিনি মজলুমের পক্ষে লড়াকু ছিলেন। তাঁর কাছে রাজনীতির বিবেচনাটা রাজনৈতিক নেতাদের মত কৌশলী ছিল না। তিনি প্রাণধর্মের টানে সবাইরে কাছে টেনেছেন। কার আধুনিক সমস্যা আর কার সেক্যুলার সমস্যা এগুলো নজরুলের বিবেচনায় ছিল না। নজরুল সরল অর্থে সবকিছুর মধ্যে এই প্রাণধর্মকে চর্চা করেছেন। ফলে একাট্টা কোন কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা নজরুলের বেলায় বেহুদা চেষ্টা। আর কৃষকদের প্রতি নজরুলের দরদ বা প্রাণের টান পাঠক মাত্রই জানেন। কিন্তু জমিদারি উচ্ছেদের রাজনৈতিক তাগিদও যে নজরুলের ছিল না তা নয়। কিন্তু উনি যেহেতু পার্টি করেননি তাই মুসলিম লীগের সাথে মিলে একই কায়দায় শ্লোগান ধরেননি। ফলে রাজনীতির নিরিখে নজরুলকে যারা অভিযোগ করেন তাদের একটু হুশিয়ার হবার দরকার আছে। যা হোক নজরুল আলোচনার জন্য আমাদের কবির প্রাণধর্ম বিষয়টা বুঝতে হবে। আগাম তত্বের গোলামী কবি করেন না। এই প্রাণধর্ম ব্যাপারটা ধর্মের প্রাণভোমরা। ফলে নজরুলও বাংলার প্রাণভোমরা। প্রাণকে ছুঁতে হলে শুধু তত্ত্বের কচকচানি দিয়ে হয় না। থাকতে হয় সজীব প্রাণ। আমরা নজরুলকে পাঠ করার জন্য কি নিজেদের প্রাণকে সতেজ করে তুলেছি? মজলুমের প্রাণের সাথে প্রাণের টান না থাকলে নজরুল বিষয়ে মধ্যবিত্ত ফ্যাশনওয়ালা বা অধ্যাপকীয় পড়াশোনা কোন কাজে আসবে না। আমরা কি নিজেদের প্রাণধর্মের টানে লড়াকু হতে পেরেছি? নজরুল রিডিং পড়ে কি হল তাইলে? আমর নজরুলের সাহিত্য থেকে যদি রস নিয়ে আমোদ করি তাইলে ক্রাইম হবে। এই দিকটি বিবেচনায় রেখে আমরা নজরুলকে সাম্প্রতিক করে তুলতে চাই। তাই বাংলাদেশে নতুন করে নজরুল পাঠের প্রস্তাব দিচ্ছি।
(২০১৩ সালে মুন্সিগঞ্জের সরকারি হরগঙ্গা কলেজে প্রদত্ত বক্তৃতার লিখিত রুপ)