তুরস্কের অন্যতম প্রধান শহর ইস্তানবুল। প্রাচীনকালে শহরটির নাম ছিল কন্সটান্টিনোপল। এছাড়া এটি বাইজান্টিয়াম নামেও পরিচিত ছিল। ঐতিহ্যবাহী এই শহরটি অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। ১৪৫৩ সালে এটি তৎকালীন অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ঘোষিত হয়। ফলে শহরটি তুরস্কের সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। তৎকালীন সময়ে এটিকে ইসলামি সংস্কৃতির রাজধানী হিসাবেও বিবেচনা করা হত। ১৯২৩ সাল পর্যন্ত ইস্তানবুলেই ছিল তুরস্কের রাজধানী। ইস্তানবুলের খ্যাতির আরেকটি কারণ হচ্ছে এই শহরটি এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশকে বিভক্ত করেছে। স্থাপত্যকলার দিক থেকে এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে মসজিদ। ইস্তানবুলে অবস্থিত মসজিদের নির্মাণশৈলী এবং গঠন অত্যন্ত আকর্ষনীয়। প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক শুধুমাত্র ইস্তানবুলের মসজিদ দেখার জন্য তুরস্কে গমন করেন।
অটোম্যানদের শাসন, বিভিন্ন ধর্মের উত্থান-পতন এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ইবাদতের ইতিহাস বহন করছে এই শহরটি। গণনা করে দেখা গেছে, শহরটিতে প্রায় ৩ হাজার মসজিদ রয়েছে। শহরের যে কোন প্রান্ত থেকে সুউচ্চ মিনার ও মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজানের ধ্বনি সকল মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। এই শহরের অন্যতম আকর্ষণীয় মসজিদ হচ্ছে ‘শাকিরিন মসজিদ’। যদিও এটি কোন প্রাচীন মসজিদ নয়। ২০০৯ সালের ৭ই মে দর্শনার্থী ও ইবাদতকারীদের জন্য এই মসজিদটি খুলে দেয়া হয়।

এই মসজিদটির সবচেয়ে আলোচিত দিক হচ্ছে, এই মসজিদটির ডিজাইনার একজন নারী। ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এটিই কোন নারীর হাতে ডিজাইনকৃত প্রথম মসজিদ। উক্ত ডিজাইনারের নাম জয়নাব ফেদিলুগলু। ফেদিলুগলু জন্ম ইস্তানবুল শহরেই। বিবিসিতে প্রকাশিত ফেদিলুগলুর পরিচিতিতে বলা হয়েছে– জয়নাব ফেদিলুগলু একজন পুরস্কার বিজয়ী ডিজাইনার যিনি ইস্তাম্বুলে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই বেড়ে ওঠেন। তবে তিনি যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, কুয়েত, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, ভারত, কাতার, দুবাই, আবু ধাবি, হল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তার প্রকল্প সম্পন্ন করেছেন।
তিনি ইংল্যান্ডের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান অধ্যয়ন শেষ করেছেন। এর আগে তিনি লন্ডনের ইঙ্কবাল্ড স্কুল অফ ডিজাইন থেকে আর্ট হিস্ট্রি অ্যান্ড ডিজাইন কোর্স সম্পন্ন করেছেন।
শাকিরিন মসজিদ নির্মাণে অর্থায়ন করেছে ইব্রাহীম ও সামিহা শাকিরের স্মৃতি বিজড়িত শাকির ফাউন্ডেশন। মসজিদটির ডিজাইনার জয়নাব ফেদিলুগলু সম্পর্কের দিক দিয়ে ইব্রাহিম ও সামিহা শাকিরের নাতি। ফেদিলুগলুর দাবি, তিনি অটোম্যান সাম্রাজ্যের স্থাপত্যশৈলী অনুসরণ করে এই নয়নাভিরাম মসজিদটির ডিজাইন করেছেন। ইস্তাম্বুলেই বেড়ে ওঠার সুবাদে জয়নাব ফেদিলুগলু স্থানীয় ও আধুনিক স্থাপত্যশৈলী দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। এর আগে জয়নাব নাইটক্লাব, হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং দোকানসহ বিভিন্ন স্থাপনার নকশা করলেও শাকিরিন মসজিদ ছিল তার ডিজাইন করা প্রথম কোন ইবাদতখানা। সূত্রানুসারে, তিনি বিশ্বব্যাপি এক শতাধিক নান্দনিক স্থাপত্যের ডিজাইন করেছেন। তবে শাকিরিন মসজিদ ডিজাইনের মধ্য দিয়েই তিনি আলোচনায় আসেন।

কাজ চলার সময়ও তিনি কলা ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় পণ্ডিতদের সাথেও কথা বলেছেন। তাদের কাছে তিনি জানতে চেয়েছেন যে, তার করা ডিজাইন নামাজের স্থানের জন্য যথার্থ কি না। তিনি জানান, এর রঙ, কারুশিল্প ও গঠন যাই হোকনা কেন আমি প্রতিটি ক্ষেত্রেই মসজিদের ডিজাইনের সাথে সাথে ইসলামের ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।

তিনি বলেন, আমি পরিবর্তনশীলতায় বিশ্বাস করি। আমি ক্রমাগত আমার নিজের উন্নতি সাধনের চেষ্টা করেছি। আমি তার ফলও দেখতে পাচ্ছি। আমি রং, কাপড় ও ফর্ম পছন্দ করি। এর মধ্য দিয়ে আমি আমাকে একজন স্বনির্ভর স্থপতি হিসাবে তুলে ধরতে চাই’।

স্থাপত্যশিল্পের ছাত্র না হয়েও তিনি কিভাবে স্থাপত্যশিল্পে সাথে জড়িত হলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার বয়স যখন ১২ বছর তখনই আমি স্থাপত্যশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হই। আর্ট ও ডিজাইনের ইতিহাস অধ্যয়নের সময়ে একটি টিম গঠন করি, সেখানে ১৩ জন ডিজাইনার এবং ১২ জন স্থপতি ছিলেন। তারা আমাকে স্থাপত্যশিল্পের প্রতি আগ্রহী করে তোলেন।

আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর সাথে মিল রেখে শাকিরিন মসজিদের বহিরাংশ নকশা করা হয়েছে মসৃন, মেটালিক ও ধূসর বর্ণের রং দিয়ে। ফেদিলুগলুর নিজের ভাষ্য অনুসারে, যে বিষয়গুলো মসজিদটিকে অন্য মসজিদগুলো থেকে আলাদা করেছে তা হচ্ছে, যখন আপনি মসজিদটির বিশাল গম্বুজের নিচে দাঁড়াবেন তখন এক আধ্যাত্মিক আবেশ আপনাকে বেষ্টন করে রাখবে। খানিকটা নিচুতে ঝুলন্ত ঝাড়বাতিগুলো দেখে আপনি মানসিক স্বস্তি লাভ করবেন। দেয়ালের পরিবর্তে এখানে রয়েছে বিশাল আকৃতির জানালা। কিছু জটিল কাজও করা হয়েছে এখানে। মাঝে মাঝে কিছু আলোর প্রতিচ্ছবি যেন স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিবে আপনাকে।

ঝুলে থাকা এসব ঝাড়বাতি এক অনুপম বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছে। উল্টে থাকা ফোঁটার মত এই বাতিগুলো থেকে যে আলো আসছে তা নামাজের গুরুত্ব ও মহত্ব প্রকাশ করছে। তা দেখে মনে হয় নামাজীর উপর আল্লাহর রহমত বৃষ্টির ন্যায় অবিরাম ধারায় বর্ষিত হচ্ছে। এই ঝাড়বাতিগুলোর পরিবেষ্টক রিংটিতে আল্লাহর মহা পবিত্র ৯৯ টি নাম নকশা করে খচিত করা হয়েছে। সেই সাথে মসজিদটির নামও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শাকিরিন শব্দটি আরবি, এর অর্থ হচ্ছে ‘আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন’।

প্রথমবারের মত কোন নারী কর্তৃক নকশাকৃত শাকিরিন মসজিদে মহিলাদের নামাজের জন্য আলাদা জায়গা রয়েছে। তুরস্কে মহিলারা সাধারণত পুরুষদের পেছনে কিংবা পর্দা ঘেরা অংশে নামাজ আদায় করে থাকেন, কিন্তু শাকিরিন মসজিদের ব্যবস্থাপনা আলাদা। মসজিদটির দ্বিতীয় তলায় মহিলাদের জন্য আলাদা সুন্দর ও পরিপাটি নামাজের স্থান তৈরি করে দেয়া হয়েছে।

শাকিরিন মসজিদটি অতীত ও বর্তমান কালের স্থাপত্যকলার অনন্য প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মসজিদটির ডিজাইনে পূর্ব ও পশ্চিমের স্থাপত্যবিদ্যার যৌথ প্রয়োগ হয়েছে। আধুনিক ডিজাইনের মধ্যে নিজস্ব সংস্কৃতির সংমিশ্রণে এটির নান্দনিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া এ মসজিদটিতেও অন্যান্য মসজিদের মত এখানেও রয়েছে পবিত্রতা। মসজিদের সাথে সংযুক্ত রয়েছে দুটি সৌন্দর্যমণ্ডিত মিনার ও একটি সুদৃশ্য গম্বুজ।
শাকিরিন মসজিদের ডিজাইনের মাধ্যমে জয়নাব ফেদিলুগলুর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে তিনি আরও বেশি কাজের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পান। কাতারের দোহায় আরেকটি দৃষ্টিনন্দন মসজিদের নকশা করেন। ২০১০ সালে উন্মুক্ত হওয়া এই মসজিদটির নাম ‘সোনালী মসজিদ’। সর্বপরি, মসজিদ ও স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসে জয়নাব ফেদিলুগলু ও শাকিরিন মসজিদের নাম নিশ্চয়ই উজ্জ্বল অক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।
