১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরের সময়ে ভারত নেহেরু ডকট্রিনের অংশ হিসেবে প্রতিপক্ষ দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তারে গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের বিস্তৃত করতে শুরু করে। ষাটের দশকের শেষার্ধে আইবি ভেঙে বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (Raw) গঠনের পর ভারতের ‘গোয়েন্দা যুদ্ধ’ চালানোর সক্ষমতা বেশ বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৫ সালে সিকিমকে ভারতের সাথে একীভূত করে নেয়ার মধ্য দিয়ে সংস্থাটি একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করে।
অনেকে মনে করেন, এর আগে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল সংস্থাটির প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। ভারতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো, পাকিস্তানের বেলুচ এবং খাইবার পাখতুনখোয়া ও ‘ফাটা’ এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করা। এ দুটো এলাকার সাথে ভারতের সীমান্ত সংযোগ না থাকায় ডার্টি ওয়ারে বেলুচিস্তান-পাখতুনখোয়ায় সাফল্য অতটা পাওয়া যায়নি।
তবে আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের অবসানের পর সেখানে ভারতের বিশেষ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থেমে নেই। আর এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেতে থাকে নয়া দিল্লি। আফগান-তালেবানের বিপরীতে পাকিস্তানি-তালেবানের সাথে এক বিশেষ যোগসূত্র তৈরি করতে সক্ষম হয় ভারত। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত সমঝোতা বিরাট সুযোগ এনে দেয় নয়া দিল্লির হাতে।
দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান প্রাথমিকভাবে ‘ডার্টি ওয়ার’-এর প্রতি ততটা কৌশলগত গুরুত্ব দেয়নি। ফলে ১৯৭১ সালে দেশটির পূর্বাংশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তারা এ ধরনের কোনো কৌশলের সার্থক প্রয়োগ ঘটাতে পারেনি। কিন্তু ’৭০-এর দশকের পর থেকে পাকিস্তানও ভারতের সাথে টেক্কা দিয়ে পাল্টা ‘ডার্টি’ ওয়ারের প্রতি গুরুত্ব দিতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যস্থল হয় কাশ্মির, উত্তরপূর্ব ভারতের সাত রাজ্য ও পাঞ্জাব। কাশ্মির ও পাঞ্জাবের সাথে পাকিস্তানের স্থলসীমান্ত থাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কৌশলগত নেটওয়ার্ক বিস্তার ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সাহায্য সহযোগিতা করা সহজ হয়। সে তুলনায় দূরবর্তী সাত রাজ্যে পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য কিছু করার অবকাশ থাকে না। বরং এক্ষেত্রে চীন ও বাংলাদেশ এ অঞ্চলের সাথে সীমান্তসংলগ্ন হওয়ায় সেসব দেশের নিজস্ব নেটওয়ার্ক এক্ষেত্রে কার্যকর হয়ে দাঁড়ায়।
ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাশ্মির একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। যে নীতির ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ ঘটেছে, তাতে এই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পাকিস্তানের অংশ হওয়ার কথা -এটা অনেকেই মনে করেন। আর বাংলা ও পাঞ্জাবের মতো গণভোটের মাধ্যমে প্রদেশ বিভাজনের ঘটনা ঘটলে জম্মুর অংশবিশেষ ভারতের অঙ্গ হলেও কাশ্মির উপত্যকা পাকিস্তানের অংশ হবে এটা বলাই যায়। কিন্তু কাশ্মিরের রাজার ভারতে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ এবং ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা শেখ আব্দুল্লাহর দিল্লির প্রতি আনুকূল্য দেখানোর ফলে কাশ্মির ভারতের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। অনেক গবেষক মনে করেন নেহেরুর কৌশল বুঝতে না পেরে কাশ্মির শুরুতেই চূড়ান্ত ভুল করে। দিল্লীর প্রতি এই সমর্থন কাশ্মিরকে স্বাধীনতা অর্জনের দৌড় থেকে ছিটে ফেলেছে সেই শুরু দিকেই। পরে এ নিয়ে পাকিস্তান সেনা অভিযান শুরু করলে বর্তমান আজাদ কাশ্মির পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আর অস্থির ও উত্তপ্ত থেকে যায় জম্মু-কাশ্মির। পাকিস্তান ডার্টি ওয়ারের পাল্টা কৌশল গ্রহণের আগ পর্যন্ত কাশ্মিরের স্বাধীনতার দাবিকে সশস্ত্র রূপ নিতে দেখা যায়নি।
পাঞ্জাবে নোংরা যুদ্ধের প্রভাব লক্ষ করা যায় খালিস্তান আন্দোলনের সময়। এ সময় খালিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাকিস্তানে গোপন আশ্রয় ও প্রশ্রয় লাভ করে। কিন্তু ভারত পাঞ্জাবে সর্বাত্মক বিদ্রোহ নির্মূল অভিযানে নামলে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো তাতে সাহায্য করায় এই আন্দোলনের অকালমৃত্যু ঘটেছে বলে মনে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য পাঞ্জাবে নতুন করে অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
উপমহাদেশে আঞ্চলিক যে ডার্টি ওয়ার গেম চলছে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হচ্ছে, প্রতিপক্ষের মানচিত্র পরিবর্তন বা কোনো অংশকে নিজ প্রভাবের অধীনে নিয়ে আসা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের সর্বাত্মক সমর্থন দেয়াকে অনেক পাকিস্তানি বিশ্লেষক ভারতের ডার্টি ওয়ার কৌশলের অংশ মনে করেন।
এখন পাকিস্তানের করাচি, বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়া এবং ফেডারেল টেরিটরি অঞ্চলে যে অস্থিরতা চলছে, তাকেও ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টি ওয়ার গেমের অংশ মনে করেন ইসলামাবাদের বিশ্লেষকেরা। অন্য দিকে কাশ্মিরের উত্তপ্ত অবস্থা এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্যে অস্থিরতার পেছনে চীন-পাকিস্তানের ডার্টি ওয়ার গেম সক্রিয় বলে মনে করা হয়।
ডার্টি ওয়ার গেম যেখানেই সংঘটিত হোক না কেন, তার অনিবার্য পরিণতি ব্যাপক রক্তক্ষয় ও ধ্বংসযজ্ঞ। অনেক সময় নিজ হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিস্তারের জন্য মিত্র শক্তির ওপর আঘাত হানাকে কৌশলের অংশ মনে করা হয় এ যুদ্ধে। এ জন্য এ যুদ্ধে শত্রু-মিত্র সবাই থাকে ঝুঁকির মধ্যে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের বিমান দুর্ঘটনায় আমেরিকান কর্মকর্তাদের মৃত্যুকে এভাবে ব্যাখ্যা করেন অনেকে।
বিশ্বের শান্তি ও স্থিতির সাথে ডার্টি ওয়ারের বা গোয়েন্দা যুদ্ধের সম্পর্ক বিপরীতধর্মী। কূটনীতিনির্ভর পররাষ্ট্র সম্পর্কের ওপর যখনই গোয়েন্দানির্ভরতা প্রাধান্য লাভ করে, তখন বিশ্বের অনেক অঞ্চল হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। এ অবস্থা এখন দেখা যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের একই অবস্থার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা অনেকের। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বিরোধী পক্ষের আন্দোলন ও তা দমনে কত লোক ক্ষয় তথা খুন গুম অপহরণ ক্রসফায়ার ও অন্যান্য বিচারবহির্র্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। তবে এসব তথ্য একসময় বিদেশী সূত্র থেকে প্রকাশ হয়ে পড়ে।
এখন জানা যাচ্ছে আর্জেন্টিনায় বামপন্থী আন্দোলন দমনের নামে যে ডার্টি ওয়ার চলেছিল, তাতে ৩০ হাজার বাম অ্যাকটিভিস্ট, ইউনিয়নিস্ট, ছাত্র, সাংবাদিক, মার্কসিস্ট ও পেরোনিস্ট গেরিলাকে হত্যা করা হয়েছে। চিলির অবমুক্ত দলিল থেকে এখন এই তথ্য জানা যাচ্ছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত সময়ে ডার্টি ওয়ারে সেখানে ২২ হাজার লোক নিহত বা গুম হয়েছেন। অন্য দেশের ডার্টি ওয়ারেও বিপুলসংখ্যক লোক এভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন।
দুই দশক আগে আলজেরিয়ায় ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্টের বিজয়ের পর ইসলামিস্টদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে ১০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। মিসরে ব্রাদারহুড-বিরোধী অভিযানে নিহতের সংখ্যা সাত হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে বেসরকারি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। আফ-পাক এলাকায় নিহতের সঠিক সংখ্যা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। তবে এ সংখ্যা পাকিস্তানে লাখ ছাড়িয়ে গেছে!
সিরিয়ায় হাফিজ আল আসাদের সময় ৩০ হাজার লোক নিহত হয়েছেন। বাশার আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে পৌনে চার লাখ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক লোকক্ষয়ের পর ’৭৩-৭৪ সালে বিপুলসংখ্যায় রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বী নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। চলতি দশকে লক্ষ করা যাচ্ছে এর পুনরাবৃত্তি।
পৃথিবীর যেখানেই এই ধরনের পাল্টা-পাল্টি গোয়েন্দাযুদ্ধ বা ডার্টি ওয়ার চলেছে সাধারণ মানুষকে জীবন দিয়ে এর মূল্য দিতে হয়েছে। এ যেন এক নিরব যুদ্ধ। এটা মনস্তাত্বিক যুদ্ধকে আরও চাঙ্গা করে। উপমহাদেশ তথা সারা দুনিয়াতেই এখন চলছে এই ডার্টি ওয়ার-র যুগ। বলাই বাহুল্য আমাদের দেশের সেই ধরণের কোন শক্তি বা কৌশল নেই। গোয়েন্দা শক্তির দিক থেকে বাংলাদেশ লজ্জাজনক ভাবে পিছিয়ে আছে। ফলে অন্যদেশের ডার্টি ওয়ার জোনে পরিণত হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আর এটাকে ক্ষমতায় থাকার জন্য ব্যবহার করছে জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক শক্তিগুলো।