রাশিয়া আসরে আফ্রিকার ৫টি দলের বিস্তারিত

রাশিয়া আসরে আফ্রিকার ৫টি দলের বিস্তারিত

বিশ্বকাপের একবিংশতম আসর বসছে সুদূর রাশিয়ায়। বাংলাদেশে কি এর উত্তেজনা কম? মোটেই না! নিজেরা বিশ্বকাপে খেলতে না পারলেও সাপোর্ট দিতে বাঁধা কিসের? ব্রাজিল আর্জেন্টিনার চিরায়ত তর্কে হালফিলে ভাগ বসিয়েছে পর্তুগাল, জার্মানি, স্পেন। আফ্রিকায়ও বিশ্বকাপ উত্তেজনার কমতি নেই। প্রতিবারের মত আফ্রিকা মহাদেশ থেকে থাকছে ৫ প্রতিনিধি। সাফল্য কিংবা সম্ভাবনায় তারা পিছিয়ে থাকায় আলোচনা হয় না তেমন। কিন্তু ইতিহাস বলছে, এই দলগুলোই অতীতে জন্ম দিয়েছে অঘটনের। বিশ্বকাপ ফুটবলের এবারের আসরে অংশ নেওয়া ৩২ দল আসছে ভিন্ন পাঁচটি অঞ্চল থেকে। সেসব অঞ্চল নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্বে আজ থাকছে আফ্রিকা মহাদেশের দলগুলো।

আফ্রিকা থেকে বিশ্বকাপে উত্তীর্ণ দলসমূহ…

• মিশর
• মরক্কো
• নাইজেরিয়া
• তিউনিসিয়া
• সেনেগাল

মিশর
ডাকনাম : দ্য ফারাও’স
হেডকোচ : হেক্টর কুপার (আর্জেন্টিনা)
অধিনায়ক : ইস্সাম আল হাদারি
ফিফা র‍্যাংকিং : ৪৬
বিশ্বকাপে মোট অংশগ্রহণ : ০২ বার
সর্বোচ্চ সাফল্য : গ্রুপ পর্ব

পিরামিডের দেশ মিশর আফ্রিকান ফুটবলে সমীহ জাগানিয়া নাম। সাতবার আফ্রিকান নেশন্স কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া সেই সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু বিশ্বকাপে তারা কতটা সফল? মোটেই না! ১৯৩৪ সালে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসরে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে খেলার সুযোগ পায়। তারপর শীতনিদ্রায় আচ্ছন্ন। ৫৬ বছর আর এগারো আসর বাদে ফুটবল মহাযজ্ঞে পুণরাগমন ঘটে ফারাওদের। বিশ্বকাপে এত দীর্ঘ বিরতি দিয়েছে আর কেবল নরওয়ে (১৯৩৮-১৯৯৪)। দারুণ কামব্যাক হতে হতেও হয়নি সেবার। হল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ড্র করলেও আরেক ‘ল্যান্ড’ ইংল্যান্ডের কাছে পরাজয়ে পা মাটিতে নামে মিশরের। এরপর আবার ঘুম। এবার ঘুম ভেঙ্গেছে আটাশ বছর পর। অক্টোবর ৮, ২০১৭। সালাহর জোড়া গোলে কঙ্গোকে ২-১ গোলে হারিয়ে মেলে আরাধ্য বিশ্বকাপের টিকিট। হেক্টর কুপারের কোচিংয়ে বাছাইপর্বে নিজ গ্রুপে সেরা হয়েই রাশিয়ায় এসেছে মিশর। মাঠে থাকছেন এই মূহুর্তে তর্কাতীতভাবে সেরা ফুটবলার মোহাম্মদ সালাহ। ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে থেকেই দেশকে বিশ্বকাপে এনেছেন। সালাহকে সঙ্গ দিতে প্রস্তুত আছেন মাহমুদ ট্রেজেগুয়েট, আহমাদ নেনি, রমাদান সাভির মতো প্রতিশ্রুতিশীলরা। গ্রুপ ‘এ’ তে স্বাগতিক রাশিয়া, সৌদি আরব ও উরুগুয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে পারে কি না সেটিই এখন দেখার অপেক্ষা।

মরক্কো

ডাকনাম : আটলাস লায়ন্স
হেডকোচ :  হার্ভে রেনার্ড (ফ্রান্স)
অধিনায়ক : মেহদি বেনাশিয়া
ফিফা র‍্যাংকিং : ৪২
বিশ্বকাপে মোট অংশগ্রহণ : ৪ বার
সর্বোচ্চ সাফল্য : দ্বিতীয় রাউন্ড

১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো খেলার সুযোগ পায় মরক্কো। তখন থেকেই ফুটবল বিশ্ব চেনে আফ্রিকার এই মুসলিম দেশটিকে। এর পরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়লেও ষোল বছর পর আবারো ফিরে আসে মেক্সিকো বিশ্বকাপেই। ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে তাক লাগিয়ে দেয় আফ্রিকার এই দেশটি। ইংল্যান্ড, পোল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করে মরক্কো। শেষ খেলায় পর্তুগালকে ৩-২ গোলে হারিয়ে জায়গা করে নেয় বিশ্বকাপের শেষ ষোলতে। বিশ্বকাপে এটিই তাদের সর্বোচ্চ অর্জন। পরের বার জার্মানি বিশ্বকাপে জায়গা না পেলেও ১৯৯৪ বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে নেদারল্যান্ডকে ২-১ গোলে পরাজিত করে আবারো চমক দেখায় অ্যাটলাসের সিংহরা। ৯৮-এর ফ্রান্স বিশ্বকাপেও সুযোগ পায় দলটি। সে বছর গ্রুপ পর্বে তিন ম্যাচে ১ জয় ১ হার আর ১ ড্র নিয়ে গ্রুপ পর্বেই বিদায় নেয় তারা। দুই দশক পরে আবারো বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেল করল মরক্কো। এবারের বিশ্বকাপে ‘বি’ গ্রুপ পর্বে স্পেন, পর্তুগাল ও ইরানের মুখোমুখি হবে দলটি। দেখা যাক তারা কতটা কী করতে পারে!

 

নাইজেরিয়া

ডাকনাম : সুপার ঈগল
হেডকোচ : গেরনট রোর (জার্মানি)
অধিনায়ক : জন ওবি মিকেল
ফিফা র‍্যাংকিং : ৪৭
বিশ্বকাপে মোট অংশগ্রহণ : ৫
বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ সাফল্য : দ্বিতীয় রাউন্ড

আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে নাইজেরিয়াকে বলা যায় বিশ্বকাপে সবচেয়ে ধারাবাহিক। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে প্রথমবার নাম লেখানোর পর থেকে এ পর্যন্ত সাত বিশ্বকাপের ছয়টিতেই সুযোগ পায় তারা। একমাত্র আফ্রিকান দেশ হিসেবে ২০১০, ২০১৪ এবং ২০১৮ তিন বিশ্বকাপের টিকিটই আসে আফ্রিকান ঈগলদের হাতে। ৯৪ এর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়ে গ্রুপ পর্বেই সবাইকে চমকে দেয় দেশটি। তিন ম্যাচে দুই জয়ে পয়েন্ট টেবিলের প্রথম আসন দখল করে দ্বিতীয় রাউন্ডে যায় নাইজেরিয়া। সে বছর নকআউটে অতিরিক্ত সময়ে গড়ায় ইতালি ও নাইজেরিয়ার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই; তবে শেষ পর্যন্ত ২-১ ব্যবধানে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় নাইজেরিয়া। এরপর ৯৮’র ফ্রান্স বিশ্বকাপেও দুর্দান্ত নাইজেরিয়াকে দেখে বিশ্ব। প্রথম ম্যাচেই দুর্দান্ত স্পেনকে মাটিতে নামায় ৩-২ গোলে হারিয়ে। দ্বিতীয় ম্যাচে বুলগেরিয়াকেও হারিয়ে দেয় তারা। শেষ ম্যাচে প্যারাগুয়ের সঙ্গে আর পেরে না উঠলেও নিশ্চিত করে নকআউট পর্ব। কিন্ত ডেনমার্কের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ে তারা। এরপরে ২০০২ ও ২০১০ বিশ্বকাপে সুযোগ হলেও কোন খেলা জিততে পারেনি নাইজেরিয়া। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে বেশ কষ্ট করেই গ্রুপ পর্ব পার করে নাইজেরিয়া, কিন্ত নকআউট পর্বে ফ্রান্সের সাথে হেরে বিদায় নেয় দেশটি। ২০১৮ বিশ্বকাপেও ভালো করার ইচ্ছা নাইজেরিয়ানদের। ইতোমধ্যে বাছাইপর্বে দারুণ খেলা দেখিয়েছে আফ্রিকান দেশটি। জাম্বিয়ার বিপক্ষে ১-০ গোলের জয়ে এবারের বিশ্বকাপে প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেব এবং সব মিলিয়ে ষষ্ঠবারের মতো বিশ্বকাপের টিকিট হাতে পায় তারা। সুপার ঈগলদের দলে বেশকিছু তারকা ফুটবলার রয়েছে। গোলকিপার ভিনসেন্ট এনিয়েমা জাতীয় দল ছাপিয়ে পরিচিত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও। এছাড়া সাবেক চেলসি তারকা জন ওবি মিকেল, জোয়েল ওবি, কেলেচি ও এনদিদি, ভিক্টর মোজেস, আইওবিদের মত তরুণদের নিয়ে গড়া নাইজেরিয়া দল ‘ডি’ গ্রুপে থাকা তিন প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনা, ক্রোয়েশিয়া ও আইসল্যান্ড এর জন্য হুমকি হয়েই দাঁড়াতে পারে।

তিউনিসিয়া

ডাকনাম : কার্থেজের ঈগল
হেডকোচ : নাবিল মালুল (তিউনিসিয়া)
অধিনায়ক : আয়মান মাথলুতি
ফিফা র‍্যাংকিং : ১৪
বিশ্বকাপে মোট মোট অংশগ্রহণ : ৪
বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ সাফল্য : গ্রুপ পর্ব

১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করা তিউনিসিয়া এবার এসেছে বাছাই পর্বে নিজ অঞ্চলে ‘এ’ গ্রুপের সেরা দল হয়ে। ‘৭৮ সালে বিশ্বকাপের প্রথম খেলায়ই তারা মেক্সিকোকে ৩-১ ব্যবধানে পরাস্ত করে নজরে পড়ে। কিন্ত এরপর গ্রুপ পর্বে আর কোন খেলা জিততে না পেরে বিদায় নেয় বিশ্বকাপ থেকে। দীর্ঘ বিরতির পর বিশ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স বিশ্বকাপে সুযোগ মেলে তিউনিসিয়ার। এরপর ২০০২ এবং সর্বশেষ ২০০৬ সালের জার্মানি বিশ্বকাপে খেলার পর ফের ছিটকে যায় ফুটবলের মহা আসর থেকে। তারা কখনোই গ্রুপ পর্ব পার হতে পারেনি। ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে মেক্সিকোকে ৩-১ ব্যবধানে পরাজিত করাই বিশ্বকাপে তাদের সর্বোচ্চ অর্জন। যদিও এবার ভালোকিছু করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ লেইস কার্থেজের ঈগলরা। আইমেন আব্দেননুর, আহমেদ আকাইসি, আয়মান মাথুলতির মত খেলোয়াড়দের নিয়ে বিশ্বমঞ্চে নিজেদের ঢেলে দিতে প্রস্তুত কোচ নাবিল মালুল। আফ্রিকান দেশটির মূল ভরসার জায়গা তাদের কোচই। দেশের জার্সিতে ৭৪টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা সাবেক এই তিউনিসীয় মিডফিল্ডার তার দল নিয়ে ‘জি’ গ্রপে বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড ও পানামার বিরুদ্ধে টেক্কা দিতে পারে কি না তা সময়ই বলে দিবে।

সেনেগাল

ডাকনাম : লায়ন্স অব তেরঙ্গা
হেডকোচ : আলিও সিসে (সেনেগাল)
অধিনায়ক : চেইকুউ কুয়াতে
ফিফা র‍্যাংকিং : ২৮
বিশ্বকাপে মোট অংশগ্রহণ : ১
বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ সাফল্য : কোয়ার্টার ফাইনাল

বাছাই পর্বে ‘ডি’ গ্রুপে সেরা হয়ে রাশিয়ার বিমানে উঠে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সেনেগাল। বিশ্বকাপে এটি তাদের দ্বিতীয় অংশগ্রহণ। ২০০২ সালে এশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে বিশ্ব প্রথমবার দেখে এক নবাগতের ঝলক! সে আসরের গ্রুপ পর্বে ফ্রান্সকে হারিয়ে তাক লাগিয়ে দেয় দেশটি। পরের দুই ম্যাচে ডেনমার্ক, উরুগুয়ের সঙ্গে ড্র করে চলে যায় নকআউট পর্বে। নক আউটে সুইডেনকে ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে প্রথম সুযোগেই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যায় সেনেগাল। তুরষ্কের সাথে অতিরিক্ত সময়ের খেলায় হেরে স্বপ্নিল যাত্রা থামে ‘লায়ন্স অফ তেরাঙ্গা’র। এরপর দীর্ঘদিন বিশ্বকাপে দেখা যায়নি সেনেগালকে। অবশেষে ফিরলো ১৬ বছর পর। দপ করে জ্বলে দপ করেই যেন নিভে যায় সেনেগাল। ২০০২ সালের পর ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে জায়গা হলো সেনেগালের। বর্তমান দলে বেশ কয়েকজন তারকা ফুটবলার আছেন যারা রাশিয়ায় ঝলক দেখাতে পারেন। মৌসা সো, ডিউফ, সাদিও মানের মতো তারকারা প্রতিপক্ষের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তিউনিসিয়ার মতো তাদেরও শক্তির জায়গা ডাগআউটে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি। কোচ আলিও সিসে ২০০২ বিশ্বকাপে দলের অধিনায়ক ছিলেন। এবার ভিন্ন রূপে অভিন্ন মঞ্চে! ২০১৫ সাল থেকে দলের দায়িত্বে থাকা সিসে ভালো করেই জানেন তার করণীয়। এখন দেখার পালা গ্রুপ ‘এইচ’ হতে জাপান, কলম্বিয়া ও পোল্যান্ডের সাথে কতটুক পেরে উঠতে পারে তারা। নাকি কোরিয়া-জাপান আসরের সুখস্মৃতি নিয়েই কাটানো লাগে অন্তত আরো চারবছর!