১৬ই জুলাই ১৯৫০। বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি ব্রাজিল-উরুগুয়ে দুই প্রতিবেশী। রাউন্ড রবিন পদ্ধতির সেই টুর্নামেন্টের শেষম্যাচে ড্র হলেই রচিত হত ব্রাজিলময় নতুন ইতিহাস। কানায় কানায় পূর্ণ ব্রাজিলের লক্ষাধিক দর্শক ধারনক্ষমতার মারাকানা স্টেডিয়াম। পূর্ণ ব্রাজিলের অলিগলি, ঘরদোর, দোকানপাট। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব! অনন্য এক শিহরণে শিহরিত গোটা দেশ। ইতিহাস রচিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু তাতে ছিল ব্রাজিলিয়ানদের কান্না, হাহাকার, লাশের গন্ধ! অ্যালসেডিস ঘিঘিয়াওয়ের গোলে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় নীল আকাশ বাতাস চারিদিক। মারাকানার মাঠে ওই কান্নার মিছিলে ছিলেন জোয়াও রামোস দোনদিনহো, ছিল বছর নয়ের ছোট্ট এডসন ডিকো। সেদিন অবুঝ ডিকো মুছে দিয়েছিল স্নেহময় পিতার বেদনাতুর অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া। বলেছিল, ‘তোমার এই হাহাকার একদিন আমি ঘোচাবো’।
শিশুটি বাবাকে দিয়েছিল নেহায়েৎ সান্তনা, তবে ফুটবলার বাবা বুঝে গেছিলেন তার দুঃখ যদি কেউ মুছতে পারে সে তার ছেলেই। সহধর্মিণী যেখানে ফুটবল দিত না পুত্রকে সেখানে তিনি নিজেই শেখাতেন অমর কৌশলাবলী। যার মধুময় সুধা তৃপ্ত করেছে বিশ্বকে। এক ‘পেলে’তেই মাতোয়ারা ফুটবল।
কিন্তু কেন?
মহারাজা, ম্যাজিক্যাল, স্বপ্নদ্রষ্টা, কিংবদন্তি, সৃষ্টিশীল; শব্দসমগ্রের সংজ্ঞা চান? সংজ্ঞার প্রয়োজন নেই। বরং দুটো বর্ণের মিশেলে যখন বলবেন ‘পেলে’ কিংবা আরেকটু পরিধি বাড়িয়ে ‘এডসন অরান্তেস দোঁ নাসিমন্ত পেলে’; তখন আস্থা রাখুন ফুটবল যিনি বোঝেন একটু আধটু তিনি দ্বিমত করবে না আপনার সাথে। পেলে, কালোমানিক। যিনি মাত্র একুশ বছর বয়সে পরিণত হন নিজ দেশের জাতীয় সম্পদে। বয়স ঊনত্রিশের কোঠা পেরোবার আগে নামের পাশে একসহস্র গোল যা ভাঙ্গতে পারেনি আজো কেউ। গতি, ছন্দ, মায়া সবই ছিল তার খেলায়। তিনি এমন একজন যার খেলা দেখতে যুদ্ধ বিরতি দেয় ইসরায়েল। যার সম্মানে একটি ক্লাব আজীবনের জন্য তুলে রাখে জার্সি নাম্বার দশ। ফুটবলে দশের মাহাত্ম্য কতটুকু জানেন নিশ্চয়ই?
বাবা-মা নাম রেখেছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের সঙ্গে মিলিয়ে। চেয়েছিলেন এডিসনের মতোই যাতে বিখ্যাত হয় ছেলেটা। তা হয়েছেও বটে। এডিসনের মতো রাসায়নিক সামগ্রী হাতে নয়, ফুটবল নামক চর্মগোলক পায়ে। এডিসন থেকে এডসন হয়েছেন স্কুল সার্টিফিকেটে একটি ‘আইয়ের'(র) গড়মিলে। আর পেলে হলেন কিভাবে? শিশু এডসনের প্রিয় ফুটবলার ছিলেন নামডাকওয়ালা ক্লাব ভাস্কো ডা গামার গোলরক্ষক বিলে [Bile]। সেখান থেকেই এডসন অরান্তেস হয়ে যান পেলে, এক ট্রেডমার্ক। সেই থেকে পরিবারপ্রদত্ত ডাকনাম ‘ডিকো’ বিলীন হয়ে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন পেলে। চোখের মণি, সবার প্রিয়।
এডসন অরান্তেস দোঁ নাসিমন্ত পেলে। ব্রাজিলের ত্রেস কোরাকোয়েস রাজ্যে জোয়াও রামোস দোনদিনহো আর সেলেস্তে অরান্তেসের ঘরে ১৯৪০ সালে ২৩ অক্টোবর জন্ম কুচকুচে কালো এক নবজাতকের। ৫ ফুট ৮ ইঞ্চির পেলের ফুটবলে প্রথম লাথি মারা বাবার ক্লাব বাউরুতে। বয়স তখন মাত্র ১৩। পাড়ার গলি থেকে উঠে আসার গল্পটা তার আর দশজনের মতোই। ভিন্নতা শুধু অনত্র। যাদের সাথে খেলতেন পাড়ার মাঠে সেই তারা বিশের কোঠায়ও পড়ে ছিল সেখানে, যেখানে ১৮ তে বাবার কান্না মুছে দিয়ে বিশ্বকাপে চুমু খাওয়া পেলে বিশে হয়ে যান স্বনামধন্য। কোঁকড়া চুলের কালো এক কিশোরের পায়ে পদদলিত ফুটবলের মহাযজ্ঞে আসা মহাতিথিরা, ইউরোপের দেশ সুইডেন থেকে শ্রেষ্ঠত্ব ছিনিয়ে আনা লাতিনে। ৫৮’ র পর ৬০ বছর চলে গেলেও যে দুঃসাহস দেখাতে পারেনি অন্য কেউ। তাকে নিয়ে রীতিমতো হৈচৈ। স্বদেশি ক্লাব সান্তোস নিজ দলে ভেড়ায় পেলেকে বিশ্বকাপের আগেই, নয়তো তাদের অভিধানে যোগ হতো আফসোস। ১২৮৩ গোল, তিনটে বিশ্বকাপ, ক্লাব-জাতীয় দল মিলিয়ে ভুরি ভুরি সাফল্যগাঁথা রচনা করেছেন সবুজ ঘাসে। এখন লোকে বলবে তার সময়ে অফসাইড ছিল না। তার সময়ে ডিফেন্ডাররা ছিল আরো সৃজনী, দক্ষ। অফসাইড ছিল না। তাহলে কি স্টেফানো, পুসকাস, তেলমো জারা এরাও ভালো ছিল না? উত্তরটা একবাক্যে ‘না’। তাদের দক্ষতায় আঙ্গুল তোলার দুঃসাহস কারো নেই। এতকিছুর পরও পেলে ব্যালন ডি’অর জিতল না। কারণ পেলের সময়ে ইউরোপের বাইরে কাউকে দেওয়া হতো না ফ্রান্স ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের স্মারকটি। ব্যালন ডি’অর কর্তৃপক্ষ তাকে বিশেষ ব্যালন ডি’অর দিয়ে পুরস্কারটার কষ্টলাঘব করেছে। পেলের হাতে না উঠলে সার্থকতা পেত না সোনায় প্রলেপিত রূপালি গোলকটিও।
শেষবেলায় আমেরিকার কসমস ক্লাব ছাড়া খেলেননি কোথাও। পেলের যখন একুশ বছর তখন তাকে নিজ দেশ ব্রাজিলের জাতীয় সম্পদ ঘোষণা দেওয়া হয় যাতে দেশরত্নকে কেউ ছিনিয়ে নিতে না পারে। সবার ভালোবাসায় সিক্ত পেলের গোধূলিলগ্নেও তাকে পেতে মরিয়া ছিল ইউরোপ। ইতালিতে যেতে চাওয়া পেলেকে আমেরিকান লীগ সকারের প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন- “ইতালিতে গেলে তুমি শিরোপার চেয়ে বেশি কিছু জিততে পারবে না কিন্তু এখানে জিতবে হৃদয়”। পেলে জিতেছেন। হৃদয় জিতেছেন। ইএসএ লীগে যেখানে ম্যাচপ্রতি দর্শক হতো সাত-সাড়ে সাত হাজার সেখানে বুড়ো পেলের আগমনে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় তের হাজারে। উষ্ণ ভালোবাসার সাথে জিতেছেন ঘরোয়া লীগ। কসমস থেকেই ফুটবলকে বিদায় পেলের, তার সঙ্গে ক্লাবটির জার্সি নাম্বার টেনও।
ফুটবলের মহারাজ পেলের সময়ে খেলেছেন পুসকাস, ইউসেবিও, ক্রুইফ, প্লাতিনিরা। পেলে না থাকলে হয়ত তাদের নিয়ে হত শ্রেষ্ঠত্বের তর্ক। পেলে আছে তবুও হত যদি না এসব বিখ্যাতরা নিজেরাই স্বীকার না করতেন পেলের শ্রেষ্ঠত্ব। পেলে- মারাদোনার অমিমাংসিত এক কথার লড়াই চলছে, চলবে অবিরত। সে পথ আপাতত না মাড়ানোই ভাল। বরং আবার ডুব দেই পেলের রাজসিক রাজ্যে যেথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সাফল্যের মুক্তো, গোলের মালা, ভালবাসার নিদর্শন। যে রাজ্যের দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো কিং পেলের জাদুকরী সবমূহুর্তের প্রতিচ্ছবি। চোখ ঘুরোলেই প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে তার দুর্বার গতি, ফিনিশিং, দুর্ধর্ষ স্কিল। ফুটবল মাঠে তারচেয়ে সাবলীল স্বচ্ছন্দ্য বোধকরি কেউ ছিলেন না। মেসি-রোনালদোর তর্কে এখন গরম চায়ের কাপ, একসময় ছিল জিদান-বেকহামদের নিয়েও। কিংবা পজিশনভিত্তিক সেরার লড়াইটাও জমজমাট। তবে সেসব কেবলি যুগ-যুগান্তের সেরার মীমাংসা। কেননা সর্বকালের সেরার আসনে পেলে বসে আছেন কবে থেকেই।
পেলেকে নিয়ে করা কয়েকজন মহাতারকার উক্তিসমগ্র দিয়ে লেখার উপসংহার টানা যাক-
“ফুটবল ইতিহাসে ডি স্টেফানো সেরাদের সেরা। তবে আমি পেলেকে ফুটবলার হিসেবে গণ্য করিনা। কারণ সে ফুটবলের ঊর্ধ্বে!” – ফেরেঙ্ক পুসকাস
“তোমায় যদি প্রশ্ন করা হয় তোমার দেখা সেরা ফুটবলার কে? তুমি হয়ত মারাদোনা, ক্রুইফ, স্টেফানোর সাথে পেলের নাম বলবে। আর আমি বলবো অবশ্যই পেলে!” -স্যার ফার্গি
“পেলে প্রথমে ছিলো মানুষ, এরপর ফুটবলার। এবং আগে সে সাধারণের মতো খেলত তারপর খেলত ঈশ্বরের মত!” -মিশেল প্লাতিনি
“পেলেই একমাত্র ফুটবলার যে কিনা সকল যুক্তিকে সীমানার ওপারে ছুঁড়ে ফেলেছে!” -ইয়োহান ক্রুইফ
“পেলে সর্বকালের সেরা!” -ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার