অনেকের ধারণা ট্রাম্পের আমেরিকায় মুসলমানরা দুর্দিন পার করছে, তাদের ফ্রান্সের মুসলমানদের দিকে একটু নজর দিতে বলব।
গত কয়েক বছর যাবৎ, তথাকথিত জিহাদীদের হামলা চালানোর দায় সব মুসলমানের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে, ফ্রান্সের সব মুসলমানকেই এসবের জন্য ঢালাওভাবে দায়ী করা হচ্ছে। সর্বশেষ গত রোববারের এক ঘটনায় দেখা যায়, ‘আল্লাহু আকবার’ বলে চিৎকার দিয়ে একজন ছুরিকাঘাতের মাধ্যমে একব্যক্তিকে হত্যা করেছে এবং চারজনকে আহত করেছে।
আমেরিকান রিপাবলিকানদের কাছে মুসলিম-বিদ্বেষ এখন ডালভাতে পরিণত হলেও ফ্রান্সে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদল উভয়ই মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। বামপন্থি, ডানপন্থি, সমাজতন্ত্রী কিংবা কট্টরপন্থি সবাই
ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে সেখানকার মুলমানদের কোণঠাসা করে দিয়ে ফরাসি সেক্যুলাজিম রক্ষায় ব্যস্ত।
সরকারে যারাই এসেছে মুসলিম নারীদের পর্দা প্রথাকে অপরাধ হিসেবে দেখেছে, শেষমেষ স্কুলে হিজাব বা ওড়না ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। শহরে শহরে মেয়ররা মুসলিম নারীদের টার্গেট করেছে, যারা সমুদ্র সৈকতে শালীনতা বজায় রাখতে চেয়েছিল। যেসব বাচ্চারা তাদের স্কুলে শূকর-মাংসবিহীন লাঞ্চ খেতে চেয়েছিল তাদেরও কর্তৃপক্ষের রোষাণলে পড়তে হয়েছে। নিও লিবারেল হার্টথ্রব প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখো এমন সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইন উপহার দিয়েছেন যাকে খোদ জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা মুসলমানদের ওপর বৈষম্য চাপাতে ব্যবহার করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন।
এবং সর্বশেষ চমক হচ্ছে, কোরআনের আয়াত অবলোপনের দাবি। গত ২১শে এপ্রিল সংবাদপত্র লাঁ প্যারিসিয়ায় ৩০০ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির স্বাক্ষরসহ ‘নয়া এন্টি-সেমিটিজমের বিরুদ্ধে’ শিরোনামে একটি ইশতেহার প্রকাশিত হয়। সেখানে স্বাক্ষরকারীদের মাঝে রয়েছেন সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভালস, অভিনেতা জিরার্ড ডিপার্ডিও, সংগীতশিল্পী চার্লস আজনভ্যুরের মতো ব্যক্তিবর্গ। ‘দি আটলান্টিক’ -এর দাবি মতে, ওই ইশতেহারে বলা হয়েছে– ফ্রান্সে কট্টর ইসলামপন্থিরা ১১ জন ইহুদীকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকজনকে নির্যাতন করেছে। কোরআনে ইহুদী, খ্রিস্টান ও অবিশ্বাসীদের হত্যার কথা বলা হয়েছে এমন একটি আয়াতের দোহাই দিয়ে হত্যাকারীরা হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে বলে উল্লেখ করে ইশতেহারে বলা হয়, ‘ওই আয়াত এমন আরো অপরাধকাণ্ডের প্রেরণা-দলিল হিসেবে কাজ করছে’।
এগুলো আসলে ফরাসিদের ভণ্ডামি, অজ্ঞতা, সুবিদাবাদিতা ও মূর্খতার বিষাক্ত সংমিশ্রণ।
প্রথমত, এহেন কাজের জন্য মুসলিমদের ধর্মীয় মুরুব্বিকূলের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না বাইবেলের ক্ষেত্রে থমাস জেফারসন যে কাজটি করেছিলেন। প্যারিস গ্র্যান্ড মসজিদের ইমাম দলিল বুবাকের ও বোরডেক্স গ্র্যান্ড মসজিদের ইমাম তারেক ওবরো ইতোমধ্যে এই দাবিকে ধর্মদ্রোহিতার শামিল এবং ‘অগ্রহণযোগ্য ও অবিশ্বাস্য’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। যে কোরআনের আয়াতকে মুসলমানরা ‘স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার নিজের কথা’ বলে মানে সেটাকে মূলধারার কেউ যদি সংশোধন করতে রাজিও হয়, ধর্মান্ধ ইসলামিক স্টেইট বা আলকায়েদা তাকে ছেড়ে দেবে বলে কেউ বিশ্বাস করে না।
দ্বিতীয়ত, সহিংস চরমপন্থা আসলে ধর্মগ্রন্থ স্বীকৃত কোন বিষয় নয়। আমি এর আগেও বহুবার আমার লেখায় বিশেষজ্ঞের বক্তব্যসহ দেখিয়েছি, সন্ত্রাসী হামলাগুলোর ক্ষেত্রে র্যাডিক্যালাইজেশনের প্রক্রিয়ায় ধর্মীয় বিশ্বাস কখনোই একতরফাভাবে দায়ী থাকে না। তাহলে কোরআনের আয়াতের ওপর এই আক্রোশের কারণ কী? সিরিয়ায় আইএসের হাতে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়া ফরাসি সাংবাদিক দিদিয়ের ফ্রাঙ্কোয়েস ২০১৫ সালে সিএনএনকে বলেন, ‘সেখানে ঐশিবাণী বা ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে কোন আলাপ নেই, পুরো বিষয়টা আসলে রাজনৈতিক। কোরআন নিয়ে কোন কথাই হয়নি’। ফ্রাঙ্কোয়েসের আগে বন্দি থাকা নিকোলাস হেনিন বলেন, ‘এই জিহাদিরা আরব অথবা মুসলিম সংস্কৃতির খুব কমই চর্চা করে, এরা আমাদের সমাজেরই লোক, আমাদের সংস্কৃতি ও জীবনধারার মানুষ’।
কার কথার দাম বেশি? আইসিস এর হাতে বন্দিদশায় থাকার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দু’ জন, নাকি গ্রিন কার্ড ধারী কোন আমেরিকানের?
তৃতীয়ত, ওই ইশতেহারে স্বাক্ষরকারীরা কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে ফ্রান্সের মুসলমানরা ‘নয়া এন্টি-সেমিটিজম’ এর পেছনে দায়ী? ফ্রান্সে এন্টি-সেমিটিক ঘৃণা ছড়ানোর পেছনের কারণ জানতে ‘হিউম্যান রাইটস ফার্স্ট’ এর উদ্যোগে পরিচালিত ২০১৬ সালের এক জরিপের ফলাফলে বলা হয়, এন্টি-সেমিটিক ঘৃণা ছড়ানোর নেপথ্যে মুসলমানদেরকে জড়িয়ে যে সিদ্ধান্তমূলক কথা বলা হয়ে থাকে, তা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কারণ, ফ্রান্সে জাতি-ধর্ম ভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করা অবৈধ’। নিকটবর্তী দেশ জার্মানীতে– পুলিশের সংগ্রহ করা তথ্যে জানা যায়, এন্টি-সেমিটিক ঘৃণা ছড়ানো দশ জনের নয় জনই কট্টর জাতীয়তাবাদী বা নিও-নাৎসি গ্রুপগুলোর সদস্য, এদের কেউই কট্টরপন্থি মুসলমান নয়।
চতুর্থত, ‘কোরআন নিজেই এন্টি-সেমিটিক’ এর পক্ষে কোন প্রমাণ আছে কি? বা ইহুদীদের সাথে ইসলামের সমস্যা কোথায়? তবে যে আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করে সব সময় বলা হয় ইহুদীদের বিরুদ্ধে ইসলামের শত্রুতার কথা, ওই আয়াতটি আসলে আলাদা ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতিতে বর্নিত হয়েছে। শুধু এই আয়াত নিয়েই আলোচনা হতে দেখা যায়। অন্য অনেক আয়াতে ইহুদীদের প্রসংশাও রয়েছে, সেসব আয়াত নিয়ে কোন কথা বলা হচ্ছে না।
ইহুদি-মুসলিম সম্পর্ক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ মার্ক কোহেনের মতে, “ইসলামের রয়েছে মহামূল্যবান বহুত্ববাদী সংস্কৃতি। যে কারণে খ্রিস্টান ইউরোপের চাইতেও ইহুদীরা মুসলিমদের ভূমিতে বেশি নিরাপত্তা ভোগ করে এবং ইউরোপের ইহুদিরা যে অপর বা আলাদা হিসেবে বঞ্চনার শিকার হয়েছিল তা ইসলামি পরিমণ্ডলে এসে বরং ভুলতে বসেছে।” কোহেনের মতে, এখনকার আধুনিক দিনের মুসলমান ও আরবদের মধ্যে যে এন্টি-সেমিটিজম দেখা দিয়েছে তা আসলে উপনিবেশবাদ, দ্বন্দ্বপূর্ণ জাতীয়তাবাদ ও জায়নবাদের সাথে দ্বন্দ্বের ফসল। এটা মধ্যপ্রাচ্যের নিজস্ব কোন ঐতিহ্যও নয় কিংবা ইসলামের সাথেও এর কোন আঁটঘাট নাই।
পঞ্চমত, শুধুমাত্র ইসলামের ঐশিবাণীকে কেন এভাবে টার্গেট করা হচ্ছে? কেন ইহুদীদের বা খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থের ব্যাপারে তারা বলছে না? তারা কি বলতে পারবে, বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে অবিশ্বাসীদের সাথে ঘৃণা ও সহিংসতামূলক আচরণের পক্ষে কোন কথাবার্তা নাই? এটাও কি তারা নিশ্চিত করতে পারবে? সম্প্রতি ফিলিস্তিনি, ইরাকি, উগান্ডান এবং নরওয়েজিয়ান শিশুদের বিরুদ্ধে এবং মার্কিন গর্ভপাত ক্লিনিকগুলোতে অপরাধকাণ্ডের বৈধতা দিতে ওল্ড টেস্টামেন্টের সেসব কথাকে ব্যবহার করা হয় নাই?
ভণ্ডামির অভিযোগ থেকে বাঁচতে ফ্রান্সের প্রধান রাব্বি হাইম কোরশিয়াসহ যে তিনশো জন ওই ইশতেহারে স্বাক্ষর করেছেন তারা বাইবেলের ওইসব কথাগুলোও মুছে ফেলার আহ্বান জানাবে কি?
ষষ্ঠত, ফরাসি দেশের সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতার যে মূলনীতি তার মধ্যে স্বাধীনতার কি এমন হল? ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বিবেচনায় না নিয়ে কোরআনের আয়াত অবলোপনের দাবি তোলা হচ্ছে, ফরাসি সেক্যুলার ঐতিহ্যের সাথে, বাক স্বাধীনতা ও মুক্তমতের সাথে এটা যায় কি করে? জে স্যু শার্লির ভূমিতে এসব কী দেখা যাচ্ছে? আচ্ছা, মনে হতে পারে শার্লি অ্যাব্দোর কথা আসছে কেন? কারণ খুবই স্পষ্ট, পত্রিকাটির সাবেক ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ফিলিপ ভাল্ কোরআনের আয়াত অবলোপনের দাবি সংবলিত ইশতেহারটির লেখক। এসব দেখে মনে হতে ফরাসি দেশের মৃত্যু ঘটেছে।
ইশতেহারটি আসলেই এদের লেখা কি না, এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ফরাসি নাগরিক অধিকার সংগঠক ইয়াসের লুতি। তিনি আমাকে বলছিলেন, ইহুদিবিরোধীতা নিয়ে যদি সত্যিই তারা কথা বলতে চাইতেন তবে তারা ফ্রান্সের বহু পুরনো এন্টি-সেমিটিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে কথা বলতেন।
তার কথায় যুক্তি আছে, ফ্রান্সের ইতিহাসে এন্টি-সেমিটিজমের দীর্ঘ এবং লজ্জাজনক অধ্যায় রয়েছে, ১৯ শতকের শেষ ভাগের ড্রেইফাস অ্যাফেয়ার থেকে শুরু করে হলোকাস্টে সহায়তা প্রদানকারী ভিকি সরকারের কর্মকাণ্ড। ‘দি আটলান্টিক’ পত্রিকায় এক লেখায় কারিনা পিজার সাম্প্রতিক এক জরিপের তথ্যের বরাতে জানিয়েছেন, ৩৫ শতাংশ ফরাসি মনে করে যে ইহুদিরা বিশেষভাবে অর্থবিত্তের মালিক; ৪০ শতাংশের মতে, ফরাসি ইহুদিদের বিষয়ে ইসরায়েল ফ্রান্সের চাইতেও বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আর ২২ শতাংশ ফরাসির ধারণা, ইহুদিরা অতি মাত্রায় ক্ষমতাধর।
বহুল পরিচিত এই তিনশো ফরাসি ব্যক্তি আসলে শুধুমাত্র মুসলিম ‘এন্টি-সেমিটিজম’ নিয়ে সরব হয়ে শুধুমাত্র কোরআনের আয়াত নিয়ে কথা বলার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে তারা আসলে উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপাতে চাইছেন।
সাংবাদিক মেহদি হাসানের এই লেখাটি বিশেষায়িত অনলাইন সংবাদ প্রতিষ্ঠান ‘দি ইন্টারসেপ্ট’ -এ গত বুধবার ১৬ মে প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেছেন ইয়াসির আরাফাত।