মূলত বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ফিলিস্তিনে যে ইহুদিরা বসতি গড়েছিলেন, তারাই ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাদের বেশিরভাগ পূর্ব ইউরোপে বাস করতেন, যারা নানা ব্যর্থ রোমান্টিক আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হতেন এবং সেসময়কার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে নিজেদের যুক্ত না হতে পারার হতাশা তাদের মধ্যে কাজ করত। এছাড়া তারা আধুনিক উপনিবেশবাদ বিষয়েও বেশ আগ্রহী ছিলেন।
তাদের কিছু সোশালিস্ট আন্দোলনের মুরুব্বিরা এর সাথে রোমান্টিক জাতীয়তাবাদ মিশিয়ে নতুন ধরনের উপনিবেশ গড়ার চিন্তা করতেন। এক্ষেত্রে ফিলিস্তিন তাদের একমাত্র উপায় ছিল না, কিন্তু এর সাথে যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের কৌশল এবং শক্তিশালী খ্রিষ্ট্রীয় যায়নবাদীরা যুক্ত হলেন, তখন এই ফিলিস্তিনই তাদের চিন্তার কেন্দ্রে চলে আসলো।
১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণা এবং ১৯১৮-৪৮ সালের লম্বা সময় পর্যন্ত ইউরোপীয় যায়নবাদীরা এই ব্রিটিশদের সহায়তায় তাদের ভবিষ্যত রাষ্ট্র তৈরির সকল ব্যবস্থা করে ফেলেছে। আমরা জানি, এই আধুনিক ইহুদিবাদীরা এও জানত যে, সেখানে স্থানীয় অধিবাসীরা আছে, যারা তাদের দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখে, চিন্তা করে।
ফলে তাদের এই ‘সমস্যা’ এর সমাধান খুঁজতে গিয়ে তাদের মুরুব্বিরা দেখল, ফিলিস্তিনকে সবার আগে আরব-মুক্ত করতে হবে। হোক সে সমাজতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী, ধর্মপ্রাণ বা সেক্যুলার; ১৯৩০ সাল থেকে সবাই ফিলস্তিনকে জনবসতিহীন করার ভাবনাটাই ভেবেছে।
ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের শেষ সময়ে, যায়নবাদী নেতাদের কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল যে, কেবল ইহুদিরা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করতে পারলেই কেবল তাদের কাঙ্খিত দেশ আদায় করতে পারবে
যখন ১৯৪৭ সালের ২৯শে নভেম্বর জাতিসংঘের সীমান্ত-ভাগের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার সময়, যায়নবাদীরা সেই প্রস্তাবকে মেনে নেয়নি। এবং ফিলিস্তিনিদের মাত্র ৫৪ শতাংশ সে প্রস্তাব মানলেও সেটি পরে আর বাস্তবায়িত হয়নি।
ফলে এসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে গিয়ে তারা জাতিগত নিধন চালিয়ে অর্ধেকের বেশি ফিলিস্তিনিদের ঘরছাড়া করেছে, অর্ধেকের বেশি গ্রাম ধ্বংস করেছে, রক্ষা পায়নি শহরও। তার প্রেক্ষিতে আরবদের যথাযথ প্রতিবাদের অভাবে তারা একসময়ে সেখানের ৭৮ শতাংশ জায়গা দখল করে নিল।
যাই হোক, এসবের পরেও সমস্যার কোন সমাধান হয়নি। মনে হচ্ছিল, পার পাওয়া যাবে, কিন্তু ইসরায়েলের অধীন ফিলিস্তিনে যে সংখ্যালঘু ফিলিস্তিনি আছে, যা আবার মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ ইসরায়েলের অধীনে। তার উপর, পিএলও প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৬৪ সালে, তবে তারা কাজের ক্ষেত্রে ধীরগতিই বেছে নেয়।
পরবর্তীতে মনে হয়েছিল জামাল আব্দুল নাসের ফিলিস্তিনিদের ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হবেন। তবে আশার সেই সময়টা খুব ছোট ছিল। কিন্তু ১৯৬৭ সালের জুনে মিশরীয় সেনাবাহিনীর পরাজয় এবং আবার সেই ১৯৭৩ সালে আংশিক জয়ের উত্থান-পতনে সেই সাহায্যের কথা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত, কোন আরব দেশ নিজেদের লাভ ছাড়া ফিলস্তিনিদের পক্ষে দাড়ায়নি।
সেই ৬৭ সালের জুনেই ইসরায়েল পুরো ফিলিস্তিন দখলে নিয়ে নেয়। এতে তারা আবার নতুন গোলকধাঁধায় পড়ল, এতে সমস্যাকারে নতুন অনেক ফিলসস্তিনি তাদের অধীনে চলে এলো।
এই যুদ্ধে ইহুদি রাষ্ট্রটির নেতৃত্বেও বদল এলো। বাস্তববাদী লেবার পার্টির বদলে এলো ডানপন্থি জাতীয়তাবাদী; যারা ইসরায়েলের দুনিয়াব্যাপি ইমেজ নিয়ে কম ভাবে। এমনকি তারা দখলকৃত অঞ্চলকে নিজেদের আওতায় রাখতেই তৎপর থাকল। তারা ৪৮ সালের নিধনকে চালু রেখে স্থানীয়দের ছিটমহলের অধীনে এনে তাদের সেখানকার দ্বিতীয় সারির নাগরিকে পরিণত করল।
ফিলিস্তিনিরা সে প্রেক্ষিতে দুইবার ইন্তিফাদার ঘোষণা এবং নাগরিক প্রতিবাদ ইসরায়েলের আগ্রাসী মনোভাবকে রুখতে পারেনি। উল্টো এসব আন্দোলনকে বর্বর উপায়ে দমন করে ইসরায়েল তার নৈতিক চরিত্র হারিয়েছে।
যাই হোক, ‘ওয়ার অন টেরর’ এর বাড়তি সুবিধা ইসরায়েলকে পশ্চিম এবং তার সঙ্গীদের (ভারত, চীন, সৌদি) সাথে সম্পর্ক তৈরিতে সহায়তা করে।
ইসরায়েলের এই ধরনের দ্বিচারী চরিত্র তাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে আমলে না নিয়ে পারেনি। কিন্তু সেখানে অর্থবিত্তের ব্যাপক ব্যবধান এবং মেরুকরণ রয়েই গেছে। এসব কারণে ২০১১ সালে আন্দোলনও হয়েছিল সেখানে। এবং আরেকটি বিক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে ইসরায়েলের এসব বীভৎস নীতি নিয়ে। তার ওপর আমরা সবাই জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল এবার ইরান এবং হিজবুল্লাহ’র বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে চায়
প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পরেও, ইসরায়েল এখনো জাতিবিদ্বেষী দেশ হিসেবেই আছে। এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের অত্যাচারই সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রথম বাধা।
এর ফলে ইসরায়েল সারা দুনিয়ার ইহুদি গ্রুপকে পাশে পেয়েছে, শক্তিশালী সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু এসব অর্জন দুনিয়ার চোখে বৈধ নয়। অন্যদিকে আজকের ফিলিস্তিনিরাই এসব ইহুদিদের দেশকে মেনে নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৭ সাল থেকে শান্তির কথা তোতা পাখির মত বলছে। তারা কখনো ফিলিস্তিনিদের চোখ দিয়ে এই সমস্যাকে দেখতে চাননি। এমনকি যায়নবাদীদের আদর্শকে চ্যালেঞ্জ করে এমন কিছুও না।
২০১৮ সালে এসে, এখন আর কেউ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের কথা বলে না। এদের অনেকেই এখন ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক করতে চায়। তাই ইরান যুদ্ধে আরবদেশ খুব বড় বাধা হবে বলে মনে হয় না।
আমি মনে করি, এখন আর ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব বলে এই সমস্যার ঠিক প্রকাশ হয় না। বরং বলতে হবে, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের উপনিবেশ যাকে ফিলিস্তিনিরা বলে ‘নকবা’।
৭০ বছর পর এসে ভাবতে হচ্ছে, এতদিন যে শব্দগুচ্ছ দিয়ে এই সমস্যাকে চিত্রায়িত করা হয়েছে, তার জায়গায় এখন হওয়া উচিৎ; ‘উপনিবেশ’। এর বাস্তব প্রেক্ষিত কি হয় তা দেখার বাকি। এই সংকটে এবং স্বাধীনতা প্রশ্নে তবে এক্ষেত্রে সকল ফিলিস্তিনির ঐক্যমত থাকা উচিৎ।
ফিলিস্তিনিদের এই ঐক্যমতের লক্ষ্য সকল কমিউনিটির কাছে এমনকি ইসরায়েলের প্রগতিবাদীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এমনকি এই কমিউনিটিগুলার উচিৎ সকল ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা বাস্তবায়ন করা।
এসব আদায় করা ক্ষণিকের কাজ নয়। বরং উচিৎ ইসরায়েলের ওপর ধারাবাহিক চাপ প্রদান করা যাতে সেখানে যথার্থ শান্তি এবং সকল কিছুর সমন্বয় সাধন হয়।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ এক্সাটার এর ‘ইউরোপিয়ান সেন্টার অফ প্যালেস্টাইন স্টাডিজ’ এর পরিচালক ইলান প্যাপের এই লেখাটি গত ১৪ মে ২০১৮ তারিখে আলজাজিরা ইংরেজি অনলাইনের মতামত পাতায় প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেছেন মিনহাজ আমান।