এবারই কি মেসি-রোনালদোর ফাইনাল হতে যাচ্ছে?

এবারই কি মেসি-রোনালদোর ফাইনাল হতে যাচ্ছে?

১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে প্রথম শুরু হয় ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ খ্যাত ফুটবল বিশ্বকাপ। চলতি বছরের জুনে গড়াতে যাচ্ছে বিশ্বকাপের ২২ তম আসর। বিশ্বকাপের খেলা ৩২ দল হলেও অন্যসব কিছু ছাপিয়ে আরো এক লড়াইয়ে নামে ফুটবল ভক্তকুল। প্রায় এক যুগ জুড়ে ফুটবলে আধিপত্য দেখানো মেসি রোনালদোর শেষ বিশ্বকাপ হতে পারে রাশিয়া বিশ্বকাপ। বয়স হয়ে গেলেও সেরা হওয়ার ক্ষুধা একটুও কমেনি আর্জেন্টিনা ও পর্তুগালের এই দুই তারকা ফুটবলারের। সমান ব্যালন ডি’অর, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি এবং সমান সংখ্যক গোল্ডেন বুট জিতেছেন তারা। কিন্তু এই মৌসুম তাদের যে কোন একজনকে এগিয়ে দেবে, এবং এবারই তাদের হাতে সেরা হওয়ার সুযোগ। ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপে ৩৪ বছর বয়সী রোনালদো থাকবেন ৩৭ এ; এবং কদিন পরেই ৩১ এ পা দিবে মেসি, এবং কাতার বিশ্বকাপে তার বয়স হবে ৩৫। বলাই বাহুল্য ক্যারিয়ারের বহু রত্নখচিত মুকুটে সবচেয়ে বহুমূল্য পালকটি যুক্ত করার শেষ সুযোগ এবারই।

জাতীয় দল এবং ক্লাবের হয়ে ৬০০ এর বেশি গোল করা লিওনেল মেসি বার্সেলোনায় যোগ দেন তের বছর বয়সে। বার্সেলোনার সি এবং বি দলে খেলার পর ২০০৪ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে বার্সেলোনার মূল দলে সুযোগ পেয়ে যান। সেই থেকেই বিশ্বকে তাক লাগিয়ে চলেছেন ফুটবলের জাদুতে। অপরদিকে রোনালদোর ফুটবল যাত্রা শুরু হয় সাত বছর বয়স থেকে। ২০০৩ সালে ১৪ মিলিয়ন ডলার মূল্যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে আসার পরই লাইমলাইটে আসেন রোনালদো। শত সমালোচনা আলোচনা হলেও, এত বছর পরও যেন দুই জনের গোলক্ষুধা একটুও কমেনি। দুই তারকার ফুটবল আধিপত্যে শেষ দেখার সময়ে চলে এসেছে। আর তাই সমালোচকরা সব সময় মুখিয়েই থাকেন তাদের যুগের ‘সমাপ্ত’ বলার অপেক্ষায়। কিন্ত তারা সব সময়ই সমালোচকদের আশাহত করে আসছেন।

গতবছরের ৮-ই মার্চ সাবেক ফ্রেঞ্চ ফুটবলার রেয়মন্ড ডমিনিখ বলেন, ‘লিওনেল মেসির এখন আর সেই বিশ বছরের যুবকের ক্ষমতা নাই; আবার সেই জাদুকরি ছন্দও নাই তার দলের জয় নিশ্চিত করার’। তার পর দিনই মেসি নিজে এক গোল করে এবং আরো দুই গোলে পরোক্ষ সহযোগিতা করে পিএসজিকে ৬-১ গোলে হারিয়ে ইতিহাস রচনা করেন।

বার্নড শুসটার একই বছরের ১১ই এপ্রিল মন্তব্য করেন, ‘একটা সময় ছিল যখন তার দল চার গোলে এগিয়ে থাকলেও রোনালদো আরও দুই গোল দিতে চাইত। কিন্ত সেই সময় এখন আর নাই’। চলতি বছরের লা লিগায় রোনালদো ২৭ ম্যাচে ২৬ গোল দিয়ে তাকে ভুল প্রমাণ করেন।

যাইহোক দুই তারকাই তাদের গোল দেয়ার স্পৃহা জারি রেখেছেন। মেসি ধারাবাহিকভাবে লা-লিগার সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে নিজেকে বহাল রেখেছেন, অপরদিকে রোনালদো চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এগিয়ে আছেন। কিন্ত বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিশ্বকাপে ঝলক দেখানোর শেষ সময়ে উপস্থিত দুই তারকা। তাই আমরা আশা করতেই পারি ১৫-ই জুলাই প্রজন্মের সেরা দুই তারকাকে দেখব বিশ্বজয়ের লড়াই করতে।

ক্রিশচিয়ানো রোনালদো (চলতি মৌসুমে জাতীয় দল এবং ক্লাবের হয়ে)

ম্যাচ : ৪৭

গোল : ৪৮

এসিস্ট : ১০

অর্জন : ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ডকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালিস্ট

বিশ্বকাপে অর্জন : ২০০৬ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল, ২০১০ বিশ্বকাপে রাউন্ড অফ সিক্সটিন, ২০১৪ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব।

লিওনেল মেসি (চলতি মৌসুমে জাতীয় দল এবং ক্লাবের হয়ে)

ম্যাচ : ৫৬

গোল : ৪৬

এসিস্ট : ১৮

অর্জন : লা-লিগা, কোপা দেল রে শিরোপা জয়

বিশ্বকাপে অর্জন : ২০০৬ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল, ২০১০ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল, ২০১৪ বিশ্বকাপে ফাইনাল। তিনবারই পরাস্ত হয় জার্মানের কাছে।

ওয়ান লাস্ট রাইড

মেসি-রোনালদোর মধ্যে সেরা কে? এই বিতর্ক চলে আসছে দীর্ঘদিন যাবত। মেসি ভক্ত, সতীর্থ কিংবা কোচরা মেসির প্রশংসা করেন; তেমনি রোনালদো ভক্ত, সতীর্থ এবং কোচদের চোখে সেরা ফুটবলার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। কে সেরা এর উত্তর তাই অনেকটা মতামত এবং ভক্তরা কী ভাবছে তার ওপরে নির্ভর করে। কিন্তু সেরা হওয়ার উত্তর তো মেলে আসলে খেলার মাঠের পারফর্মেন্সে। কে কত গোল করছে, ট্রফি জিতছে এসবের মাধ্যমে। আর এই হিসেবেও সমান দু’জন। মেসি বার্সেলোনার হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন চারটি। রোনালদোও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ট্রফি উচিয়ে ধরেছেন চারবার। গোল্ডেন বুট জিতেছেন রোনালদো চারবার। মেসিরও বুট সংখ্যা চারটি। আবার ব্যালন ডি’অর রোনালদোর হাতে উঠেছে পাঁচবার, তো মেসিও জিতেছেন পাঁচটি। ফুটবলের সর্বজন স্বীকৃত দুই কিংবদন্তি পেলে-ম্যারাডোনার সঙ্গে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো-মেসির যে তুলনা সেটা বিশ্বকাপ না জিতলে পরিপূর্ণতা পাবে না। রোনালদোর বয়স এরই মধ্যে ৩৪ এর ঘরে পৌছে গেছে। সামনের জুনেই মেসি পা দিচ্ছেন ৩১ এ। রাশিয়ার পরে কাতার বিশ্বকাপে রোনালদোকে দেখা প্রায় অসম্ভব। তেমনি মেসির জন্যও সহজ হবে না কাতারে খেলা। তাই সেরা হওয়ার এটাই সুযোগ মেসি-রোনালদোর সামনে। তাছাড়া এবারের মৌসুমে ব্যালন ডি’অর, চ্যাম্পিয়নস লিগ কিংবা গোল্ডেন বুট যিনি জিতবেন তিনিই এগিয়ে যাবেন। আর ব্যালন ডি’অর এর ক্ষেত্রে অবশ্যই বিবেচনায় থাকবে এবারের বিশ্বকাপ।

জাতীয় দলের অবস্থা

গত কয়েক মৌসুমে স্পষ্টতই রোনালদোর খেলার ধরণে বিশাল পরিবর্তন লক্ষণীয়। ক্লাবের হয়ে রোনালদোর দায়িত্ব থাকে বিশেষ করে পেনাল্টি বক্স ফিনিশার হিসেবে। অপরদিকে পাওলেতা ২০০৬ সালে অবসরে যাওয়ার পর পর্তুগালে আর কোন ক্লিনিকাল ফিনিশার দেখা যায়নি। তাই দলের আক্রমণের পুরো দায়িত্ব রোনালদোর কাধেই বর্তায়, যা ইউরো চ্যাম্পিয়নদের জন্যে সুসংবাদ হতে পারে।

আর্জেন্টিনার আক্রমণভাগকে বিশ্বসেরা বললে মোটেও ভুল বলা হবে না। মেসিকে বাদ দিলেও আর্জেন্টিনার আক্রমণভাগ যেকোন দলের রক্ষণভাগকে নড়িয়ে দিতে সক্ষম। সার্জিও আগুয়েরো, গনজালো হিগুয়েন, ডি মারিয়া, পাওলো ডিবালা এবং ইকার্দিদের মত বড় বড় স্ট্রাইকার রয়েছেন যারা যেকোন দলের আক্রমণভাগে খেলার উপযুক্ত। তাই বলা যায় আর্জেন্টিনার হাতে সব মশলাই আছে। এখন দেখার বিষয় হোর্হে সামপোলি কি বের করে আনতে পারেন এই দল থেকে।

রাশিয়াতেই আশা

বয়সের সাথে মেসি রোনালদোর ধার কমেনি একটুও। তাই অনেক ভক্তহৃদ ভাবতেই পারে এর পরের বিশ্বকাপেও হয়ত তারকাদ্বয় তাদের গোল উৎসব জারি রাখবেন। কিন্ত সময়ের সাথে সাথে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতারও সীমা থাকে। ইতিহাসও একই কথা বলে। ১৯৩০ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ৪২২ জন খেলোয়াড় বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছে। ৪২২ জনের মধ্যে মাত্র ৭ জনের বয়স ৩৫ পেরিয়েছিল। সর্বশেষ মিরাস্লোভ ক্লোসা ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে ৩৬ বছর বয়সে বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পান এবং তিনি দুই গোল করে জয়ে অবদানও রেখেছিলেন। মাত্র ৭ জনের সংখ্যাটা মোটেই ভক্তদের জন্য আশাজাগানিয়া নয়। তাই এই বিশ্বকাপেই চোখ থাকবে সবার।

দুই দলেরই সুযোগ রয়েছে গ্রুপ পর্ব অতিক্রম করার। পর্তুগালের প্রথম খেলা প্রতিবেশি স্পেনের সাথে। দুই দলের লড়াইয়ে পর্তুগালের হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও পরবর্তী দুই খেলা মরক্কো ও ইরানের সাথে হওয়ায় খাতাকলমে সহজই হওয়ার কথা তাদের গ্রুপ পর্বের অভিযান।

অন্যদিকে গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ তিনটা দলই শক্তিমত্তার দিক থেকে সমান এবং ক্রোয়েশিয়া, নাইজেরিয়া ও আইসল্যান্ড, তিন দলেরই সামর্থ্য রয়েছে অঘটন ঘটিয়ে আর্জেন্টিনার হাত থেকে পয়েন্ট চুরি করে নেয়ার।

যদি দুইদলই গ্রুপ সেরা হয় এবং দ্বিতীয় পর্বও অর্থাৎ ষোল দলের লড়াই অতিক্রম করে যায় তাহলে কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয়ে যাবে দুই মহারথীর রথ। এবং যদি তা হয় তাহলে সেখানেই থেমে যাবে যেকোন একজন।

মেসির দল আর্জেন্টিনাকে বরাবরের মতই বিশ্বকাপের ফেবারিট ভাবা হচ্ছে। অপরদিকে রোনালদোর পর্তুগালের ফেবারিট তকমা না থাকলেও গত আসরের ইউরো জিতিয়ে পর্তুগাল দেখিয়ে দিয়েছে নামডাক ছাড়াও শিরোপা জেতা যায়। এখন অপেক্ষা করা এবং দেখার পালা কি ঘটতে যাচ্ছে রাশিয়ায়।