দিনটা ছিল ২০১১-র ১৩ মে। বাংলার অগ্নিকন্যার হাত ধরে হয়েছে ‘পরিবর্তন’ যুগের সূচনা। পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে লেখা হয়েছিল নতুন অধ্যায়। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ থেকে ঠিক সাত বছর আগে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লাল দুর্গের দম্ভ গুঁড়িয়ে প্রথমবার মহাকরণে পা রেখে শুরু করেছিলেন পরিবর্তনের সরকার৷ সেই শুরু।
মানুষ সিপিএমকে পরিত্যাগ করার পর ক্ষমতায় এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু মমতার কোনও আলিমুদ্দিন স্ট্রিট নেই। কিন্তু গত সাত বছরে বোঝা যাচ্ছে, একমাত্র মমতাই সবের মূলে। সেই তৃণমূল যুগে জ্যোতি বসু-অনিল বিশ্বাস, দুটোই যেন মমতা। মমতারও দলীয়তন্ত্র আছে। মমতাই সেখানে রেজিমেন্টেশন।
জ্যোতিবাবু কিম্বা বুদ্ধবাবুর কোনো দায় ছিল না সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রকৃত উন্নয়নের। ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে রেশনকার্ড, রেললাইনের ধারে অথবা কোনো খাস জমিতে বাস করার দলীয় লাইসেন্স আর অখাদ্য রেশনেই খুশি ছিল এ রাজ্যের বেশিরভাগ সংখ্যালঘু সহনাগরিক।
মমতা ব্যানার্জী পরম আন্তরিকতার সাথে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মুল সমস্যাটাকে বোঝার চেষ্টা করেছেন এবং সেই পথ ধরেই সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন ঘরে বাইরে প্রবল চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে। এটি মমতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ কেননা, ভারতের সর্বত্রই মুসলমান এবং দলিতরা নিগৃহীত হয়ে আসছে কেন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। সেখানে মমতা এই মুসলমান ও দলিতদের অধিকার আদায়ের পক্ষে।
রাজনৈতিক জীবনের প্রথম নির্বাচনী লড়াইটাই লড়তে হয়েছিল প্রবাদ প্রতিম ব্যাক্তিত্ব এবং দাপুটে সি পি এম নেতা সোমনাথ চ্যাটার্জীর বিরুদ্ধে। সমস্ত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সব হিসেব-নিকেশ উল্টে দিয়ে তিনি জয়ী হলেন। বাংলার মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে নিজের জীবন সংগ্রামের সাথে মিলিয়ে দিয়ে সেই যে তার ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রবেশ, সেই সংগ্রাম আজও তার জীবনের প্রত্যেকটি মুহুর্তের সঙ্গী। সারা শরীরে অসংখ্য আঘাত, মাথায় গভীর ক্ষত আর হৃদয়ে অগণিত অপমান আর উপেক্ষা দিয়েও তার বিরোধীরা তাকে এতটুকুও দমাতে পারেন নি। বাংলার সাধারণ মানুষের ডাকে বাংলার কোণায় কোণায় ছুটে গেছেন, তাদের বিপদের দিনে তাদের পাশে থেকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করেছেন অন্যায়ের, অত্যাচারের। কখনো পাশে নিজের দলকে পেয়েছেন কখনো বা দিল্লির নোংরা সমীকরণ এর অজুহাতে তার দল তার পাশ থেকে সরে গেছেন… কিন্তু তিনি বাংলার আর্ত, নিষ্পেষিত, অবহেলিত মানুষজনকে এক মুহুর্তের জন্যও ছেড়ে যান নি। মানুষের প্রতিবাদকে দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছে দিয়ে বারে বারে মন্ত্রিত্বের মায়া হেলায় ত্যাগ করেছেন। বাংলার শাসকের অত্যাচার যখন নিজের দলের কাছে প্রশ্রয় পেয়েছে নির্লজ্জের মতন, তিনি গর্জে উঠে প্রতিবাদ করেছেন বারবার দলের মধ্যে থেকে… যখন তা ধৈর্যে্যর বাধ ভেঙে দিয়েছে, তখন দল থেকে বেরিয়ে এসে নিজের দল তৈরি করেছেন, প্রাথমিক সফলতা পেয়েছেন কিন্তু নিজের আসল লক্ষ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যূত হননি। এক মুহূর্তের জন্য বাংলার বুকে জগদ্দল পাথরের মতন বসে থাকা অত্যাচারী শাসক দলটাকে স্বস্তি দেননি। বাংলার মানুষের প্রতিবাদের মুখ হয়ে শাসক দলের বিভিন্ন অন্যায়, দুর্নীতি, অত্যাচারের বিরুদ্ধে একের পর এক আন্দোলন সংঘটিত করেছেন এবং অন্তিম সফলতা লাভ করেছেন একক প্রচেষ্টায়। তার এই চড়াই উতরাই চলার পথে কত তথাকথিত নেতা নেত্রী তার সাথে পথ চলতে চেয়ে মিলিত হয়েছেন আবার পিছিয়ে পরে হারিয়েও গেছেন.. কিন্তু তার পথ চলায় বিরাম পড়েনি। বাংলার শাসন ক্ষমতায় এসেই নিজে হাতে তুলে নিয়েছেন ধ্বংসস্তুপ হয়ে যাওয়া বাংলাকে আবার ভারত শ্রেষ্ঠ করার দায়িত্ব। একদম সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত একজন মহিলা নিজের জীবনের সমস্ত ব্যাক্তিগত শখ, আহ্লাদকে ত্যাগ করে বাংলার মা মাটি মানুষের কল্যানকে নিজের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য মেনে নিয়ে যে অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ, লড়াই করে যাচ্ছেন সারাটা জীবন ধরে।
মতুয়া সম্প্রদায়, মুসলমান-ওবিসি সম্প্রদায়, গ্রামীণ কৃষক, সরকারি শিক্ষক, কর্মচারী ও বেকার যুব সম্প্রদায়, গরিব মানুষ— নানা বর্গে, নানা স্তরে নিজের দলীয় পরিসর নিয়ে গঠন করেছেন মমতা। এমনকী দলীয় ক্লাবগুলি পর্যন্ত বহু গ্রামে লোকাল কমিটির মতো কাজ করে। এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনে জয়লাভ ও গ্রামাঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ মমতার ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের জন্যই বিশেষ ভাবে প্রয়োজন। মমতার রাজনীতি আর জনতার রাজনীতি চিরকালই মিশেছে। এই মিডিয়া যুগে মিশছে আরও নতুন ভাবে। পার্টি সংগঠনের হাল বিস্তার বা নেটওয়ার্ককে রক্ষা করা শাসক দলের বড় কাজ।
বর্তমানে বাংলা রাজনীতির সবচেয়ে বড় মুখ তিনি। এমনকী, জাতীয় রাজনীতিতেও আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা বড় ফ্যাক্টর বলেই মনে করে রাজনৈতিক মহল। বিজেপি বিরোধী শক্তিতে তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস-কে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সোনিয়া থেকে শরদ যাদব, অখিলেশ যাদবরা। জ্যোতি বসুর পর বাংলা রাজনীতিতে এতবড় কৌশলী রাজনীতিক এসেছেন কি না তা নিয়ে সন্দেহই আছে। সময় যত গড়িয়েছে ততই যেন পরিণত রাজনীতিক হিসাবে প্রতিনিয়ত নিজেকে তুলে ধরেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি তাঁর এবং তাঁর দলের সবচেয়ে বড় ইউএসপি তাকে কোনোভাবেই ম্লান হতে দেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই কারণে আজ দেশের মধ্যে নরেন্দ্র মোদী বিরোধী শিবিরে অন্যতম বড় মুখের নামও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মৌলবাদী হিন্দুদের উপরে যিনি গত কয়েক বছরে কুঠারাঘাত করে চলেছেন। নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠক নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। কিন্তু, সৌজন্যের রাজনীতিতে বিশ্বাসী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবরই নিজস্ব ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’-এই ভরসা রাখেন।
একজন যোগ্য প্রশাসক হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন রাজনীতিকের চূড়ান্ত সীমায়। একটি রাজ্যের মানুষের দায়ভার তাঁর উপরে ন্যস্ত। উন্নয়নের জন্য, নিরাপত্তার জন্য, আইন-শৃঙ্খলার জন্য। এর দায় এবং দায়িত্ব তো তাঁকেই নিতে হবে। অন্যদিকে নানা রকম রাজনৈতিক টানাপোড়েনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমানে ক্নান্ত এবং হতাশ। হতাশা ফুটে বেরোচ্ছে তাঁর বক্তব্যে। আর অসহায়তা থেকেই সম্ভবত এমন ধৈর্যস্খলন। অশিক্ষা এবং দীর্ঘদিনের বঞ্চনাজনিত ক্রোধকে কাজে লাগিয়ে, মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে তাঁর লাগামছাড়া মন্তব্যের রাজনীতি। আমরা অবশ্য সে বিষয়ে আলোকপাত করব না।
বাংলার এই একরোখা-প্রতিবাদী জননেত্রীকে স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক মহলও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আমলে রাজ্যে চালু হওয়া ‘কন্যাশ্রী’ পেয়েছে এবার বিশ্বসেরার শিরোপা। তাঁর হাতে ‘কন্যাশ্রী’-র বিশ্বসেরা হওয়ার সম্মানও তুলে দিয়েছেন রাষ্ট্রসংঘের প্রতিনিধি দল। শুধু ‘কন্যাশ্রী’ নয় রাজ্যের প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিয়ত জীবন-যাপনকে দেখিয়েছেন এক আলোর দিশা। তাই জঙ্গলমহলে সন্ত্রাস ভুলে মানুষ এখন উন্নয়নের শরিক। যেভাবে পাহাড় হিংসায় বিমল গুরুং এবং তাঁর বাহিনীকে পর্যদুস্ত করে বিনয় তামাং-কে তুলে ধরেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, তার পিছনেও যে ক্ষুরধার মস্তিষ্ক কাজ করেছে তার নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে পাহাড়ে ক্রমশই প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছেন হার্ডলাইনার বিমল গুরুং এবং তাঁর দলবল। তবে, এহেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে বিতর্কও কম হয়নি গত এক বছরে। কিন্তু, যেখানে এক রাজনীতিককে একটা নীতি ও আদর্শকে সম্বল করে কাজ করতে হয় সেখানে তো এমন বিতর্ক স্বাভাবিক। অন্তত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করা আপামার বাংলাবাসীর অধিকাংশই তাই মনে করেন। তাই বিতর্কিত হয়েও গত এক বছরে তাঁর সদর্থক মানসিকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তির জন্য বাংলা ও বাঙালির নয়নের মণি হয়েই থেকেছেন ‘দিদি’।
পঞ্চায়েত ভোটের বিধি-নিষেধ থাকায় দিনটি সেভাবে পালন না করা হলেও নিজের প্রতিক্রিয়া দিতে ভোলেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ এদিন সকালে নিজের টুইটারে লেখেন, ‘‘সাত বছর আগে আজকের দিনে বাংলায় বাম জমানার অবসান ঘটিয়ে মানুষ তৃণমূলকে সরকার চালানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। মা, মাটি, মানুষকে জানাই প্রণাম, সেলাম ও অভিনন্দন”।
রাজ্যবাসীর উন্নয়নে কতটা দায়বদ্ধ, তা গত সাত বছরে প্রমাণ দিয়েছেন তিনি৷ কীভাবে বাংলার সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব, ও প্রমাণ করেছেন৷ বামেদের করা ঋণ শোধের জন্য প্রত্যেক বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ রাজ্যের কোষাগার থেকে কেটে নিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্র৷ তার উপর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কেন্দ্রীয় বঞ্চনা৷ বিরোধীদের লাগাতার কুত্সার মাঝেও এক মুহূর্তের জন্যও থামেনি মমতার সংগ্রাম।