প্রতিনিয়ত শত শত মানুষকে হত্যার বাইরেও প্যালেস্টাইনীদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধ কীভাবে সেখানে তরুণ-তরুণীদের নিঃস্ব করে হতাশার সাগরে নিক্ষেপ করছে তার এক মর্মপীড়াদায়ক দৃষ্টান্ত আলআ আল-ঢালী। ২১ বছরের আল-ঢালী একজন খ্যাতনামা সাইক্লিস্ট। এ বছর আগস্টে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য এশিয়ান গেমসে তাঁর অংশ নেয়ার কথা। কিন্তু ইসরায়েলের একজন পেশাদার স্নাইপার তার সেই আশা ধূলিসাৎ করে দিয়েছে ডান পায়ে গুলি করে।
গত ৩০ মার্চে গাজা সীমান্তে ঢালীকে গুলি করার এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। গত পরশুর বিক্ষোভের মতোই সেদিনও হাজার হাজার গাজাবাসী মাতৃভূমি থেকে উৎখাতের ৭০তম বৎসর উপলক্ষ্যে গাজা সীমান্তে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছিলেন। ইসরায়েলের গুলিতে সেদিন নিহত প্যালেস্টাইনীর সংখ্যা ছিল ১৭।
‘গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারছিলাম আমার আর সাইকেল চালানো হবে না। অথচ প্রতিদিন ছয় ঘন্টা করে মাসের পর মাস আমি অনুশীলন করছিলাম’, বললেন জাকার্তায় প্যালেস্টাইনের পতাকা হাতে হাঁটার স্বপ্ন বিবর্ণ হয়ে যাওয়ায় বেদনাকাতর আল-ঢালী।
ইসরায়েলের ঘেরাওয়ে যুদ্ধাবস্থার মাঝেও গাজায় যারা এখনও খেলাধুলার চর্চা বজায় রাখতে সংগঠকের কাজ করছেন– তাদের অনেকেই মনে করতেন ঢালী এবার এশিয়ান গেমসে পদক পাবে। গত বছর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদক জিতেছিল সম্ভাবনাময় এই তরুণ। এর মধ্যে একটি ছিল জাপান ও ইউএনডিপি’র সহায়তায় আয়োজিত দ্বিতীয় টোকিও লিগের ব্রোঞ্চ পদক। প্যালেস্টাইনীদের মাঝে ঢালীকে মনে করা হতো অন্যতম প্রতিভাবান সাইক্লিস্ট হিসেবে। তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ঢালীকে যখন একটা সাইকেল উপহার দিয়েছিলেন– তখনি পুরো আরব বিশ্বে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল।
গত মাসে ঢালীর পায়ে অন্তত নয়টি অপারেশন চালাতে হয়েছে। তরুণ এই ক্রীড়াবিদের ডান পায়ের হাড়ও গুড়িয়ে গেছে বন্দুকধারীর গুলিতে। প্রচুর আহতকে অপেক্ষায় রেখে গাজার সার্জনরা ঢালীর পা রক্ষায় অন্তত ১০ ঘন্টা চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। সার্জনরা এও জানিয়েছেন, ইসরায়েলি সৈনিকরা সাধারণ বিক্ষোভকালেও এমন অস্ত্র এবং গুলি ব্যবহার করছে যাতে আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি বেঁচে থাকলেও তার অঙ্গহানি ঘটছে। গাজা হাসপাতালে তাই নিয়মিতই আহতদের হাত বা পা কেটে ফেলার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অন্তত পাঁচ জন ক্রীড়াবিদও এভাবে তাদের অঙ্গ হারিয়েছে– যাদের মধ্যে আছে বিখ্যাত ফুটবলার মোহাম্মদ খলিলী। যাকে তার দুই হাঁটুতেই গুলি করা হয়েছিল। এই লেখায় আল-ঢালীর পাশাপাশি নীচে খলিলীর ছবিও রয়েছে। তাকেও সেইদিনই গুলি করা হয় যেদিন ঢালী গুলিবদ্ধ হন।
খলিলীর স্বপ্ন ছিল ইউরোপের কোন ক্লাবে ফুটবল খেলার। ১৭ বছর বয়স থেকে গাজার আল-সালাহ ক্লাবে খেলতেন এই তরুণ। গাজা ম্যারাথনেও গত বছর প্রথম হয়েছিলেন খলিলী।
ঢালী ও খলিলীর মতো তরুণরা ছিলেন গাজার বাসিন্দাদের দুঃস্বপ্নের মাঝে খানিকটা আশার রশ্মি। ইসরায়েল যেন সচেতনভাবেই সেটা গুড়িয়ে দিতে বদ্ধ পরিকর। ২০১৪ থেকে ইসরায়েল এ পর্যন্ত শত শত প্যালেস্টইনীর মাঝে ৩২ জন খেলোয়াড়কেও হত্যা করেছে মাত্র ৪০ মাইল দীর্ঘ গাজা সীমান্তে। খ্যাতনামা আহত ক্রীড়াবিদের সংখ্যা এমুহূর্তে ২৭ জন। প্যালেস্টাইনীরা বেদনামাখা চোখে এখন দেখেন তাদের ফুটবলারদের অনেকেরই পা নেই।
সাম্প্রতিক বিক্ষোভ এবং ইসরায়েলের নির্বিচারে গুলি গাজার হাসপাতালগুলোর স্বাভাবিক ব্যবস্থাপনার ধারাও ভেঙ্গে দিয়েছে। প্রতিটি হাসপাতালে সামর্থ্যরে চেয়ে কয়েকগুন বেশি আহত মানুষ আসছে চিকিৎসার জন্য। ঢালীর দুর্ভাগ্য, তাকেও আহত অবস্থায় চিকিৎসার জন্য পাঁচ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল। প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে তাকে প্রয়োজনীয় অপারেশনের জন্য অন্তত দুইদিন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে অপেক্ষা করতে হয়। সবচেয়ে নির্মম হল, উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢালীকে পশ্চিম তীরে পাঠানোর চেষ্টাও ইসরায়েলের বাধায় সফল হয়নি। সর্বোচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করা হলে ইসরায়েল জানিয়ে দেয় বিক্ষোভকালে আহত কারো চিকিৎসার ক্ষেত্রে তারা কোনরূপ সহায়তা করবে না। বেসামরিক আহত মানুষদের ক্ষেত্রে এইরূপ আচরণ কার্যত সরাসরি যুদ্ধাপরাধের শামিল।
ইসরায়েল গাজার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রেখেও প্রায়ই সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং জরুরি নাগরিক সুবিধায় বাধা দিয়ে থাকে। ২০০৭ থাকে তাদের এইরূপ মানবতাবিরোধী কার্যক্রম চলছে নতুন মাত্রায়।
[তথ্য সহায়তা: মিডল ইস্ট আই ও অন্যান্য]