সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় একটি বৈপ্লবিক রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। পনের বছরের অবসর ভেঙে পৃথিবীর বয়োজ্যেষ্ঠতম সরকার প্রধান হিসেবে শপথ নিয়েছেন মাহাথির মোহাম্মদ। সকল নির্বাচনী জরিপকে ভুল প্রমাণ করা এই ফলাফলকে গণমাধ্যম বলছে, ‘মালয়েশীয় সুনামি’।
মাহাথির মোহাম্মদ ২২ বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে তাঁর একসময়ের উপপ্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে বরখাস্ত করেন। শুধু তাই নয় তার রাজনৈতিক জীবন অতীষ্ঠ করতে সমকামিতার মত অভিযোগে জেলে পাঠান। ২০০৩ সালে মাহাথির স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। অন্যদিকে যথারীতি কারাভোগের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আনোয়ার সংসদে বিরোধীদলের নেতা হিসেবে আর্বিভূত হন। মাহাথিরের উত্তরসূরী প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের শাসনামলে আনোয়ার ইব্রাহিমকে আবারও বিচারের মুখোমুখি করা হয়। অনেক নাটকীয়তা আর আদালতের রায়-প্রতিরায়ের পর তাকে দেয়া হয় পাঁচ বছররে কারাদণ্ড।
মালয়েশিয়ার সামাজিক এবং অর্থনীতিতে মাহাথির পরর্বতী সময়ে নেমে আসে ঘোর দুর্দিন। অভিযোগ ওঠে ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে সীমাহীন দুর্নীতির। মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে অনেক জল গড়ানোর পর মাহাথির নিজ দলের বিপক্ষে চলে যান। অবসর ছেড়ে তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমের দল পাকাতান হারাপানের হাল ধরে নির্বাচনে জয়ী হন। ৬১ বছরের পুরানো বারিসান ন্যাশনাল যুগের অবসান হল এর মধ্য দিয়ে। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নাজিব রাজাকের বাবা টুংকু আবদুর রহমান। বলা হচ্ছে বাবার প্রতিষ্ঠিত দলের ধ্বংস ডেকে আনলেন ছেলে। আর এই দলের হয়েই ২২ বছর দেশ শাসন করেছিলেন মাহাথির নিজে।
একটি প্রচারণামূলক ভিডিওতে মাহাথিরকে ছ বছরের আয়েশা জিজ্ঞাসা করেন, এত বয়সে তিনি কেন কাজ করছেন? মাহাথির উত্তর দেন, ‘বয়স হয়েছে। আমার আর বেশি সময় নেই। মালয়েশিয়াকে নতুন করে সাজানোর জন্য আমার আরও কিছু কাজ বাকি আছে; সম্ভবত বিগত শাসনামলে আমি কিছু ভুল করেছি, সেগুলো শোধরাতে হবে’।
প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, মাহাথির দুবছরকাল রাজত্ব করবেন। অতঃপর সেই আনোয়ার ইব্রাহিমের হাতে ক্ষমতা সঁপে দিয়ে আবার অবসরে যাবেন। ইতোমধ্যে আনোয়ারের মুক্তির তারিখ ৮ জুন নির্ধারিত হয়ে গেছে। র্বতমানে তাঁর বয়স ৭২। এটুকু আমাদের সবারই জানা।
যা জানা নেই তা হল মালয়েশিয়া বা মাহাথিরের শিক্ষা নিয়ে আমরা কি-ই বা করতে পারি। এ নিয়ে দেশের রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক বোদ্ধারা বেশ আলোচনায় মেতেছেন। কেউ কেউ বলছেন এ থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে। কেউ বা মনে করছেন, এতে বাংলাদেশের ক্ষতিই হয়ে গেল। এখন আর কোনো নেতা অবসরে যেতে চাইবেন না! কেউ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন গণতন্ত্র না উন্নয়ন? কোনটা আগে, কোনটা পরে? কিন্তু, কী শেখার আছে? কেমন করে শেখার আছে? এসব কেউ বিস্তারিত বলছেন না।
এই গুরুগম্ভীর বিষয়ে কথা বলার মতন ধৃষ্ঠতা আমার নেই। তবে পরর্বতীতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য একটি দেশে ২০৩২ সালে কি ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে একটি রূপকল্প আমি আপনাদের উপহার দিতেই পারি।
ডেটলাইন ১১ জানুয়ারি ২০৩২। স্থান জেডআর কমল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর। তিনি আজ দুইযুগ পর দেশে ফিরছেন। চারিদিক লোকে- লোকারণ্য। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। প্রিয় নেতাকে বরণ করার জন্য আজ সব পথ এসে মিশে গেছে এই বিমানবন্দরে।
সম্মিলিত জনতা হাতে হাতে নিয়ে এসেছেন গমের শীষ। এই মার্কাই তাদের সফলতার প্রতীক। কদিন আগের নির্বাচনে ভূমিধ্বসানো জয় তার সুদীর্ঘ নির্বাসনের অবসান ঘটিয়েছে। তাই তো তিনি আজ দেশে ফিরে আসছেন বীরের বেশে। কিন্তু, এই সুদিন দেখার জন্য পরিবারের প্রিয়জনরা অনেকেই আজ আসতে পারেন নি। ২০০৮ সালে এই নেতাকে দেশের বাইরে ঠেলে পাঠানো হয় রাজনীতি না করার মুচলেকা নিয়ে। কাকতালীয়ভাবে মালয়েশিয়ার আনোয়ার ইব্রাহিমের মতন তারও সাজা হয় দুর্নীতি, হত্যাসহ নানাবিধ মামলায়। তিনিও আনোয়ারের মতন ৭২ বছরে পা দিয়ে আবার রাজনীতিতে ফেরৎ আসছেন। কিন্তু, আসলে দেশে এই বিপ্লবী পরিবর্তনের রূপকার আসলে তিনি নন। অন্য কেউ।
মালয়েশিয়ার মতন এই দেশেও ছিলেন মাহাথিরের সমকক্ষ এক অবিসংবাদিত নেতা। যিনি নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। পরর্বতীতে পরপর তিন মেয়াদে ২০০৯-২০২৪ সাল অব্দি সফলভাবে দেশ পরচিলনার পর স্বেচ্ছায় অবসরে যান। সব মিলিয়ে তার বিশ বছরের শাসনামলে দেশ মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছিল। মাহাথিরের আমলের মতন তার সময়েও বৃহৎ সব প্রকল্প দেশি অর্থায়নে হয় নির্মিত। বিশ্বব্যাংকসহ অপরাপর দাতারাও তাকে সমীহ করতো। তার আমলেই মহাশূণ্যে উৎক্ষিপ্ত হয় দেশের প্রথম স্যাটেলাইট। মানুষের জীবন যাত্রার মানেও আসে দারুন স্বাচ্ছন্দ্য। দেশকে তিনি রেখে এসেছিলেন উন্নয়নের শিখরে। তবে সমলোচকরা মনে করেন, তার সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা নানা নিগৃহের শিকার হয়েছিলেন। সমসাময়িক বিরোধী শীর্ষনেতাকে করা হয় বাস্তুচ্যুত। আবার জেল জুলুম হুলিয়া নিয়ে দেশান্তরী হন অনেক নেতা। আজ যে নেতা বিমানবন্দরে আসছেন তিনিও সেই নিগৃহিতদের একজন।
কী একটু বেখাপ্পা মনে হচ্ছে, তাই না! আরেকটু খোলাসা করে বলি। ফিরে আসি দেশটির ২০২৪ পরর্বতী যুগে। সেই অবিসংবাদিত নেতার অবসরের পর অদ্ভুত উটের পথে চলতে থাকে দেশটি। দুর্নীতি, দুঃশাসন, রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব তলিয়ে যেতে থাকে প্লাটিনাম জুবিলী পার করা সেই স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া রাজনৈতিক দলটি। নেতৃত্বে দেখা দেয় অবক্ষয়। প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়রা আঙুল ফুলে একেক জন হয়েছেন বটগাছ। দেশে যেন আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগ চলছিল। তাই বাধ্য হয়ে তিনি ৯২ বছর বয়সে আবার ফিরে আসেন রাজনীতিতে। তবে নিজ দলের হয়ে নয়; বরং তার সময়ের বিরোধীদলের হয়ে। বলা প্রয়োজন, এই বিরোধী দলটি দেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের একসময় আশ্রয়-প্রশ্রয় দিলেও, বিগত কয়েক বছর হল তাদের সাথে সব সর্ম্পকচ্ছেদ করেছে। দলটির কথার্বাতায় প্রতিফলিত হচ্ছে বর্তমান বর্ষীয়ান নেতার চিন্তা চেতনা।
‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই‘ বলে একটা কথা বেশ প্রচলিত আছে। অনেকটা নাটকীয়ভাবেই এই নব্বর্য়োধ নেতা অবসর ছেড়ে রাজনীতিতে ফেরৎ আসেন। তিনি হাল ধরেন তার সময়েরই বিরোধীদলের। এই বিরোধীদল ক্ষমতায় থাকাকালে তার ওপর চালায় প্রাণঘাতী হামলা। জাতপাতের প্রশ্নে একসময় তিনি এদলের সাথে সংলাপও পরিত্যাগ করছিলেন। আর আজ সেই দলকে তিনিই নির্বাচনী বৈতরণীও পার করিয়ে নিয়ে এসেছেন। এক সাক্ষাৎকারে এই নেতা বলেন, তিনি হয়তো অতীতে কিছু ভুল করেছেন, এই নির্বাচনে জয় তাকে সেগুলো শোধরানোর সুযোগ দিয়েছে। তিনি আরো জানান, এবার তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের কাল হবে মাত্র দু’বছর। এ সময় একসময়ে তরুণ তুর্কি বলে বিবেচিত নির্বাসন ফেরৎ নেতাই দেশের হাল হাল ধরবেন। তাই আগামী দুবছর তার কাজ হবে এই দেশ-প্রত্যাবর্তী নেতাকে তৈরি করা। যাতে তিনি দেশকে আবার সফলতার শিখরে নিয়ে যেতে পারেন।
এই দেশটিতেও এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে বলে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো নানা বিশ্লেষণ প্রচার করে চলেছে। তথাপি, র্বতমান বাস্তবতায় ২০৩২ সালের বাংলাদেশে কি হবে তা আমাদের অজ্ঞেয়ই রয়ে গেল।
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: এই ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক যোগসূত্র কেউ খুঁজে পেলে তার দায়দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে। লেখায় অনিবার্য তথ্যবিভ্রাটের সুযোগও আছে। অতএব, নিজ দায়িত্বে যাচাই বাছাই করে গ্রহণ-বর্জন করুন।