ইউসেবিও : কৃষ্ণরাজার কষ্ট

ইউসেবিও : কৃষ্ণরাজার কষ্ট

ক্রীড়া বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আসর ফুটবল বিশ্বকাপ। আসর শুরুর এক দুই মাস আগে থেকেই পাওয়া যায় উত্তেজনার আঁচ। মিডিয়া, খেলোয়াড়, সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে সবার আলোচনার একমাত্র বিষয়েই যেন পরিণত হয় বিশ্বকাপ। সেই ১৯৩০ থেকে শুরু অদ্যাবধি আবেদনে সামান্য ঘাটতিও পড়েনি। বরং দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। বিশ্বকাপের খুব কম বিষয়ই আছে যা ফুটবলপ্রেমীদের জানা নেই। সেই জানা অধ্যায়গুলোই আরো একবার মনে করিয়ে দেয়া, আর অজানা বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে জানানোর চেষ্টা করছে জবান। তারই অংশ হিসেবে ‘বিশ্বকাপ না জেতা’ ‘দশ তারকা যারা জিতলে থেমে যেতে পারত পেলে-মারাদোনার তর্কটা কিংবা অন্তত পাশে বসতে পারতেন দুই মহাতারকার’; তাদের নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের দ্বিতীয় পর্বে আজ থাকছে পর্তুগিজ ‘কালো চিতা ইউসেবিও’র কথা।

এই যে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো পর্তুগালে এবারের বিশ্বকাপ নেবার স্বপ্ন বীজ বুনে দিয়ে এসেছেন, তার সূচনা কি রোনালদোর পায়ে? ২০১৬ সালের অসাধারণ ইউরো অভিযানের পর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে পথপদর্শক ভাবছে পর্তুগিজ সাম্রাজ্য, আদতে তিনিই কি স্বপ্নদ্রষ্টা? নাকি প্রায় দেড় দশক আগের ফিগোদের ড্রিম টিম, যেখান থেকে রোনালদোর উত্থান, গ্রিস দুঃখের পর কান্নারত একদল বুড়ো বাচ্চার মলিন মুখশ্রী আজকের পর্তুগালের জ্বালানি? আদতে এরা কেউ নন, এদের কোনটাই নয়, পর্তুগাল মানে ইউসেবিও দ্য সিলভা পেরেইরা, পর্তুগাল মানে মোজাম্বিকে জন্ম নেওয়া এক কালো আফ্রিকান, পত্রিকা আর মোজা মুড়িয়ে ফুটবল বানানো দুরন্ত বালক। লুইস ফিগো একবার বলেছিলেন, ‘ক্রিশ্চিয়ানো সেরা তবে ইউসেবিওর পর’। আসলেই। ১৯৬৬ বিশ্বকাপে রূপকথা লিখতে লিখতেও লেখা হয়নি, পর্তুগালকে তারপরেও বিশ্বআসরে তৃতীয় করেছেন। রোনালদো-ফিগোরা চেষ্টা করেও তা আর টপকাতে পারেননি!

২৫ জানুয়ারি ১৯৪২, মোজাম্বিক, লরিন্ডো সিলভা এবং এলিজা আনিসাবেনির ঘরে এক কৃষ্ণাঙ্গের জন্ম। কুঁড়ি বছর পর পর্তুগিজ ক্লাব বেনফিকা লড়ছে সান্তোসের বিরুদ্ধে। পেলের জোড়া গোলে ৬-০ তে এগিয়ে সান্তোস। বিরতির পর বেনফিকা সাব করায় একজনকে। এলেন, দেখলেন, গোল করলেন, দলকে জেতাতে না পারলেও গোটা বিশ্বের মনোযোগ কেড়েছেন! মাত্র ১৭ মিনিটে হ্যাট্রিক! কে এই বছর কুড়ির বালক? পরদিন সব পত্রিকায় সন্ধান মেলে তার। ৬-৩ এ সান্তোসের জয় ছাপিয়ে শিরোনাম হয়ে ওঠে, ‘পেলে ২-৩ ইউসেবিও’! ক্ষিপ্রতার প্রদর্শনীর সেই থেকে শুরু। সেটি ১৯৬২ সালের গল্প। ক্যারিয়ারে ৭৪৫ ম্যাচে ৭৩৩ গোল করা ইউসেবিওকে মানুষজন এমনিতেই মনে রাখবে। মহীরুহুরা সবদিক দিয়েই ভিন্ন। তারা নিজেদের ভিন্নতায় তুলে ধরতে চায়। ১৯৬৬ বিশ্বকাপে নিজের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে এসেছেন। সেবার এক এবং একমাত্র বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডের চেয়ে খুব পর্তুগালেরভক্ত ‘৬৬-র আসরকে ইউসেবিওর আসর বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। ৫ ম্যাচে ৯ গোল, বিশ্বকাপে পর্তুগালের সেরা সাফল্য তৃতীয় স্থান এসেছে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই।

ইউসেবিও ফেরেইরা। গত শতাব্দীর অন্যতম সেরা ফুটবলার। স্ট্রাইকার পজিশনের ইউসেবিও কারো জরিপে হয়েছেন বিংশ শতাব্দীর সপ্তম, কারো জরিপে নবম, কেউ বা বানিয়েছেন তাকে দশম। পেলের একশো জীবন্ত কিংবদন্তির তালিকায় তিনি ছিলেন প্রথম সারিতে। ১৯৬৬, বিশ্বকাপের অষ্টম আসর। জোয়াও অগাস্টো, হোসে তরেস, ফেরেইরা পিন্টোদের সঙ্গে নিয়ে ইউসেবিও, যিনি আগের বছরই বেনফিকার হয়ে জিতে এসেছেন পর্তুগিজ চ্যাম্পিয়নশীপ। পর্তুগিজরা শুভ সূচনা করে হাঙ্গেরিকে ৩-০ গোলে হারিয়ে। জোড়া গোল পান জোয়াও অগাস্টো। ব্ল্যাক প্যান্থার ইউ’র গোলের খাতা খোলে বুলগেরিয়াকে ৩-০ গোলে হারানো ম্যাচে। পরের খেলায় ব্রাজিলকে ৩-১ গোলে হারানোর দিনে তার নামের পাশে জোড়া গোল। নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়াকে ৫-৩ গোলে হারায় পর্তুগাল। ম্যাচের আরেকটি স্কোরলাইন আছে। ইউসেবিও ৪-৩ কোরিয়া! সেমিফাইনালে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে ২-১ গোলের পরাজয়ে বিশ্বকাপ শিরোপার স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায় কৃষ্ণাঙ্গ এই নক্ষত্রের। ৩১ এবং ৮১ মিনিটে স্যার ববি চার্লটনের জোড়া গোলের পর ৮৩ মিনিটে একটি শোধ করেন পর্তুগাল জাতীয় দলের জার্সিতে ৬৪ ম্যাচে ৪১ গোল করা ইউসেবিও। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী শেষ খেলায় রাশিয়াকে ২-১ গোলে পরাস্ত করে সেলেকসাওরা। সেখানেও কালো চিতা লক্ষ্যভেদ করতে ভুল করেননি।

‘শেষ ভালো যার সব ভালো তার’। প্রবাদবাক্য সবসময় সত্যি হয় না। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে ৭১ বছর বয়সে পরলোকগমন করা ইউসেবিও শেষ ম্যাচে জিতেও তো তৃতীয়ই হলেন!