দাদীমা! আমরা কি আমাদের ভূমি আর ফিরে পাবো না?

ড. ইনাস আব্বাদ -এর কলাম

দাদীমা! আমরা কি আমাদের ভূমি আর ফিরে পাবো না?

সেই নকবার আগুন আজ অব্দি জ্বলছে। যে আগুনের দাপটে সাড়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনি ঘরছাড়া হয়েছিল, গ্রাম দখল হয়েছিল ৫০০। সে আগুন ৭ দশক পরেও সামান্যতম কমেনি।

কয়েকবছর আগে, আমার মনে আছে আমি আমার মৃত দাদিমাকে আমাদের বেথেলহেমের দক্ষিণের গ্রাম যাকারিয়াতে নিয়ে যাচ্ছিলাম। এই গ্রাম ইহুদিবাদের জন্যে বেশ প্রসিদ্ধ। আমরা উদ্বাস্তু হয়ে সেই গ্রাম ছাড়ার পর ইসরায়েলের দখলদারিত্বের অধীনে সেই গ্রামটির নাম হয়েছে যেখারিয়া।

১৯৪৮ সালে আমার দাদিমা গ্রাম থেকে পালিয়ে আসার সময় সাথে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন কিছু জামা আর হাল্কা খাবার। তিনি দরজা-জানালা বন্ধ করতে লাগলেন, তার হাবভাবে মনে হচ্ছিল আমরা হয়ত দুইতিন সপ্তাহ পর ফিরে আসব। তিনি বলতেন, ‘ওরা আমার ঘর নিয়ে যাক, ভূমি বা আমার জীবন, তবে আমার কাছে থাকা ঘরের চাবিটাই আমাকে এসব স্মৃতি মনে করিয়ে দেবে’।

যাই হোক,পরে আমরা সেই গ্রাম দিয়ে যেতে যেতে দাদিমা খালি বারবার গাছ-পাহাড় ছুঁয়ে দেখছিলেন। সব কিছু বদলের পরেও, সেই মসজিদ, গ্রামপ্রধানের বাড়িসহ অনেক কিছুই সে সময়ের দখলদারিত্বের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে।

‘তখন গ্রামের সবাই সেখানে বসত, নানা বইসহ মিশর থেকে আগত ম্যাগাজিনও পড়তাম। বিকেলে আমরা গ্রামপ্রধানের বাড়িতে রেডিওতে খবর শুনতে যেতাম’ দীর্ঘ নি:শ্বাসের সাথে এসব বলতেন তিনি।

আমরা সেই স্কুল পর্যন্ত হেটে গেলাম যেই স্কুলটিকে বলা হয়ে থাকে ফিলিস্তিনির এই শতাব্দীর প্রথম স্কুল। সেখানে দাঁড়িয়ে আমার দাদি তার চোখের পানি ধরতে রাখতে পারলেন না। তিনি কাঁদতে কাঁদতে সেই কবিতাটি আওরাতে থাকলেন, যেটি তিনি স্কুলে শিখেছিলেন।

আর্থার জেমস বেলফোর যিনি ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তিনি হয়ত আমার দাদিমার মতো মানুষদের কথা সামান্যতম ভাবেন নি, যে কারণেই তিনি ফিলিস্তিনকে ইহুদিদের হাতে তুলে দিলেন যারা আমার পূর্বপুরুষের ভিটেতে যায়নবাদীদের দেশ বানাতে চান।

১৯৪৮ সালের ১৫ মে, আরব-ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হয়। এইভাবে দেশভাগ করার সিদ্ধান্তে জাতিসঙ্ঘের শরণাপন্ন হয় ফিলিস্তিন। এবং তাদের পিতার ভূমি থেকে ইসরায়েলের সশস্ত্র বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার দাবিও করে। সে যুদ্ধ তার পরের বছর মার্চ পর্যন্ত চলে। এবং শেষমেশ আমরা হয়ে পড়ি দেশহীন।

রাজনৈতিক নেতারা আমেরিকাকে শান্তির দূত হিসেবে বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু মার্কিন দেশ বাস্তবে ইসরায়েলের রক্ষাকর্তা হিসেবেই হাজির থাকে। আজকের ট্রাম্প  ফিলিস্তিনিদের ক্ষুধা, দখল এবং রক্তের বদলেই তার নিজের দেশের তরুণদের চাকরি দিয়ে দেশকে ‘গ্রেট’ বানাতে কথা দিয়েছেন

 

আমি আর দাদিমা একটি গাছের নিচে বসলাম, তিনি বসতেই হুহু করে কেঁদে উঠলেন। তিনি বললেন, ‘তোর চাচা আব্দুল ফাতাহকে আমি এই গাছের নিচেই ১৯৪৮ সালের এক দিনে জন্ম দিয়েছি। তখল ঠিক সেসময়ে দখলদারিত্বের ভরা মৌসুম, চারদিকে গুলির শব্দ, লাশের বন্যা, বাচ্চাদের হাহাকার এবং স্বজনহারা নারীদের কান্নায় বাতাস ভারি।

তিনি বলতে থাকলেন, ‘আমি আমার সে সন্তানকে তার দেশ ফিরিয়ে আনতে ১৭ বছর বয়সেই পিএলও এর সাথে লড়াইয়ের ময়দানে পাঠিয়ে দেই, সে আর ফিরে আসেনি। নিজের মাতৃভূমির সাথে হারালাম সন্তানও’।

আচ্ছা জাতিসংঘের ১৯৪ রেজ্যুলশানের কি হল, যার অধীনে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার কথা ছিল? সেখানে আমার দাদিমার নাম কই? এইসব কথার কথা আসলে কে বাস্তবায়ন করবে? নাকি শরণার্থী সংকট ইরাক, ইরান আর সিরিয়ার বাইরে নেই? লোকে বলে, ইসরায়েল নাকি আমেরিকার বখে যাওয়া সন্তান, যার জন্যে কোন আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত গুরুত্ব বহন করে না।

দাদিমা একটা লেবু গাছের কথা বলছিলেন, যেটি তিনি লাগিয়েছিলেন। যেবার দাদিমারা নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে পালালো, সেবার অনেক লেবু ধরার কথা ছিল। তখন নারীরা ব্যাপক হারে চাষাবাদ করত। দাদি মৃত্যুর আগে অসিয়ত করেছিলেন, তার কবর যেন সেই লেবু গাছের তলাতেই হয়।

আমরা যাকারিয়া গ্রাম পরিদর্শন শেষেই দাদিমা বুকের ব্যাথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি স্ট্রোক করেন।

যাকারিয়া গ্রাম থেকে পালিয়ে আসার পর দাদিমা বলতেন কিভাবে তারা হেটে হেটে রামলা শহরে এসেছিলেন। গুলির শব্দ আর প্রিয়জনদের হাহাকারই তখন সঙ্গী। দাদিমার চতুর্থ সন্তান আলি হওয়ার আগেই তিনি স্বামীকে হারান।

দাদিমা পুরো পরিবার নিয়ে বেথেলহামের এক শরণার্থী ক্যাম্পে পরিবারসহ আশ্রয় নেয়। কিন্তু তিনি যাকারিয়ার দিনগুলো কখনও ভুলতে পারেননি।

দাদিমা আজ আর আমাদের সাথে নাই। তার যাকারিয়ার নিজের ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা আজও আমাদের কানে ভাসে। যাকারিয়ায় তার বাড়ির সেই চাবি আজও আমাদের কাছে সযত্নে আছে। আজও দেয়ালে ঝুলানো সেই চাবিটি যখন দেখি, বলি, ‘আল্লাহ চাহে তো একদিন আমরা আমাদের দেশভূমিতে ফিরে যাব, ফিরে যাবই’। কিন্তু জানি প্রশ্ন থেকেই যায়, কখন, কিভাবে?

অসলো চুক্তির ২৫ বছর পরেও আরব জাতি এখন পর্যন্ত তাদের হারানো ভিটেমাটির এক টুকরাও ফেরত পায়নি, একটা জলপাই গাছও নয়। আমরা কবে ফিরে যাব দাদিমা?

আরব দেশগুলোর সাথে যেমন সৌদি থেকে মিশরের সাথে আমাদের সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হচ্ছে, আর ইসরায়েল-মার্কিন মুল্লুকের সাথে আজ তাদের বসন্ত। গত দশকে তাই আমরা দেখলাম, গাজায় তিনটি যুদ্ধ হয়েছে, লাশ হয়েছে হাজারের বেশি। থাকার ঘরগুলো আজ বারুদে ঠাসা। তাহলে আমরা আমাদের ঘরে কবে ফিরে যাব দাদিমা?

এতসবের মাঝেও আজ পর্যন্ত ইসরায়েলি জবরদস্তি চলছে, সারা দুনিয়াকে সে তা দেখাচ্ছেও। তারা নতুন করে সেখানে তাদের বসতি গড়ছে, কাটাতার আরো দীর্ঘ হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের জন্যে। দাদিমা আমরা তাহলে কবে ফিরে যাব?

 


পূর্ব জেরুজালেমের রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষক ও গবেষক ড. ইনাস আব্বাদি মিডল ইস্ট আই এর নিয়মিত কলাম লেখক। এই লেখাটিও গতকাল ১৫ মে নকবা দিবসে মিডল ইস্ট আইয়ে প্রকাশিত হয়।