টেস্টের ভবিষ্যত নিয়ে ম্যাককালামের শংঙ্কা এবং আইসিসির ভূমিকা

টেস্টের ভবিষ্যত নিয়ে ম্যাককালামের শংঙ্কা এবং আইসিসির ভূমিকা

পাকিস্তান-আয়াল্যান্ড ম্যাচ দিয়ে ক্রিকেট পেল টেস্ট পরিবারের নবীনতম সদস্যকে। সাধারণ সমর্থক থেকে শুরু করে কর্মকর্তা, খেলোয়াড়দের আবেগ-উচ্ছাসই প্রমাণ করে ক্রিকেটের মূল ভার্সন খেলার ছাড়পত্র পেতে কতটা মুখিয়ে ছিল দলটি। আনন্দঘন মুহুর্তের মাঝেই আশঙ্কার কথা শোনালেন সাবেক কিউই অধিনায়ক ম্যাককালাম। তিনি বলেছেন টেস্ট না টি-টোয়েন্টিই হবে ক্রিকেটের কর্তা।

অন্যান্য খেলার সাথে ক্রিকেটের মৌলিক তো বটেই জটিল কিছু পার্থক্যও রয়েছে। ক্রীড়া বিশ্বের বহুল প্রচলিত খেলাগুলোর মধ্যে ক্রিকেটই একমাত্র খেলা যার আলাদা তিনটি ভার্সন রয়েছে। এর মধ্যে যে টেস্টই মূল তা নিয়ে সন্দেহ না থাকলেও ব্যাপ্তির কারণে টেস্টের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কার কথা বহুবারই উচ্চারিত হয়েছে। সে হিসাবে ম্যাককালাম যা বলেছেন তা নতুন কিছু নয়। তিনি নতুন যা করেছেন, সেটি হল আরো নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে কেন তিনি টেস্টের ভবিষ্যত নিয়ে শংঙ্কিত।

এখানেও এসেছে ফ্রাঞ্চাইজির আধিপত্য এবং আর্থিক বিষয়টি। এটি নিয়ে পূর্বে একাধিকবার আলোচনা করায় সে পথে না গিয়ে টেস্টকে কেন বারবার টেস্ট কেসের মুখোমুখি হতে হচ্ছে সেদিকটা বরং দেখতে চাই। এটা স্পষ্ট করেই বলে দেয়া যায় যে, এক্ষেত্রে খেলোয়াড় কিংবা বোর্ডের চেয়ে অধিকতর দায়ী আইসিসি। তাদের নতজানু নীতি এবং খেলার চেয়ে আর্থিক মুনাফা লাভের ক্রমশ বেড়ে চলা অসুস্থ প্রবণতা।

ইদানিং টেস্ট আকর্ষণ হারানোর অন্যতম মূল কারণ, একপেশে ফল অথবা একদমই নিরস ম্যাচ। একই সাথে তিনটি ভার্সনের মধ্যে সমতার বদলে সোনার ডিম পাড়া টি-টোয়েন্টির অগ্রাধিকার। এবং আরো স্পষ্ট করে বললে ধাপ্পাবাজি। এখনো যে মানুষ টেস্ট ভালোবাসে তার সর্বশেষ প্রমাণ আয়ারল্যান্ড-পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে সাধারণ সমর্থকদের আগ্রহ। তারপরও টেস্ট নিয়ে আইসিসির অনিহা, যেটি নিশ্চিতভাবেই তারা কবুল করে না; এর মূখ্য কারণগুলো খতিয়ে দেখা যাক।

একপেশে বা একদম নিরুত্তাপ ম্যাচের অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে সরাসরি বলা যায় পিচের কথা। ইদানিং প্রায় প্রত্যেকটা দলই নিজের কন্ডিশনের সুবিধা নেয়ার জন্য যথেচ্ছা পিচ বানাচ্ছে। এর দরুন সফরকারী দলগুলো জেতার চেষ্টা তো দুর, ম্যাচ বাঁচানোর কৌশল খুজে পেতেই ব্যস্ত সময় পার করে। এমন ম্যাচ যে উপভোগ্য হয় না তা বলাই বাহুল্য। আর এমন অসম কসরত দেখার জন্য যে কেউ টেস্ট দেখতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। এর বাইরে আরো একটি পিচ এখন বহুল ব্যবহৃত, নিঁখাদ ব্যাটিং পিচ। যেটিতে পুরো পাঁচ দিন শেষেও দু’পক্ষ একবার করেও অল-আউট হয় না। এমন ম্যাচও ক্রমাগত বিরক্তিরই উদ্রেক করে।

এটা সত্য যে আফ্রিকার কন্ডিশন আর বাংলাদেশের কন্ডিশন এক হবে না। যার কারণে আফ্রিকায় পেস পাবে, বাউন্স করবে আর বাংলাদেশে সেটি হবে স্লথ এবং টার্নিং। কিন্তু এটা কতটা তার মাত্রা কি কখনো ঠিক করা হয়েছে? হোম টিম কন্ডিশনের সুবিধা নেবে; এটা জায়েজ বলে যে অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে দেখা যায় যে এক মহাদেশের দল আরেক মহাদেশে গেলেই খাবি খেতে শুরু করে। সবগুলো ম্যাচই যে একদম একপেশে তা না, তবে এটিই যে এখন সিংহভাগ ম্যাচে ঘটে তা পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। এটি বছরের পর বছর চলে আসলেও আইসিসির এটি নিয়ে রা নেই।

আইসিসি ক্রিকেটকে প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ করার জন্য প্রায়শই নিয়ম-কানুনে বদল আনে। সেটি ক্রিকেটের মূল সমস্যার কতটা সমাধান করে বিষয়টি পরিষ্কার না। আরো একটি বিষয় হল টেস্ট, ওডিআই ও টি-টোয়েন্টির মধ্যে ভারসম্যের অভাব। আইসিসির স্পষ্ট বয়ান, টেস্ট এখন মানুষ খুব একটা দেখতে চায় না বলে টেস্ট ম্যাচের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজের তো যেভাবে কমছে কিছুদিন পর এর স্থান হবে জাদুঘরে। এখানে তিনটি ফরম্যাট এরই ভক্ত রয়েছে। খেলোয়াড়-সমর্থক সবার মধ্যেই। সুতরাং কোনো ফরম্যাট চাপিয়ে না দিয়ে আণুপাতিক হারে ম্যাচ সংখ্যা সমান করে দিলেই তো ঝামেলা থাকে না। যার যেটি ভালো লাগে সে সেটিই খেলবে, দেখবে।

বিষয়টি খুব সহজে বলা গেলেও আইসিসি যে সে পথে হাটবে না বলাই বাহুল্য। এর মূল কারণ টি-টোয়েন্টি থেকে পাওয়া মুনাফা। অবস্থাটা এখন এমন দাড়িয়েছে যে, অাইসিসি ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থার বদলে পরিণত হয়েছে ক্রিকেট বিপণন প্রতিষ্ঠানে। সেটির খেসারত যে শুধু টেস্টই দিচ্ছে এমন না, ওয়ানডেকেও পরতে হচ্ছে এর কষাঘাতের নিচে। যার ফলে বিশ্বকাপ আর বৈশ্বিক না থেকে হয়ে যাচ্ছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ইচ্ছার দাস।

আইসিসি যে একটি ধাপ্পাবাজ সংস্থায় পরিণত হতে যাচ্ছে তার অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে এফটিপি নিয়ে তাদের বয়ান। সর্বোচ্চ সংস্থা হবার পরেও কোনো বোর্ডকে কোনো কিছুতে বাধ্য করার বদলে আইসিসি পালন করে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা! যার ফলে বড় বোর্ডগুলো ছোট দলগুলোর সাথে ইচ্ছে মতন সিরিজ বাতিল করতে পারে এবং আইসিসিও বিনা বাক্য ব্যয়ে সেটি কবুল করে নেয়। যে নাটকের সর্বশেষ পর্বটি উপহার দিয়েছে অজি ক্রিকেট বোর্ড, বাংলাদেশের সাথে একতরফা ভাবে সিরিজ বাতিল করে। এখানেও যে আইসিসি কোনো ভূমিকাই রাখেনি বলাই বাহুল্য। আপনি যদি কোনো দলকে শক্তিশালী করে তুলতে চান, তাহলে ম্যাচ খেলার সুযোগ তো দিতে হবে। সেটি না করে দলটি দুর্বল বলে তাকে যদি খেলারই সুযোগ দেয়া না হয়, উন্নতিটা হবে কোথা থেকে, সেটা পরিষ্কার না। আর সেটিকে উপলক্ষ্য করে টেস্ট প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ হয় না বলে মায়া কান্না কাঁদাটা একটা চূড়ান্ত রকমের ধাপ্পাবাজি।

আইসিসি কেন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে সেটি নিশ্চিতভাবেই ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আর আইসিসি নিজেই যদি টেস্টের প্রতি বিমাতা সূলভ আচরণ করে তাহলে টেস্টের ভবিষ্যত যে শঙ্কার মুখে পড়বে সেটি তো বলাই বাহুল্য। ক্রিকেট কখনোই বারোমাসি খেলা ছিল না, এটিকে বারোমাসি খেলায় পরিণত করারও প্রয়োজন নেই। বরং, যেটুকু টেস্ট খেলা হত, সেটি কমিয়ে দিয়ে এর দর্শকদের বঞ্চিতই করছে আইসিসি। এখানে, যদি কেউ বোর্ডের কথা বলেন, তাহলে বলা লাগে সেটি অহেতুক তর্ক হবে। সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা নিয়ে ক্রিকেট যারা পরিচালনা করছেন তারা ছোট বোর্ডগুলোর ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে গুণেই না। এটি বহুবার প্রমাণিত।

ম্যাককালাম যেমনটি বলেছেন, সেটির যথার্থতা ভবিষ্যতই নির্ধারণ করবে। তবে, এখানে ফ্রাঞ্চাইজিগুলো যতটা দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী থাকবে আইসিসি। ফ্রাঞ্চাইজি নামক ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের জন্ম দেয়ার জন্যই না শুধু, যেভাবে এ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে বড় হবার সুযোগ দিচ্ছে সে জন্যও। এখনো সময় যথেষ্টই আছে মুনাফালোভীদের থাবা থেকে মুক্ত করে ক্রিকেটকে স্বস্তি দেয়ার। কিন্তু যথেষ্ট সময়ও যে অপ-ব্যবহারে অপ্রুতুল হয়ে যায় তা ইতিহাসই বয়ান দেয়। ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এ উপলব্ধি কবে হয় সেটিই এখন দেখার বিষয়।